২৯. ভীষ্মের মৃত্যুইচ্ছা

সঞ্জয় বলেন, শুন কৌরব-ঈশ্বর।
মহাযুদ্ধ করিলেন ভীষ্ম ধনুর্দ্ধর।।
ভীমসেন সাত্যকি দ্রুপদ ধনঞ্জয়।
মৎস্যরাজ ধৃষ্টতেকু সমরে দুর্জ্জয়।।
এই ছয় বীরে তবে মর্ম্মে হানে বাণ।
দশ দশ বাণে হানে পূরিয়া সন্ধান।।
শীঘ্রহস্ত ভীষ্ম বীর বাণ-বৃষ্টি করে।
শরে শর নিবারয়ে সেই ছয় বীরে।।
পুনঃ লয় ক্ষুরবাণ যতেক আছিল।
শিখণ্ডী হানিল বাণ তাহা না জানিল।।
ক্রোধ করি ধনঞ্জয় হাতে নিল চাপ।
ভীষ্মের কাটিল ধনু অতুল প্রতাপ।।
ভীষ্ম-ধনু কাটা গেল দেখি সর্ব্বজন।
অর্জ্জুন সহিত গেল করিবারে রণ।।
দ্রোণ ভূরিশ্রবা আর রাজা সোমদ্ত্ত।
জয়দ্রথ বীর কৃতবর্ম্মা ভগদত্ত।।
অর্জ্জুনে বেড়িল সবে এই ছয় বীরে।
প্রলয় কালেতে যেন সমুদ্র উথলে।।
অর্জ্জুনে বেড়িয়া সব কুরু সৈন্যবল।
দিব্য দিব্য অস্ত্র এড়ে কৌরব সকল।।
দেখিয়া পাণ্ডব-যোদ্ধা কৌরবের গণ।
ভীমসেন সাত্যকি আইল ততক্ষণ।।
ধৃষ্টদ্যুম্ন দ্রুপদ বিরাট নৃপবর।
অভিমন্যু ঘটোৎকচ আইল সত্বর।।
ক্রোধ হৈল সপ্তবীর অগ্নির সমান।
ভয়ঙ্কর যুদ্ধ হৈল কি দিব তুলন।।
পূর্ব্বে যেন রণে হৈল দেবতা দানবে।
সেই মত রণ হৈল কৌরব-পাণ্ডবে।।
ধনু হাতে যুঝে বীর গঙ্গার তনয়।
সেই ধনু বাণেতে কাটিল ধনঞ্জয়।।
আর ধনু হাতে নিল ভীষ্ম মহাবীর।
গুণ দিতে কাটি পাড়ে হাতে নহে স্থির।।
এই মত ভীষ্ম ধনু পুনঃ যায় কাট।
যমের দুয়ারে যেন লাগিল কপাট।।
মহাক্রোধ হয়ে বীর শক্তি নিল হাতে।
পর্ব্বত বিদার শক্তি মারে পার্থ মাথে।।
অর্জ্জুন দেখিল শক্তি বজ্রের সমান।
পঞ্চবাণ হানিয়া করিল খান খান।।
খণ্ড খণ্ড হয়ে শক্তি ভূমেতে পড়িল।
মেঘবৃন্দ মধ্যে যেন বিজুরী খেলিল।।
কাটা গেল শক্তি দেখি ভীষ্ম কৈল কোপ।
মনে মনে ভাবি বীর করে অভিরোষে।।
পঞ্চ ভাই মারিবারে পারি একেশ্বর।
যদি রক্ষা না করে আপনি দামোদর।।
মারিতে না পারি রণে অবধ্য যে জন।
রথেতে শিখণ্ডী আর আপনি নারায়ণ।।
মরণের কাল এই হইল এখন।
পাণ্ডবের পরাক্রম বাড়ে দিন দিন।।
ভীষ্মবীর হেনমতে চিন্তে মনে মন।
আকাশেতে সপ্তবসু জানিল তখন।।
হেনকালে বায়ু বহে গন্ধে মনোহর।
গগনেতে বাজে বাদ্য শুনিতে সুস্বর।।
ঋষিগণে বসুগণে বলয়ে তখন।
উত্তম চিন্তিলা ভীষ্ম ত্যজ তুমি রণ।।
দেবতার প্রিয়কর্ম্ম স্মরি পূর্ব্বকথা।
যুদ্ধ নিবারিয়া আইস সঙ্গে থাকি হেথা।।
এ সব বৃত্তান্ত আর কেহ না জানিল।
শান্তনু তনয় তাহা সকলি শুনিল।।
দৈববাণী শুনি ভীষ্ম ক্রোধ সম্বরিল।
ভীষ্ম মহাবীর তবে যুদ্ধ মন দিল।।
অর্জ্জুন উপরে ভীষ্ম শরবৃষ্টি করে।
অর্জ্জুন হানয়ে তবে ভীষ্ম কলেবরে।।
ধনু ধরি যুঝে বীর সংগ্রামে নিপুণ।
পঞ্চ বাণে সেই ধনু কাটিল অর্জ্জুন।।
যেই ধনু হাতে লয় ভীষ্ম মহামতি।
সেই ধনু অর্জ্জুন কাটয়ে শীঘ্রগতি।।
বাছিয়া বাছিয়া বীর করয়ে সন্ধান।
ভীষ্মের উপরে হানে লক্ষ লক্ষ বাণ।।
তবে ভীষ্ম বলিলেন শুন দুঃশাসন।
অর্জ্জুনের বাণ পড়ে যেন কাল যম।।
তাহার অগ্রেতে হবে আছে কোন জন।
অর্জ্জুনেরে জিনিতে না পারে দেবগণ।।
আমাকে বিন্ধিল দেখ চোখ চোখ শরে।
নিরন্তর শরজালে বিন্ধে কলেবরে।।
এতেক বলিয়া ভীষ্ম বরিষয়ে শর।
বরিষার কালে যেন বর্ষে জলধর।।
ক্রোধ করি ভীষ্ম পুনঃ শক্তি নিল হাতে।
বাহুবলে হানে ভীষ্ম অর্জ্জুনের মাথে।।
তিন বাণে অর্জ্জুন করিল তিন খান।
কুরুগণ সকলে দেখিল বিদ্যমান।।
খড়্গ চর্ম্ম হাতে নিল ভীষ্ম মহাবল।
খণ্ড খণ্ড কৈল তবে পার্থ ধনুর্দ্ধর।।
নানা অস্ত্র বরিষয়ে ভীষ্মের উপরে।
বরিষার কালে যেন বর্ষে জলধরে।।
দুই বীরে মহাযুদ্ধ বাজিল তুমুল।
দশম দিবসের যুদ্ধ দিতে নারে তুল।।
কাশীরাম দাস কহে ভারত আখ্যান।
দশম অধ্যায় এই হৈল সমাধান।।