০৭. শিখণ্ডীর পূর্ব্বজন্ম বৃত্তান্ত

জিজ্ঞাসিল জন্মেজয় করিয়া বিনয়।
কি কহিলা শুনি তবে অম্বিকা-তনয়।।
তবে পুনঃ সঞ্জয়েরে জিজ্ঞাসে রাজন।
কি করিল কহ শুনি পুত্র দুর্য্যোধন।।
সঞ্জয় বলিল, রাজা শুন একমনে।
শিবিরে আসিয়া যুক্তি কৈল দুর্য্যোধনে।।
দুর্য্যোধন দুঃশাসন গান্ধার নন্দন।
তিন জনে মিলি গেলা ভীষ্মের সদন।।
পুনরপি ভীষ্মেরে বলয়ে দুর্য্যোধন।
অবধান নিবেদিয়ে গঙ্গার নন্দন।।
পূর্ব্বেতে আমার অগ্রে কৈলে অঙ্গীকার।
পাণ্ডবে জিনিয়া মোরে দিবে রাজ্যভার।।
স্নেহেতে না মার তুমি পাণ্ডুর কুমার।
তব বাক্য ব্যর্থ হৈল কি বলিব আর।।
আগে যদি করিতাম কর্ণে সেনাপতি।
দৃষ্টিমাত্রে পাণ্ডবে মারিত মহামতি।।
এইরূপ দুর্য্যোধন কহিল বচন।
শুনিয়া হইল ক্রোধ গঙ্গার-নন্দন।।
দুর্য্যোধনে চাহি তবে বলিল বচন।
স্থিরহও দুর্য্যোধন না কর শোচন।।
যে প্রতিজ্ঞা কৈনু আমি তোমার গোচরে।
কালি পাণ্ডু পুত্রেরে পাঠাব যমঘরে।।
সোমক পাঞ্চাল আদি যত বীরচয়।
কালি প্রাতে মোর হাতে যাবে যমালয়।।
এক যুক্তি কহি আমি শুন দুর্য্যোধন।
প্রকারেতে শিখণ্ডীর করিতে নিধন।।
অমঙ্গল দুরাচার সেই ত অধম।
তাহা দেখি সিন্ধ নয় আমার বিক্রম।।
পূর্ব্বেতে প্রতিজ্ঞা মোর জানে সর্ব্বজন।
অমঙ্গল দেখি অতি তেয়াগিনু রণ।।
দৈবের নির্ব্বন্ধ আছে জানে সর্ব্বজন।
শিখণ্ডীর হাতে আমি হইব নিধন।।
পূর্ব্বজন্মে ভজি নাই আমি দুরাচারে।
আমারে ভজিব হেন আছিল বিচারে।।
বিভা না করিব আমি প্রতিজ্ঞা আমার।
তেকারণে আইল পাপিনী দুরাচার।।
তার হেতু গুরু সনে হৈল মহারণ।
প্রকারে শিখণ্ডী তুমি করহ নিধন।।
এত শুনি দুর্য্যোধন বিস্ময় হৃদয়ে।
পুনঃ জিজ্ঞাসিল করযোড়ে পিতামহে।।
কহ শুনি পিতামহ পূর্ব্বের কাহিনী।
পূর্ব্বেতে শিখণ্ডী ছিল কাহার নন্দিনী।।
শিখণ্ডী তোমার বৈরী ছিল কি কারণ।
কি কারণে গরু সনে কৈলে তুমি রণ।।
ভীষ্ম বলে রহস্য শুনহ দুর্য্যোধন।
বিচিত্রবীর্য্যের পূর্ব্বে বিবাহ কারণ।।
দ্বিজগণ মুখে আমি শুনিনু কাহিনী।
পরমা সুন্দরী আছে কাশীর নন্দিনী।।
একাধিক কন্যকা আছয়ে তিন জন।
শুনি কাশীপুরে আমি করিনু গমন।।
স্বয়ম্বর আরম্ভিয়া ছিল কাশীশ্বর।
স্বয়ম্বর হৈতে কন্যা করিনু সত্বর।।
তিন কন্যা রথেতে তুলিনু সব্য হাতে।
অনেক হইল যুদ্ধ শাল্বের সহিতে।।
সংগ্রামেতে শাল্বেরে করিনু পরাজয়।
কন্যাগণে লৈয়া আইনু আপন আলয়।।
অম্বী অম্বা অম্বালিকা আদি তিনজন।
বিবাহ আরম্ভ হেতু জানি শুভক্ষণ।।
রত্নবেদী মধ্যে বসাইনু তিনজন।
হেনকালে অম্বী তবে বলিল বচন।।
ইচ্ছা-বরী হৈয়া আমি বরিনু শাল্বেরে।
জানিয়া আমার বিভা দেহ অনুসারে।।
এতেক শুনিয়া ত্যাগ করিনু তাহারে।
দুই কন্যা বিভা আমি দিনু অনুজেরে।।
অম্বা অম্বালিকা দুই কাশীর নন্দিনী।
পরমা সুন্দরী রূপে ইন্দ্রের ইন্দ্রাণী।।
জ্যেষ্ঠ কন্যা অম্বী যবে করিনু বর্জ্জন।
সত্বর চলিল কন্যা শাল্বের সদন।।
অনেক প্রকারে তবে কহিল শাল্বেরে।
ইচ্ছাসুখে তোমারে করিব স্বয়ম্বরে।।
অবিচার করি দুষ্ট গঙ্গার-নন্দন।
স্বয়ম্বর হৈতে মোরে করিল হরণ।।
এই বিবরণ কহি সভার ভিতরে।
তেকারণে ত্যাগ দুষ্ট করিল আমারে।।
তোমা ভিন্ন রাজা মোর অন্যে নাহি মন।
জানিয়া আমারে রাজা করহ গ্রহণ।।
এত শুনি শাল্ব চিত্তে কৈল নিরূপণ।
বিচার করিয়া তারে না কৈল গ্রহণ।।
পুনরপি কন্যা তবে আইল মোর ঘরে।
কহিল আমারে কন্যা অনেক প্রকারে।।
সর্ব্ব ধর্ম্ম জ্ঞাত তুমি গঙ্গার কুমার।
হাতে ধরি তুলি নিলে রথের উপর।।
পূর্ব্বাপার আছে হেন শাস্ত্রের বচন।
স্বয়ম্বরা কন্যা যেই করয়ে গ্রহণ।।
সেই তার পতি হয় বেদের বিচার।
অন্যপরে তাহার নাহিক অধিকার।।
জানিয়া শুনিয়া বিভা না কৈলে আমারে।
নারীহত্যা ভার দিব তোমার উপরে।।
আমিও কহিনু তারে শুনহ পাপিনি।
পূর্ব্বের প্রতিজ্ঞা মোর জানহ কাহিনী।।
পিতার বিবাহ হেতু কৈনু অঙ্গীকার।
বিভা না করিব সত্য বচন আমার।।
তাহা শুনি কন্যা তবে করয়ে রোদন।
অরণ্যের মধ্যে প্রবেশিল ততক্ষণ।।
একাকী অরণ্য মধ্যে করয়ে রোদন।
হেনকালে নারদের সঙ্গে দরশন।।
ব্যাকুল হইয়া তবে কহে মহামুনি।
কি কারণে কান্দ কন্যা কহত কাহিনী।।
এত শুনি কহে কন্যা যুড়ি দুই কর।
অবধান নিবেদন শুন মুনিবর।।
অবিহিত কৈল দুষ্ট গঙ্গার নন্দন।
স্বয়ম্বরে ধরি মোরে না কৈল গ্রহণ।।
শরীর ত্যজিব আমি করি অনাহার।
মোর প্রতি কেন তার এত অবিচার।।
এত শুনি হৃদয়ে ভাবিল তপোধন।
কন্যারে চাহিয়া কহে মধুর বচন।।
না ত্যজহ প্রাণ কহি করিয়া প্রকার।
শীঘ্রগতি যাহ যথা ভৃগুর কুমার।।
তাঁর প্রিয় শিষ্য হয়গঙ্গার নন্দন।
বহুবিধ মতে তাঁরে করিবে স্তবন।।
প্রসন্ন করিয়া তবে সাধিবে ভীষ্মেরে।
তাঁহার বচন ভীষ্ম খণ্ডাইতে নারে।।
গুরু আজ্ঞা ভীষ্ম নাহি করিবে হেলন।
স্বধর্ম্ম রাখিয়া তোমা করিবে গ্রহণ।।
এত বলি অন্তর্দ্ধান হৈল তপোধন।
শীঘ্রগতি গেল কন্যা ভার্গব সদন।।
অনেক প্রকারে স্তব করিল মুনিরে।
তুষ্ট হৈয়া বর তারে যাচে ভৃগুবরে।।
তোমার স্তবেতে কন্যা তুষ্ট হৈনু আমি।
যেই বর ইচ্ছা কন্যা মাগি লহ তুমি।।
এত শুনি কহে কন্যা যুড়ি দুই কর।
আমার বাঞ্ছিত দেব শুনহ উত্তর।।
তব প্রিয় শিষ্য হয় গঙ্গার নন্দন।
স্বয়ম্বরে হরি মোরে না কৈল গ্রহণ।।
এত শুনি কন্যাসহ ভৃগুর নন্দন।
শীঘ্রগতি আইলা চলি আমার সদন।।
গুরু দেখি আমি প্রণমিনু করযোড়ে।
পাদ্য অর্ঘ্য দিয়া তবে পূজিনু বিস্তরে।।
তবে ভৃগুবর মোরে বলিল বচন।
এই কন্যা কেন তুমি না কর গ্রহণ।।
স্বয়ম্বর হৈতে কন্যা করিয়া গ্রহণ।
হরিয়া আনিলে ত্যাগ কর কি কারণ।।
নারীবধ পাপ ভীষ্ম লাগে পরিণামে।
এইরূপ বহু মোরে কৈল গুরু রামে।।
হৃদয়ে চিন্তিয়া তাঁরে দিলাম উত্তর।
পূর্ব্বের প্রতিজ্ঞা মোর জান গুরুবর।।
জনকের বিভা হেতু কৈনু অঙ্গীকার।
বিবাহ না করি আমি, না লই রাজ্যভার।।
ক্ষত্রিয় প্রতিজ্ঞা কভু না করিলে নয়।
ধর্ম্মাধর্ম্ম সব নাথ গোচর তোমায়।।
জানিয়া কারণ হেন কহ মতিমান্।
তুমি হেন বল দেব কি কহিব আন।।
এত শুনি পুনরপি বলে ভৃগুবর।
নাহিক ইহাতে দোষ গুন গুরুতর।।
আমার বচন শুন না কর খণ্ডন।
সর্ব্ব ধর্ম্ম জানি ইহায় করহ গ্রহণ।।
আমি কহিলাম দেব নহে কদাচন।
এত শুনি ক্রোধ কৈল ভৃগুর নন্দন।।
গুরু বাক্য নাহি নিলি তুই দুরাচার।
এই দোষে তোরে আমি করিব সংহার।।
ইচ্ছামৃত্যু এইমাত্র ধর অহঙ্কার।
আমার ক্রোধেতে কারে নাহিক নিস্তার।।
যুদ্ধ দেহ মোর সঙ্গে শুন দুষ্টমতি।
এত শুনি বাহির হইনু শীঘ্রগতি।।
নানা অস্ত্র লয়ে দোঁহে প্রবেশিনু রণে।
ক্ষান্ত নহে দোঁহে হৈল বাণ বরিষণে।।
যত অস্ত্র মারে গুরু কৈনু খণ্ড খণ্ড।
ক্রোধেতে এড়িল তবে বাণ যমদণ্ড।।
আকাশে উঠিল অস্ত্র দেখি ভয়ঙ্কর।
বিষম দুর্জ্জয় বাণ আইসে তৎপর।।
বশিষ্ঠের দত্ত বাণ মোর তুণে ছিল।
সেই বাণাঘাতে বাণ দুইখান হৈল।।
অস্ত্র ব্যর্থ গেল ক্রোধ হৈল ভৃগুবর।
ক্রোধেতে কম্পিত অঙ্গ কাঁপে থর থর।।
শক্তি ফেলি মারিলেক আমার উপর।
দিব্য অস্ত্র দিয়া কাটি ফেলিনু সত্বর।।
উন্মত্ত কুঠার লয়ে আইসে মারিবারে।
উপনীত হৈল গিয়া মোর বরাবরে।।
বশিষ্ঠের শিক্ষা অস্ত্র নাম ব্রহ্মশির।
তাহাতে জর্জ্জর কৈনু ভৃগুর শরীর।।
আর জন্মে ভীষ্মে আমি করিব নিধন।
এত বলি কন্যা কৈল অরণ্যে গমন।।
চিন্তা করি কাষ্ঠ দিয়া জ্বালিল অনল।
শাপ দিল মোর তরে হাতে করি জল।।
আমার বচন কভু না যায় খণ্ডন।
দ্রুপদের গৃহে আসি লইল জনম।।
সেই কন্যা দেখহ শিখণ্ডী দুরাচার।
প্রকারে তাহারে তুমি করহ সংহার।।
তাহারে মারিলে জয় হইবে তোমার।
নাহিক সংশয় শুন বচন আমার।।
দুর্য্যোধন বলে এই কোন্ চিত্রকথা।
কালি যুদ্ধে মারিব শিখণ্ডী মহারথা।।
দুঃশাসন মহাবীর মোর সহোদর।
শিখণ্ডীরে মারিতে তাহার হৈল ভার।।
মহাভারতের কথা অমৃত-লহরী।
শুনিলে অধর্ম্ম খণ্ডে হেলে ভবতরি।।
মস্তকে বন্দিয়া ব্রাহ্মণের পদদ্বন্দ্ব।
কাশীরাম দাস কহে পয়ার প্রবন্ধ।।