০৫৪. মৎস্যগন্ধার উৎপত্তি ও ব্যাসদেবের জন্ম

দ্বাপর-যুগেতে রাজা নামে পরিচর।
সত্যশীল ধর্ম্মবন্ত তপেতে তৎপর।।
সকল ত্যজিয়া রাজা ধর্ম্মে দিল মন।
কঠিন তপস্যা বনে করে অনুক্ষণ।।
শিরে জটা, বৃক্ষের বল্কল পরিধান।
কভু ফল-মূল খায়, কভু অম্বুপান।।
কখন গলিত পত্র, কভু বাতাহার।
বৎসরেক নৃপতি করিল অনাহার।।
গ্রীষ্মকালে চতুর্দ্দিকে জ্বালি হুতাশন।
ঊর্দ্ধপদে তার মধ্যে রহে নৃপধন।।
হেনমতে তপ করে সহস্র বৎসর।
তাঁর তপ দেখিয়া ত্রাসিত পুরন্দর।।
ঐরাবতে চড়িয়া চলিল দেবরাজ।
যথা তপ করে রাজা অরণ্যের মাঝ।।
ডাক দিয়া বলে ইন্দ্র শুন নৃপবর।
দেখিয়া তোমার তপ সবে পাইল ডর।।
নিবর্ত্ত কঠোর তপ, না কর রাজন।
এত বলি দিল ইন্দ্র দিব্য আভরণ।।
বৈজয়ন্তী মালা দিল নৃপতির গলে।
ছত্রদণ্ড দিল আর শ্রবণ-কুণ্ডলে।।
চেদি নামে রাজ্যে করি অভিষেক তাঁরে।
রাজা করি দেবরাজ গেল নিজপুরে।।
চেদি রাজ্যে নৃপতি হইল পরিচয়।
নানাবিধ যজ্ঞ দান করে নিরন্তর।।
অযোনিসম্ভবা কন্যা পর্ব্বতে পাইল।
পরমা সুন্দরী দেখি বিবাহ করিল।।
নানাক্রীড়া করে রাজা ভার্য্যার সহিত।
কত দিনে ঋতুকাল হৈল উপনীত।।
ঋতুস্নান করিল রাজ্যের পাপেশ্বরী।
পবিত্র হইল তবে স্নান দান করি।।
সেই দিন পিতৃলোক কহিল রাজায়।
মৃগমাংসে শ্রাদ্ধ আজি কর মহাশয়।।
পিতৃগণ-আজ্ঞা পেয়ে রাজা পরিচয়।
মৃগয়া করিতে গেল অরণ্য ভিতর।।
মহাবনে প্রবেশিল মৃগ-অন্বেষণে।
ঋতুমতী ভার্য্যা তাঁর সদা পড়ে মনে।।
মৃগয়া করয়ে রাজা নাহি তাহে মন।
অনুক্ষণ ভার্য্যা মনে হয় ত স্মরণ।।
সেই হেতু তাঁর বীর্য্য হইল স্খলিত।
দেখিয়া নৃপতি চিত্তে হইল চিন্তি।।
হাতেতে সঞ্চান পক্ষী আছিল রাজার।
পত্রে করি বীর্য্য দিল স্থানেতে তাহার।।
এই বীর্য্য লৈয়া দিবা পাটেশ্বরী স্থানে।
এত বলি নরপতি পাঠায় সঞ্চানে।।
চলিল সঞ্চান পক্ষী রাজার আজ্ঞাতে।
আর এক সঞ্চান দেখিল শূন্যপথে।।
ভক্ষ দ্রব্য বলিয়া তাহাতে ছোঁ মারিল।
অন্তরীক্ষে যুগল সঞ্চানে যুদ্ধ হৈল।।
পক্ষী স্থান হৈতে রেতঃ পড়ে সেইকালে।
অন্তরীক্ষ হৈতে পড়ে যমুনার জলে।।
দীর্ঘিকা নামেতে ছিল স্বর্গ-বিদ্যাধরী।
মুনিশাপে ছিল জলে হইয়া শফরী।।
সেই বীর্য্য শফরী যে করিল ভক্ষণ।
খণ্ডন না যায় কভু দৈবের ঘটন।।
সেই হৈতে দশ মাসে ধীবরের জালে।
পড়িল প্রবীণ মৎস্য তুলিলেক কূলে।।
কূলেতে তুলিতে মৎস্য প্রসব হইল।
মুনিশাপে মুক্ত হৈয়া নিজ দেশে গেল।।
গর্ভে তার ছিল সুতা আর এক সুত।
দেখিয়া ধীবরগণ মানিল অদ্ভুত।।
যুগল-সন্তান তবে নিল কোলে করি।
যথা রাজা পরিচয় চেদি-অধিকারী।।
অপূর্ব্ব দেখিয়া রাজা হইল বিস্ময়।
কৈবর্ত্তে তনয়া দিয়া লইল তনয়।।
অপুত্রক রাজা পুত্রে করিল পালন।
মৎস্যরাজ বলি নাম করিল ঘোষণ।।
কন্যা লয়ে ধীবর আইল নিজঘরে।
বহু যত্ন করি তারে পালিল ধীবরে।।
রূপেতে তাহার সম নাহি ধরাপরে।
দোষ মাত্র মৎস্যগন্ধ তার কলেবরে।।
দুর্গন্ধেতে কেহ তার নিকটে না যায়।
দেখিয়া ধীবর-রাজা চিন্তিল উপায়।।
যমুনার জলে পথ গহন-কাননে।
সেই পথ নিত্য পার হয় মুনিগণে।।
কন্যারে বলিল, তুমি থাক এইখানে।
ধর্ম্ম-অর্থে পার কর যত মুনিগণে।।
পিতৃ-আজ্ঞা পেয়ে কন্যা থাকিল তথায়।
নিরন্তর মুনিগণে পার করে নায়।।
মহামুনি পরাশর শক্তির-কুমার।
তীর্থযাত্রা করিয়া ভ্রমেণ ধরাপর।।
আচম্বিতে পরাশর আইল সেই পথে।
কৈবর্ত্ত-কুমারী কন্যা দেখিল নৌকাতে।।
আনন্দিত অঙ্গ তার, প্রথম যৌবন।
মত্ত কোকিলের স্বর জিনিয়া বচন।।
তাহার লাবণ্য দেখি মোহ গেলা মুনি।
জিজ্ঞাসিল, কন্যা তুমি কাহার নন্দিনী।।
কন্যা বলে, আমি দাস-রাজার কুমারী।
পিতা মাতা নাম দিল মৎস্যগন্ধা করি।।
মুনি বলে, কন্যা তুমি জগত-মোহিনী।
পিতা মাতা নাম দিল মৎস্যগন্ধা করি।।
মুনি বলে, কন্যা তুমি জগত-মোহিনী।
আমারে ভজহ আমি পরাশর মুনি।।
এত শুনি কন্যা বলে, যুড়ি দুই কর।
কন্যা জাতি প্রভু আমি, নাহি স্বতন্তর।।
সহজে কৈবর্ত্ত-কন্যা, হই নীচজাতি।
অঙ্গেতে দুর্গন্ধ মোর, দেখ মহামতি।।
দুর্গন্ধেতে নিকটে না আসে কোন জনে।
আমারে পরশ মুনি করিবা কেমনে।।
তাহাতে কুমারী আমি, বিবাহ না হয়।
কিমতে ভজিব, আজ্ঞা কর মহাশয়।।
এত শুনি হাসিয়া বলেন পরাশর।
আমি বর দিব কন্যা নাহি তোর ডর।।
মৎস্যের দুর্গন্ধ আছে তোর কলেবরে।
পদ্মগন্ধ হইবেক আমার এ বরে।।
অনূঢ়া আছহ তুমি প্রথম যৌবনে।
সদা এইরূপে থাক আমার বচনে।।
বলিলা, তোমার জন্ম কৈবর্ত্তের ঘরে।
মহারাজ বিবাহ করিবে মোর বরে।।
এতেক বচন যদি সে মুনি বলিল।
পূর্ব্ব গন্ধ ত্যজি কন্যা পদ্মগন্ধা হৈল।।
অত্যন্ত সুন্দরী হৈর মুনিরাজ-বরে।
আপনা নেহারে কন্যা হরিষ অন্তরে।।
পুনরপি বলে কন্যা যুড়ি দুই কর।
খণ্ডিতে কাহার শক্তি তোমার উত্তর।।
যমুনার দুই তটে আছে লোকজন।
যমুনার জলে আছে নৌকা অগণন।।
ইহার উপায় প্রভু চিন্তহ আপনি।
লোকেতে প্রচার যেন না হয় কাহিনী।।
শক্ত্রি-পুত্র পরাশর মহা-তপোধন।
আজ্ঞাতে কুজ্ঝাটি মুনি করিল সৃজন।।
যমুনার মধ্যে দ্বীপ হইল তখন।
তথায় কন্যায় মুনি করে আলিঙ্গন।।
সেইকালে গর্ভ হৈল কন্যার উদরে।
ব্যাসদেব জন্মিলেন বিখ্যাত সংসারে।।
দ্বীপে জন্ম হেতু তাঁর নাম দ্বৈপায়ন।
চারি ভাল কৈল বেদ, ব্যাস সে কারণ।।
জন্মমাত্র জননীরে বলেন বচন।
আজ্ঞা কর মাতা, আমি যাব তপোবন।।
যখন তোমার কিছু হবে প্রয়োজন।
আসিব তোমার ঠাঁই করিলে স্মরণ।।
জননীর আজ্ঞা পেয়ে ব্যাস তপোধন।
তপস্যা-কারণে বনে করিল গমন।।
মহাভারতের কথা অমৃত-সমান।
কাশীরাম দাস কহে শুনে পুণ্যবান।।