১৪. ষষ্ঠ দিনের যুদ্ধ

সঞ্জয় বলেন, রাজা একমনে শুন।
প্রাতঃকালে দুই দলে করিল সাজন।।
রথী মহারথী আর যত সৈন্যগণ।
আশোয়ার পদাতিক না হয় গণন।।
ধ্বজচ্ছত্র-পতাকায় ছাইল মেদিনী।
সৈন্য কোলাহল শব্দে শ্রবণে না শুনি।।
বিবিধ বাদ্যের শব্দে পূরিল অম্বর।
শঙ্খ ভেরী মৃদঙ্গাদি পটহ বিস্তর।।
ভেরী ঝাঝরি আদি বাজে বাদ্যগণ।
বাদ্যের শব্দেতে কম্প হৈল ত্রিভুবন।।
ছয় কোটি নারায়ণী সেনা বলবান।
লক্ষ পদ্ম রথী সাজে প্রধান প্রধান।।
দশ কোটি মহারথী সমরে প্রখর।
লক্ষ পদ্ম মল্ল সাজে মহাবলধর।।
রথী প্রতি সাজে পঞ্চ শতেক পদাতি।
শত শত আশোয়ার শত শত হাতী।।
এক এক রথী সঙ্গে ইহার দ্বিগুণ।
সাজিল যতেক সৈন্য না হয় বর্ণন।।
কনক রচিত রথ ধ্বজ মনোহর।
সাজিল কৌরব-সৈন্য সমুদ্র সোসর।।
সৈন্যের পদের ভরে কাঁপিছে মেদিনী।
হস্তী-অশ্ব গর্জ্জনে বিপুল শব্দ শুনি।।
তবে ভীষ্ম মহাবীর আনন্দিত মন।
কনক রচিত রথে কৈল আরোহণ।।
সারি সারি শ্বেতচ্ছত্র মস্তকে উদিত।
মহারথীগণ হৈল চৌদিকে বেষ্টিত।।
স্বর্ণধ্বজ রথে আরোহিল গুরু দ্রোণ।
চক্রবক্র অশ্বত্থামা প্রতীপ-নন্দন।।
গজ-রথ আরোহণ কৈল দুর্য্যোধন।
চক্রবৎ বেষ্টিত দুপাশে ভ্রাতৃগণ।।
যাহার যে রথে আরোহিল কুরুগণ।
রচিল বিচিত্র ব্যূহ গঙ্গার নন্দন।।
অর্দ্ধচন্দ্রাকার ব্যূহ বড়ই দুষ্কর।
স্থানে স্থানে বুঝিয়া রাখিল যোদ্ধাবর।।
মধ্যেতে রাখিল দুর্য্যোধন নরপতি।
দুঃশাসন আর ভ্রাতৃগণের সংহতি।।
বামশৃঙ্গে দ্রোণ গুরু সংগ্রামে দুর্জ্জয়।
অশ্বত্থামা সোমদত্ত প্রতাপ-তনয়।।
দক্ষিণ শৃঙ্গেতে রৈল কৃতবর্ম্মা বীর।
জয়দ্রথ সুশর্ম্মাদি সংগ্রামে সুধীর।।
মধ্য শৃঙ্গে ভগদত্ত আদি রাজগণ।
রাজরাজেশ্বরগণ সংহতি ভিড়ন।।
কৃপাচার্য্য ভূরিশ্রবা ত্রিগর্ত্ত নৃপতি।
পুণ্ডরীক প্রতিবৃদ্ধ আদি মহামতি।।
দুই পাশে ভীষ্মের রহিল রাজগণ।
ব্যূহ-অগ্রে রহে ভীষ্ম গঙ্গার নন্দন।।
এইরূপে ব্যূহ কৈল না যায় বর্ণন।
যার যেই অস্ত্র হাতে রহে সৈন্যগণ।।
ব্যূহ কথা শুনিলেন ধর্ম্ম নরপতি।
অর্জ্জুনেরে ডাকি আজ্ঞা দিল শীঘ্রগতি।।
যেন ব্যূহকরিলেন গঙ্গার নন্দন।
ততোধিক ব্যূহ পার্থ করহ রচন।।
স্থানে স্থানে নিয়োজিত কর যোধগন।
এমত করিহ ব্যূহ না হয় বর্ণন।।
যথা আছে দ্রোণ গুরু পুত্রের সহিত।
ধৃষ্টদ্যুম্ন আদি যত কৈল নিয়োজিত।।
যথা আছে দুর্য্যোধন ভাইয়ের সংহতি।
তথা নিয়োজিত কৈল সব মহারথী।।
সহদেব নকুলাদি যত বীরগণ।
ভীম পৃষ্ঠ ভাগেতে রহিল সর্ব্বজন।।
যথা কৃতবর্ম্মাবীর সমরে দুর্জ্জয়।
তথা নিয়োজিত কৈল শিনির তনয়।।
জয়সেন আদি সঙ্গে দিল বীরগণ।
এইরূপে নিয়োজিল যত যোদ্ধাগণ।।
স্থানে স্থানে গুণী রাখে দৃঢ়ঘাতিগণ।
ব্যূহমুখে বুঝিয়া করিল নিয়োজন।।
শুক-চঞ্চু নামে ব্যূহ ভুবনে দুর্জ্জয়।
অগ্রেতে রহিল পার্থ সমরে নির্ভয়।।
কপিধ্বজ রথখান ভুবনে বিখ্যাত।
যেই রথে সারথি আপনি জগন্নাথ।।
ইন্দ্রের নন্দন বীর রূপেতে মদন।
বিচিত্র কিরীট শোভে অতি সুশোভন।।
বিচিত্র কবচ অঙ্গে জিনি সূর্য্য-শোভা।
ইন্দ্রদত্ত-কুণ্ডলাদি অতি মনোলোভা।।
অগ্নিদত্ত গাণ্ডীব ধনুক বাম করে।
অক্ষয় যুগল তূণ পূর্ণ অস্ত্রবরে।।
মহাবীর্য্যবন্ত বার ভুবনে খেয়াতি।
গাণ্ডীব ধনুকে গুণ দিলে শীঘ্রগতি।।
আকর্ণ পূরিয়া দিল ধনুকে টঙ্কার।
এক কালে যেন শত বজ্রের প্রহার।।
প্রলয়ের মেঘ যেন করিল গর্জ্জন।
শব্দেতে পূরিল ক্ষিতি বধির শ্রবণ।।
তবে দেবদত্ত শঙ্খ পূরিল অর্জ্জুন।
পাঞ্চজন্য শঙ্খ বাদ্য করে নারায়ণ।।
তবে ভীষ্ম মহাবীর গঙ্গার নন্দন।
আকর্ণ পূরিয়া টঙ্কারিল ধনুর্গুণ।।
সপ্তকুম্ভ নামে শঙ্খ করিল নিঃস্বন।
বাজাইল শঙ্খ সব কুরু-পাণ্ডুগণ।।
কোটি কোটি শঙ্খনাদ ধনুক টঙ্কার।
পৃথ্বী মজাইতে যেন মেঘের সঞ্চার।।
নানাবিধ বাদ্য বাজে না হয় লিখন।
মহাশব্দে অস্থির হইল দেবগণ।।
মহাভারতের কথা অমৃত-লহরী।
শুনিলে অধর্ম্ম খণ্ডে হেলে ভব তরি।।
কাশীরাম দাস কহে রচিয়া পয়ার।
অবহেলে শুনে যেন সকল সংসার।।