৩৩. পার্থ কর্ত্তৃক ভীষ্মের তৃষ্ণা নিবারণ ও দুর্য্যোধনের প্রতি ভীষ্মের হিতোপদেশ দান

মুনি বলে, জন্মেজয় শুন সাবধানে।
প্রভাতে আইলা সবে ভীষ্ম দরশনে।।
শরশয্যা পিতামহে দেখি সর্ব্ব বীর।
কুরুগণ প্রণমিল ভূমিগত শির।।
ইন্দ্রের শয়নে যেন বেড়ে দেবগণ।
ভীস্মেরে বেড়িল তেন কৌরবের গণ।।
শরাঘাত বেদনা বিকল মহাবল।
তৃষ্ণায় আকুল ভীষ্ম মাগিলেন জল।।
সুবাসিত হবে অতি পরম শীতল।
তৃষ্ণায় অন্তর জ্বলে আনি দেহ জল।।
শুনি দুর্য্যোধন রাজা অতি ব্যস্ত হয়ে।
আনিল শীতল বারি ভৃঙ্গার পূরিয়ে।।
সুবর্ণ ভৃঙ্গার দেখি ভীষ্ম মহাবীর।
দুর্য্যোধনে সম্বোধিয়া কহে অতি ধীর।।
ভোগের সময় নহে মরণের কালে।
কি করিবে জল মোর সুগন্ধি শীতলে।।
তোমা হৈতে মোর দুঃখ নহিবে বারণ।
শীঘ্র আন পাণ্ডুপুত্র সহ নারায়ণ।।
যুধিষ্ঠিরে দূত যেয়ে কহে সবিনয়।
কৃষ্ণসহ পঞ্চ ভাই চল মহাশয়।।
তোমা সবা নিতে আজ্ঞা কৈল ভীষ্মবীর।
শুনিয়া চলিল তবে রাজা যুধিষ্ঠির ।।
পার্থসহ আপনি চলিলা নারায়ণ।
বৃকোদর বীর আর মাদ্রীর নন্দন।।
পঞ্চ ভাই গিয়া তবে ভীষ্মের সদনে।
প্রণাম করিল পিতামহের চরণে।।
যোড় হাতে কহি রহে সম্মুখে দাঁড়ায়ে।
দেখিয়া কহিল ভীষ্ম হরষিত হয়ে।।
তৃষ্ণায় শুকায় মোর সকল শরীর।
এ সময় পাই যদি সুশীতল নীর।।
বড়ই শীতল হয় শরীর জুড়ায়।
আনহ অর্জ্জুন শীঘ্র করিয়া উপায়।।
শুনি পার্থ ততক্ষণে আনিল গাণ্ডীব।
করযোড়ে প্রণমিল শরদাতা শিব।।
গুরু দ্রোণাচার্য্য পদে করিয়া প্রণাম।
আপদভঞ্জন লৈল শ্রীকৃষ্ণের নাম।।
ধনুকেতে গুণ দিয়া পূরিল টঙ্কার।
স্বর্গমত্ত্য পাতালেতে লাগে চমৎকার।।
মন্ত্রঃপূত করি মারে পাতাল চাপিয়া।
ভেদিয়া উঠিল পৃথ্বী বিদার করিয়া।।
ভোগবতী জল উঠে ভীষ্মের দক্ষিণে।
আপন ইচ্ছায় পড়ে উঠিয়া বদনে।।
ভোগবতী-গঙ্গাজল বড়ই শীতল।
পান করি তৃপ্ত হন ভীষ্ম মহাবল।।
অর্জ্জুনের কর্ম্ম দেখি সবার বিস্ময়।
কম্পমান হৈল যত কৌরব-তনয়।।
তৃপ্ত হৈলা ভীষ্ম, দেখি কৌরব সকলে।
শঙ্খ-দুন্দুভির বাদ্য বাজে কুতূহলে।।
নৃপে সম্বোধিয়া বলে শান্তনু-নন্দন।
দেখিলা কি দুর্য্যোধন অর্জ্জুন-বিক্রম।।
এক এক অস্ত্রে পারে জিনিতে ভুবন।
সকরুণে যুদ্ধ করে পাণ্ডুর নন্দন।।
বসুমতী ভেদিয়া তুলিলা জলধার।
মনুষ্যের মক্তি দেখ আছয়ে কাহার।।
শুন রাজা হিতবাক্য কর প্রণিবাণ।
যাহার অধীন কৃষ্ণ পুরুষ-প্রধান।।
ক্রোধ নাহি করে যাবৎ রাজা যুধিষ্ঠির।
তাবৎ তোমার সেনা রণে আছে স্থির।।
আমা অন্তে যুদ্ধ ছাড় পরিহরি কোপ।
অর্দ্ধরাজ্য ছাড়ি দেহ হইয়া সন্তোষ।।
সম্প্রীত করিয়া দেহ পাণ্ডবের ভাগ।
তৃপ্ত মনে আমি তবে করি প্রাণত্যাগ।।
দুর্য্যোধন বলে, মম প্রতিজ্ঞা না নড়ে।
বিনা যুদ্ধে রাজ্য নাহি দিব পাণ্ডবেরে।।
শুনি ভীষ্ম ক্ষমা দিল আপন অন্তরে।
দৈবে যাহা করে, তাহা কে খণ্ডিতে পারে।।
পুণ্যকথা ভারতের শুনে পুণ্যবান।
পৃথিবীতে নাহি সুখ ইহার সমান।।
কাশীরাম দাস কহে রচিয়া পয়ার।
অবহেলে শুনে যেন সকল সংসার।।