০৫৬. বিচিত্রবীর্য্যের মৃত্যু ও ধৃতরাষ্ট্রাদির উৎপত্তি

সত্যবতী লভি রাজা আনন্দিত মনে।
অনুক্ষণ ক্রীড়া করে সত্যবতী সনে।।
তবে কত দিনে রাজ্ঞী হৈল গর্ভবতী।
দশ মাসে প্রসব হইল সত্যবতী।।
পরম সুন্দর পুত্র, মুখ কোকনদ।
সুন্দর দেখিয়া নাম রাখে চিত্রাঙ্গদ।।
তার কত দিনেতে দ্বিতীয় পুত্র হৈল।
বিচিত্রবীর্য্য বলিয়া তবে নাম থুইল।।
সত্যবতী-গর্ভে হৈল যুগল-কুমার।
পরম সুন্দর যেন কাম-অবতার।।
কত দিন অন্তরে শান্তনু নৃপবর।
ত্যজিলেন অক্লেশে ভৌতিক কলেবর।।
রাজার মরণে দুঃখী হৈল সর্ব্বজন।
ভীষ্ম সত্যবতী হৈল শোকাকুল মন।।
অনাথ হৈল পুত্র দোঁহা পিতৃ বিহনে।
আপনি দোঁহারে ভীষ্ম পালেন যতনে।।
চিত্রাঙ্গদ উপরে ধরিল ছত্রদণ্ড।
আপনি পালেন ভীষ্ম মহারাজ্য-খণ্ড।।
কত দিনে চিত্রাঙ্গদা হইল যুবক।
মহা-ধনুর্দ্ধর হৈল প্রতাপে পাবক।।
আপন সদৃশ কেহ না দেখে নয়নে।
এক রথে চড়ি বীর সবাকারে জিনে।।
দেবতা গন্ধর্ব্ব যক্ষ দৈত্য নর নাগে।
হেন জন নাহি, যুঝে চিত্রাঙ্গদ-আগে।।
হেনমতে এক রথে জিনিল সকল।
এক রথে ভ্রমে বীর পৃথিবী-মণ্ডল।।
চিত্ররথ নামে এক গন্ধবর্ব-ঈশ্বর।
কুরুক্ষেত্রে তাহারে ভেটিল নরবর।।
সরস্বতী-নদী-তীরে হইল সমর।
বর্ষত্রয়-ব্যাপী যুদ্ধ হৈল ঘোরতর।।
মায়াবী গন্ধর্ব্ব শেষে নিজ মায়াবলে।
চিত্রাঙ্গদে মারি গেল গগন-মণ্ডলে।।
চিত্রাঙ্গদ-বধ বার্ত্তা রটিল নগরে।
ধরিল বিচিত্রবীর্য্য রাজছত্র শিরে।।
তাঁর বিভা হেতু ভীষ্ম চিন্তে নিরন্তর।
শুনে কাশীরাজ করে কন্যা-স্বয়ন্বর।।
একেবারে তিন কন্যা করে স্বয়ম্বর।
এ কথা হইল সব রাজার গোচর।।
স্বয়ম্বর শুনি ভীষ্ম চলিল ত্বরিত।
একা রথে কাশীধামে হৈল উপনীত।।
দেখিল অনেক রাজা আছে সয়ম্বরে।
রাজ-রাজেশ্বর যত পৃথিবী-উপরে।।
হেনকালে বলে ভীষ্ম সভার ভিতর।
আমার বচন শুন কাশীর ঈশ্বর।।
আমার অনুজ আছে শান্তনু-নন্দন।
তার হেতু তব কন্যা করিনু বরণ।।
এত বলি তিন কন্যা রথে চড়াইল।
পুনরপি রাজগণে ডাকিয়া বলিল।।
স্বয়ম্বর হৈতে কন্যা বলে যাই লৈয়া।
যার শক্তি থাকে যুদ্ধ করহ আসিয়া।।
ভীষ্মের বচন শুনি যত রাজগণ।
নানা অস্ত্র লয়ে সবেধায় ততক্ষণ।।
মাতঙ্গে তুরঙ্গে কেহ, কেহ চড়ি রথে।
শতপুর করিয়া বেড়িল চারিভিতে।।
শেল শূল জাঠা শক্তি মুষল মুদগর।
নানাবিধ অস্ত্র ফেলে ভীষ্মের উপর।।
মুহূর্ত্তেকে হৈল সব অন্ধকার-ময়।
না দেখি যে ভীষ্ম বীর আছয়ে কোথায়।।
ক্ষিপ্রহস্ত ভীষ্ম বীর গঙ্গার কোঙর।
বশিষ্ঠ-মুনির শিক্ষা, যমের দোসর।।
শরজালে আপনারে করে আচ্ছাদন।
শরে শরে সব অস্ত্র করিল ছেদন।।
কাটিয়া সকল অস্ত্র গঙ্গার কুমার।
নিজ অস্ত্রে রাজগণে করিল প্রহার।।
কাটিল কাহার মুণ্ড কুণ্ডল সহিত।
শ্রবণ কাটিল কারো, দেখি বিপরীত।।
শরীর ত্যজিল কেহ ভূমিতলে পড়ি।
রত্ন-অলঙ্কার সব যায় গড়াগড়ি।।
বাম-হস্ত সহিত ধনুক ফেলে কাটি।
বুকেতে বাজিল কারো, করে ছটফটি।।
পড়িল সকল সৈন্য পৃথিবী আচ্ছাদি।
করিল গঙ্গার পুত্র ক্ষণে রক্তনদী।।
বিমুখ হইল, কেহ না রহে সম্মুখে।
ধন্য ধন্য ভীষ্ম বলি রাজগণ ডাকে।।
ভঙ্গ দিয়া পলাইল যত রাজগণ।
চলিল আপন দেশে শান্তনু-নন্দন।।
কন্যা লৈয়া যায় ভীষ্ম, শাল্বরাজা দেখে।
তিষ্ঠ তিষ্ঠ বলি ভীষ্মে পুনঃপুনঃ ডাকে।।
হস্তিনী কারণে যেন ক্রোধে হস্তিবর।
ধাইয়া আইল তেন শাল্ব নৃপবর।।
ক্রোধেতে আকর্ণ পূরি মহা-ধনুর্দ্ধর।
দিব্য অস্ত্র প্রহারিল ভীষ্মের উপর।।
নেউটিয়া ভীষ্ম বীর নিল শরাসন।
শাল্ব ভীষ্ম দুই জনে হৈল মহারণ।।
দুই সিংহে যুঝে যেন পর্ব্বত উপর।
দুই বৃষ যুঝে যেন গোষ্ঠের ভিতর।।
ক্রোধেতে নির্ধূম-অগ্নি যেন ভীষ্ম বীর।
দুই বাণে কাটে তর সারথির শির।।
চারি অশ্ব কাটিয়া কাটিল রথধ্বজ।
ধনুক কাটিল তার গঙ্গার অঙ্গজ।।
অশ্ব রথ সারথি ধনুক গেল কাট।
পলাইয়া যায় শাল্ব ভূমে বহি বাট।।
কাতর দেখিয়া তারে দিল প্রাণদান।
না মারিল অস্ত্র আর গঙ্গার সন্তান।।
সংগ্রামে জিনিয়া তবে চলে মতিমান।
কন্যা লৈয়া নিজ দেশে করিল পয়ান।।
আনন্দিত সব লোক হস্তিনা-পুরের।
বিবাহ উদ্যোগ কৈল বিচিত্রবীর্য্যের।।
পুরোহিত আনিয়া করিল শুভক্ষণ।
আইল যতেক দ্বিজ বিবাহ কারণ।।
বরের নিকটে তিনি কন্যা বসাইল।
অম্বা নামে জ্যেষ্ঠা কন্যা তখন কহিল।।
সর্ব্বশাস্ত্রে বিজ্ঞ তুমি শান্তনু-নন্দন।
তোমারে করি যে আমি এক নিবেদন।।
সভামধ্যে দেখিয়া সকল রাজগণে।
শাল্বেরে বরিতে আমি করিয়াছি মনে।।
পিতার সম্মতি আছে দিবেন শাল্বেরে।
আমার বিবাহ দেহ আনিয়া তাহারে।।
ব্রাহ্মাণ-সভাতে কন্যা এতেক কহিল।
বিচার করিয়া ভীষ্ম তাহারে ত্যজিল।।
পুনর্ব্বার গেল কন্যা শাল্ব রাজস্থান।
শাল্বরাজ বলে তোরে না করি গ্রহণ।।
কান্দিয়া ভীষ্মের স্থানে পুনঃ সে আইল।
তুমি বলে নিলে তেঁই শাল্ব তেয়াগিল।।
তবে ভীষ্ম বলে তুমি বড় দুরাচার।
পুনঃ না লইব তোরে ধর্ম্মের বিচার।।
এত শুনি হৈল কন্যা পরম দুঃখিত।
সেইকালে অগ্নিকুণ্ড করিল ত্বরিত।।
অগ্নি প্রদক্ষিণ করি করিল প্রবেশ।
ভীষ্মের বধের হেতু কামনা বিশেষ।।
অম্বিকা ও অম্বালিকা যুগল সুন্দরী।
রূপেতে দোঁহার নিন্দে স্বর্গবিদ্যাধরী।।
বিচিত্রবীর্য্যেরে দুই কন্যা বিভা দিল।
শচী তিলোত্তমা যেন দেবেন্দ্র পাইল।।
সহজে বিচিত্রবীর্য্য নবীন বয়েস।
যুগল কন্যার সহ শৃঙ্গার বিশেষ।।
অল্পকালে যক্ষ্মাকাশ তাহার ঘটিল।
অনেক উপায় ভীষ্ম তাহার করিল।।
বহু যত্ন করি রক্ষা নারিল করিতে।
মরিল বিচিত্রবীর্য্য পুত্র না জন্মিতে।।
শোকেতে আকুল হৈল যত বধূগণ।
বধূসহ সত্যবতী করেন ক্রন্দন।।
অগ্নিহোত্র মধ্যেতে করিল প্রেতকর্ম্ম।
যেন পুর্ব্বাপর আছে ক্ষত্রিয়ের ধর্ম্ম।।
তবে সত্যবতী আনি গঙ্গার নন্দনে।
কহিতে লাগিল তাঁরে করিয়া ক্রন্দনে।।
কুরুকুল মহাবংশ পৃথিবী-ঈশ্বর।
এ বংশ ধরিতে পুত্র তুমি একেশ্বর।।
রাজা হৈয়া রাজ্য রাখ পাল প্রজাগণ।
পুত্র জন্মাইয়া কর বংশের রক্ষণ।।
কুরুকুল অস্ত যায় করহ তারণ।
তোমা বিনা রক্ষা-হেতু নহে অন্যজন।।
নরক হইতে উদ্ধারহ পিতৃগণে।
সর্ব্বশাস্ত্রে ধর্ম্ম বাপু জানহ আপনে।।
অপুত্রক তব ভাই হইল নিধন।
অপুএক আছে তব ভ্রাতৃ-বধূগণ।।
অবিরোধ-ধর্ম্ম বাপু আছে পূর্ব্বাপর।
পুত্র জন্মাইয়া কর বংশের উদ্ধার।।
এতেক শুনিয়া তবে শান্তনু-নন্দন।
বেদের সদৃশ মাতা তোমার বচন।।
আমার প্রতিজ্ঞা মাতা জানহ আপনে।
অঙ্গীকার করিলাম তোমার কারণে।।
ত্রিভুবনে কেহ যদি দেয় অধিকার।
তথাপি না লব রাজ্য, সত্য অঙ্গীকার।।
যাবৎ শরীরে মোর আছয়ে পরাণ।
না ছুঁইব রামা, সত্য নহে মোর আন।।
দিনকর ত্যজে তেজ, চন্দ্র শীত ত্যজে।
ধর্ম্ম সত্য ত্যজে, পরাক্রম দেবরাজে।।
ত্যজিবারে পারয়ে এ সব কদাচন।
তবু সত্য নাহি ত্যজে গঙ্গার নন্দন।।
সত্যবতী বলে, পুত্র আমি সব জানি।
তোমার মহিমা গুণ কহে সুর মুনি।।
আমার বিবাহে যে করিলা অঙ্গীকার।
সকল জানি যে আমি প্রতিজ্ঞা তোমার।।
তথাপি বিপদে ত্রাণ কর কোনমতে।
আপনি উপায় কর কুল-ধর্ম্ম-হিতে।।
বিপদে দেবতা পুছে বৃহস্পতি-স্থানে।
দৈত্যগণ যুক্তি পুছে ভৃগুর নন্দনে।।
তোমা বিনা আমি জিজ্ঞাসিব কার কাছে।
যেমত জানহ কর, যাহে বংশ বাঁচে।।
বেদ-বিধি-ধর্ম্ম পুত্র তোমাতে গোচর।
অবিরোধে ধর্ম্ম পুত্র বংশ রক্ষা কর।।
এত বলি সত্যবতী করেন ক্রন্দন।
নিবর্ত্তিয়া পুনঃ বলে গঙ্গার নন্দন।।
ক্ষত্র হৈয়া যেই জন প্রতিজ্ঞা না পালে।
অপযশ ঘোষে তার এ মহীমণ্ডলে।।
কুরুবংশ-রক্ষা হেতু করিব বিধান।
পূর্ব্বাপর আছে কহি কর অবধান।।
জমদগ্নি-সুত রাম পিতার কারণে।
দশ-শত-ভুজ-ধর মারিল অর্জ্জুনে।।
প্রতিজ্ঞা করিয়া ক্ষত্র করিল সংহার।
নিঃক্ষত্রা করিল ক্ষিতি তিন-সপ্ত-বার।।
ক্ষত্র আর না রহিল পৃথিবী-ভিতরে।
ক্ষত্র-নারী-গণ প্রবেশিল বিপ্র-ঘরে।।
বেদেতে পারগ যেই পবিত্র ব্রাহ্মণ।
তাহার ঔরসে বংশ করিল রক্ষণ।।
বেদবিধি দ্বিজগণ ধর্ম্মেতে বুঝিয়া।
বৃদ্ধি কৈল ক্ষত্রকুল পুত্রদান দিয়া।।
ক্ষত্রক্ষেত্রে জন্ম হৈল ব্রাহ্মণ-ঔরসে।
যার ক্ষেত্র তার পুত্র সবে হেন ভাষে।।
বিপ্র হৈতে ক্ষত্র জন্ম আছে পূর্ব্বাপর।
অদূষিত কর্ম্ম এই ধর্ম্মের উত্তর।।
আর পূর্ব্বকথা মাতা কহি যে তোমারে।
উতথ্য নামেতে ঋষি বিখ্যাত সংসারে।।
তাঁহার কনিষ্ঠ দেব-গুরু বৃহস্পতি।
মমতা নামেতে কন্যা উতথ্য যুবতী।।
কামেতে পীড়িত হৈয়া ধরে বৃহস্পতি।
মমতা ডাকিয়া বলে বৃহস্পতি প্রতি।।
ক্ষমা কর এই নহে রমণ সময়।
মম গর্ভে আছে তব ভ্রাতার তনয়।।
অক্ষয় তোমার বীর্য্য হইবে সন্তুতি।
দুই পুত্র ধরিবারে নাহিক শকতি।।
নিবৃত্ত নিবৃত্ত তুমি নহে সুবিচার।
পরম পণ্ডিত আছে গর্ভেতে আমার।।
গর্ভেতে ষড়ঙ্গ বেদ করে অধ্যয়ন।
নিবর্ত্তহ বৃহস্পতি বুঝিয়া কারণ।।
কামেতে পীড়িত গুরু না করি বিচার।
নিষেধ না শুনি তারে করিল শৃঙ্গার।।
উতথ্য-নন্দন যেই গর্ভেতে আছিল।
বৃহস্পতি প্রতি সেই ডাকিয়া বলিল।।
অনুচিত কর্ম্ম তাত কর কি বিধান।
তব বীর্য্য রহিবারে নাহি তথা স্থান।।
সর্ঙ্কীর্ণ এ স্থল আমি আছি পূর্ব্ব হৈতে।
মোর পীড়া হইবেক তোমার বীর্য্যেতে।।
না শুনিল বৃহস্পতি তাহার বচন।
কামেতে হইয়া মত্ত করিল রমণ।।
এতেক দেখিয়া তবে উতথ্য-কুমার।
যুগল চরণে রুদ্ধ কৈল রেতদ্বার।।
পড়িল জীবের বীর্য্য না পাইয়া স্থল।
দেখি ক্রোধে হৈল গুরু জ্বলন্ত অনল।।
মম বীর্য্য ঠেলিয়া ফেলিলি ভূমিতলে।
দিনু শাপ হও অন্ধ নয়ন যুগলে।।
অন্ধ হইয়া জন্ম হইল উতথ্য-নন্দন।
সৌভরি বংশেতে তেঁহ কৈল অধ্যয়ন।।
গোধর্ম্ম পঠন কৈল গরুর আচার।
ধর্ম্মাধর্ম্ম নাহি মানে, না করে বিচার।।
তার কর্ম্ম দেখিয়া যতেক ঋষিগণ।
ধিক্কার করিয়া সবে বলিল বচন।।
নিকটে বসতি যোগ্য নহে দুরাচার।
ধর্ম্মাধর্ম্ম কোন জ্ঞান নাহিক ইহার।।
এত বলি মুনিগণ উতথ্য-নন্দনে।
সবে হতাদর করে কেহ নাহি মানে।।
পত্নীর বিরাগ-পাত্র ক্রমে দ্বিজবর।
প্রদ্বেষী নাম্নী পত্নী না করে সমাদর।।
সেবা ভক্তি নাহিকরে নাহি শুনে কথা।
অনাদর-করে সদা মর্ম্মে দেয় ব্যথা।।
তাহা দেখি দীর্ঘতমা জিজ্ঞাসে কারণ।
কিসের লাগিয়া মোরে কর অযতন।।
প্রদ্বেষী কহিল, দেখ বিচারিয়া মনে।
স্বামী যে ভার্য্যার ভর্ত্তা ভরণ পোষণে।।
জন্মান্ধ হইয়া তুমি জগতে জন্মিলে।
ভরণ-পোষণ মম কিছু না করিলে।।
পত্নীর বচনে ক্রুদ্ধ হয়ে দ্বিজবর।
প্রদ্বেষী সম্ভাষি তবে কহে অতঃপর।।
দিতেছি বিপুল অর্থ করহ গ্রহণ।
পুনশ্চ না কহ হেন পরুষ বচন।।
আর এই শাপ আমি অর্পিলাম তোরে।
ক্ষত্রকুলে জন্ম হবে অর্থলিপ্সা তরে।।
এত কহি দীর্ঘতমা বলেন বচন।
অদ্যাবধি এই বিধি করিনু স্থাপন।।
নারীজাতি জীবিত থাকিবে যতদিন।
ততদিন হয়ে রবে পতির অধীন।।
পতিবাক্যে অবহেলা কভু না করিবে।
প্রাণপণে পতি-প্রিয় কার্য্য আচরিবে।
জীবিত থাকিতে পতি অথবা মরণে।।
অপর পুরুষে নারী যদি ভাবে মনে।।
নিরয়-গামিনী হবে কহিলাম সার।
পতি ভিন্ন গতি আর নাহি অবলার।।
সংসারের সুখভোগে কিছুমাত্র আর।
পতিহীনা নারীর না রবে অধিকার।।
এত যদি কহে দীর্ঘতমা দ্বিজবর।
ক্রোধেতে আকুল হয় পত্নীর অন্তর।।
পুত্রগণে কহে, লয়ে এই পাতকীরে।
সত্বরে ভাসায়ে দেহ জাহ্নবীর নীরে।।
মাতার বচনে লোভলুব্ধ পুত্রগণ।
গঙ্গাতে ফেলিল বাপে করিয়া বন্ধন।।
ভেলার বন্ধনে ভাসি গেল বহুদূর।
দৈবাৎ দেখিল তারে বলী মহাশূর।।
ধরিয়া আনিল ভেলা, দেখিল ব্রাহ্মণ।
জিজ্ঞাসিল তাহারে যতেক বিবরণ।।
কহিল সকল কথা উতথ্য-নন্দন।
বলী বলে, আমি তোমা করিনু বরণ।।
মোর বংশ বৃদ্ধি কর নিজ তপোবলে।
স্বীকার করিল দ্বিজ দৈত্যপতি-স্থলে।।
গৃহে আনি দ্বিজবরে করিল অর্চ্চন।
সুদেষ্ণা-রাণীকে ডাকি বলিল বচন।।
এই দ্বিজে ভজি কর, বংশের উৎপত্তি।
দ্বিজ হৈতে হইবেক, আছে হেন নীতি।।
অন্ধ দেখি সুদেষ্ণা করিল অনাদর।
শূদ্রী দাসী পাঠাইল যথা দ্বিজবর।।
দ্বিজের ঔরসে তার হৈল পুত্রগণ।
চারিবেদ ষট্শাস্ত্র করে অধ্যয়ন।।
হেনকালে বলী গেল দ্বিজের ভবন।
জিজ্ঞাসিল এই সব আমার নন্দন।।
দ্বিজ বলে, এরা নহে কুমার তোমার।
শূদ্রী-গর্ভে জন্ম হৈল আমার কুমার।।
অন্ধ দেখি আমারে তোমার পাটেশ্বরী।
না আইল মোর স্থানে অনাদর করি।।
এত শুনি বলী গেল নিজ অন্তঃপুরে।
কহিল সকল কথা সুদেষ্ণা-রাণীরে।।
তবে ত চলিল রাণী স্বামীর আদেশে।
তিন পুত্র জন্মাইল দ্বিজের ঔরসে।।
অঙ্গ বঙ্গ কলিঙ্গ এ তিন পুত্র নাম।
পৃথিবীর মধ্যে রাজা হৈল অনুপাম।।
অঙ্গদেশে বসাইল, জ্যেষ্ঠ পুত্র অঙ্গ।
কলিঙ্গ কলিঙ্গ দেশে, বঙ্গদেশে বঙ্গ।।
হেনমতে দ্বিজ হৈতে ক্ষত্রিয়-উৎপত্তি।
পূর্ব্বাপর আছে এই কহি বেদনীতি।।
তোমার বিচারে যেই আইসে জননী।
পাত্র মিত্র ডাকি জিজ্ঞাসহ এখনি।।
মন্ত্রী পুরোহিত লৈয়া করহ বিচার।
ভারত-বংশের হেতু কর প্রতিকার।।
সত্যবতী বলে, পুত্র তুমি ব্রহ্মচারী।
তোমার বচন আমি বেদতুল্য ধরি।।
মোর পূর্ব্ব-বিবরণ কহি যে তোমাতে।
যখন ছিলাম আমি পিতার গৃহেতে।।
ধর্ম্ম-পিতা বাহে নৌকা যমুনার জলে।
একদিন কৌতুকে গেলাম সেই স্থলে।।
দৈবে সেই দিনে মহামুনি পরাশর।
মহাতেজা জ্যোতির্ম্ময়, দেখে লাগে ডর।।
কহিবার যোগ্য পুত্র নহেত তোমারে।
সে মুনির কর্ম্ম পুত্র অদ্ভুত সংসারে।।
মৎস্যের দুর্গন্ধ মোর শরীরে আছিল।
আজ্ঞামাত্র দেহেতে পদ্মগন্ধ হইল।।
কুজ্ঝটী সৃজিয়া মুনি কৈল অন্ধকার।
মহাভয়ে বশীভূতা হইলাম তাঁর।।
তাঁহার ঔরসে মোর হইল নন্দন।
দ্বীপমধ্যে পুত্র মোর হৈল ততক্ষণ।।
জন্মমাত্র তার কর্ম্ম লোকে অনুপাম।
দ্বীপে জন্ম হেতু তাঁর দ্বৈপায়ন নাম।।
বেদ চতুর্ভাগ কৈল ব্যাস সে কারণে।
কৃষ্ণ নাম বলি কৃষ্ণ অঙ্গের বরণে।।
জন্মমাত্র যায় পুত্র তপের কারণ।
আমারে বলিয়া গেল এই ত বচন।।
ত্বরিতে আসিব মাতা করিলে স্মরণ।
কন্যাকালে পুত্র মোর ব্যাস তপোধন।।
তোমার সম্মতি হৈলে করি যে স্মরণ।
তুমি আমি কহি তারে বংশের কারণ।।
করযোড় করি বলে শান্তনু-নন্দন।
তবে চিন্তা কর মাতা কিসের কারণ।।
ধর্ম্ম অর্থ কাম ইথে, নাহিক বিচার।
কুল-শ্রেয়ঃ কর্ম্ম এই সম্মতি আমার।।
তোমার কুমার মাতা ব্যাস তপোধন।
শীঘ্রগতি কর মাতা তাঁহারে স্মরণ।।
দেবগণ মধ্যে হেথা ব্যাস তপোধন।
ভীষ্মের বচনে দেবী করিলা স্মরণ।।
নানাশাস্ত্র ধর্ম্ম কহিছেন দেবস্থানে।
উৎকণ্ঠা জন্মিল তাঁর মাতার স্মরণে।।
সেইক্ষণে আসি তথা হৈল উপস্থিত।
দেখি ভীষ্ম পূজা তাঁরে কৈল বিধিমত।।
বহুদিনে সত্যবতী দেখিলা নন্দন।
আলিঙ্গন দিয়া পুত্রে করেন ক্রন্দন।।
নয়নেতে নীর ঝরে, ক্ষীর বহে স্তনে।
স্তন্যদুগ্ধে স্নান করাইল তপোধনে।।
মায়ের রোদন দেখি বিস্ময়-বদন।
কমণ্ডলু-জল মুখে করিল সেচন।।
নিবারিয়া ক্রন্দন বলেন ব্যাস-মুনি।
কেন ডাকিয়াছ, আজ্ঞা করহ জননী।।
করিব তোমার প্রিয়, আজ্ঞা দেহ মোরে।
কি কর্ম্ম অসাধ্য তব সংসার-ভিতরে।।
সত্যবতী কহে, পুত্র কহিতে অশেষ।
আমার দুঃখের আর নাহি পরিশেষ।।
শিশু পুত্র রাখি স্বামী গেল স্বর্গবাস।
গন্ধর্ব্বেতে জ্যেষ্ঠপুত্র করিল বিনাশ।।
কনিষ্ঠ বালকে ভীষ্ম পালন করিল।
কাশীরাজ দুই কন্যা বিবাহ যে দিল।।
পুত্র না হইতে তার হইল নিধন।
বিধবা-যুগল বধূ, নবীন যৌবন।।
কুরুকুল অস্ত যায়, নাহি রাজ্য-স্বামী।
এ শোক-সাগরে পুত্র পড়িয়াছি আমি।।
উপায় না দেখি তোমা করিনু স্মরণ।
এ দায়ে আমার বংশ করহ রক্ষণ।।
পিতামাতা হৈতে হয় সন্তান সন্ততি।
একের অভাবে হয় সব অসঙ্গতি।।
তুমি পুত্র যেমন, তেমন দেবব্রত।
ইহার উপায় কর দোঁহার সম্মত।।
আমার বিবাহে ভীষ্ম করিল স্বীকার।
বংশ না করিব, নাহি লব অধিকার।।
সে কারণে তোমা বিনা না দেখি উপায়।
আপনি উদ্ধার কর, কুল অস্ত যায়।।
ব্যাস বলে, জননী করিনু অঙ্গীকার।
পালন করিব আজ্ঞা সে হয় তোমার।।
সত্যবতী বলে, তব আছে ভ্রাতৃ-বধূ।
পরম পবিত্র রূপে যেন পূর্ণ বিধু।।
করুণা প্রকাশি দেহ পুত্র দান তার।
ইহা বিনা উপায় না দেখি আমি আর।।
ব্যাস বলে, মাতা তুমি ধর্ম্মেতে তৎপরা।
ধর্ম্মেতে বিহিত এই আছে পরম্পরা।।
তোমার বচন আমি করিব পালন।
রাজ্য-হিতে তব কুল করিব রক্ষণ।।
আর এক নিবেদন শুনহ জননী।
পবিত্র হইতে বধূ বলহ আপনি।।
পবিত্র হইলে বর লভিবে আমার।
দেবতুল্য পরাক্রম হইবে কুমার।।
সত্যবতী বলে, পুত্র বিলম্ব না সয়।
অরাজকে রাজ্য নষ্ট, প্রজা দুষ্ট হয়।।
মায়ের বচনে বলে ব্যাস তপোধন।
মোর ভয়ঙ্কর মূর্ত্তি হবে দরশন।।
সেই মূর্ত্তি দেখি বধূ সহিবারে পারে।
সুপুত্র হইবে তবে তাহার উদরে।।
সময়ে আসিব বলি গেল মুনি ব্যাস।
সত্যবতী গেল তবে অম্বিকার পাশ।।
মধুর-বচনে তারে বলে সত্যবতী।
আমার বচন বধূ কর অবগতি।।
মজিল ভরত-বংশ নাহিক উপায়।
বংশরক্ষা হেতু বধু কহি যে তোমায়।।
যে উপায় বলে মোরে গঙ্গার কুমার।
সেই ত উপায় আছে নিকটে তোমার।।
আমার বচন তুমি কর অঙ্গীকার।
পুত্র জন্মাইয়া কর বংশের উদ্ধার।।
অর্দ্ধরাত্রে আসিবেন তোমার ভাসুর।
ভজিবে তাহারে তুমি ভয় করি দূর।।
আপনে থাকিয়া তবে দেবী সত্যবতী।
বিবিধ কুসুমে তার শয্যা দিল পাতি।।
পুনঃ পুনঃ কহি দেবী গেল নিজ স্থান।
অর্দ্ধরাত্রে ব্যাসদেব করিল প্রয়াণ।।
কৃষ্ণবর্ণ অঙ্গ, সুপিঙ্গল জটাভার।
ভয়ঙ্কর মূর্ত্তি, যেন ভৈরব আকার।।
দেখি মহাভয়ে রাণী মুদিল নয়ন।
তবে ব্যাসমুনি হৈল বিরস-বদন।।
রজনী বঞ্চিয়া মুনি কৈল স্নান-দান।
প্রাতঃকালে সত্যবতী গেল তাঁর স্থান।।
সত্যবতী বলে, পুত্র কহ বিবরণ।
ব্যাস বলে, পালিলাম তোমার বচন।।
মহাবলবন্ত মাতা হইবে কুমার।
অযুত হস্তীর বল হইবে তাহার।।
কেবল হইবে অন্ধ জননীর দোষে।
শত পুত্র হইবে যে তাহার ঔরসে।।
সত্যবতী বলে, পুত্র নহিল করণ।
কুরুকুলে অন্ধ রাজা না হবে শোভন।।
আর এক পুত্র কর বংশের কারণ।
অঙ্গীকার করি গেল ব্যাস তপোধন।।
তবে দশমাস পরে ধৃতরাষ্ট্র হৈল।
যুগল নয়ন অন্ধ, মুনি যাহা কৈল।।
পরে যবে অম্বালিকা কৈল ঋতুস্নান।
পুনঃ ব্যাসে সত্যবতী করিল আহ্বান।।
পূর্ব্বভয়ে অম্বালিকা না মুদিল আঁখি।
শরীর পাণ্ডুর বর্ণ হৈল মুনি দেখি।।
তবে ব্যাস মনামুনি মায়েরে কহিল।
আমারে দেখিয়া বধূ পাণ্ডুবর্ণ হৈল।।
সে কারণে হবে পুত্র পাণ্ডুর বরণ।
এত বলি গেল চলি ব্যাস তপোধন।।
সত্যবতী বলে, পুত্র কর অবধান।
আর এক পুত্র দেহ গন্ধর্ব্ব সমান।।
মায়ের বচনে ব্যাস স্বীকার করিল।
অন্তর্ধান করি মুনি নিজ স্থানে গেল।।
বৎসরেক বয়স হইল পাণ্ডুর-বীর।
অপূর্ব্ব গঠন রূপ পাণ্ডুর শরীর।।
পুনরপি এল ব্যাস মাতার স্মরণে।
ভয়ে অম্বালিকা নাহি গেল তাঁর স্থানে।।
সেবিকা আছিল তাঁর পরমা সুন্দরী।
পাঠাইল মুনি-স্থানে সুবেশাদি করি।।
নবীন যৌবন তাঁর, হয় শূদ্র-জাতি।
মুনির চরণে বহু করিল ভকতি।।
সন্তুষ্ট হইয়া মুনি বলিল তাহারে।
ধর্ম্মবন্ত পুত্র হবে তেমার উদরে।।
পরম পণ্ডিত হবে নরেতে প্রধান।
বর দিয়া গেল ব্যাস আপনার স্থান।।
মুনি-বরে গর্ভ তার হইল উৎপত্তি।
আপনি জন্মিল আসি ধর্ম্ম মহামতি।।
মহাভারতের কথা শ্রবণে অমৃত।
কাশীদাস কহে, সাধু পিয়ে অবিরত।।