০৫৩. দেবব্রতের যৌবরাজ্য প্রাপ্তি

গঙ্গার শোকেতে রাজা হইল কাতর।
নিরন্তর ভার্য্যা-গুণ ভাবে নৃপবর।।
গঙ্গার ভাবনা বিনা অন্য নাহি মনে।
বিবাহ না করে রাজা নবীন যৌবনে।।
হেনমতে বহুদিন আছে নরপতি।
নানা দান যজ্ঞ রাজা করে নিতি নিতি।।
সত্যবাদী জিতেন্দ্রিয় ধর্ম্মেতে তৎপর।
দেবাসুর-নর-পূজ্য যেন পুরন্দর।।
তেজে দিনকর সম, শান্তে যেন ইন্দু।
ক্ষমায় পৃথিবী রাজা গুণে পূর্ণ-সিন্ধু।।
গতিতে পবন রাজা, দুষ্টগণে যম।
রূপে গুণে ধর্ম্মে ধর্ম্মে কেহ নাহি সম।।
দুঃখী অন্ধ অথর্ব্বের হৈল পিতামাতা।
ধর্ম্মেতে তৎপর রাজা কল্পতুর-দাতা।।
রাজার পালনে প্রজা দুঃখ নাহি জানে।
ধন্য ধন্য বলি খ্যত হইল ভুবনে।।
বৎসর শতেক ষষ্টি গেল হেমতে।
এক দিন গেলে রাজা কল্পতরু-দাতা।।
রাজার পালনে প্রজা দুঃখ নাহি জানে।
ধন্য ধন্য বলি খ্যাত হইল ভুবনে।।
বৎসর শতেক ষষ্টি গেল হেনমতে।
এক দিন গেল রাজা মৃগয়া করিতে।।
একা রথে ভ্রমে রাজা ভাগীরথী-তীরে।
হেরে রাজা তরঙ্গ না বহে গঙ্গা-নীরে।।
স্থির রহে জাহ্নবী বারি যে সুগভীর।
আচম্বিতে দেখে রাজা দূরে এক বীর।।
আশ্চর্য্য দেখিয়া রাজা ভাবে মনে মনে।
তদন্ত জানিতে তবে গেল ততক্ষণে।।
নিকটে আসিয়া নৃপ দেখে সেই বীর।
কামদেব জিনি রূপ সুন্দর শরীর।।
হাতে ধনুঃশর বসি আছে মহাবল।
শরজালে বান্ধিয়াছে জাহ্নবীর জল।।
দেখিয়া শান্তনু হৈল বিরস বদন।
নৃপে হেরি বীর জলে প্রবেশে তখন।।
জলে প্রবেশিল তাহা শান্তনু দেখিয়া।
বসিল তথায় রাজা চিন্তিত হইয়া।।
শান্তনু দেখিয়া গঙ্গা হইল সদয়।
বাহির হইল আগে করিয়া তনয়।।
পূর্ব্ব রূপ ত্যজি গঙ্গা অন্য রূপ হৈয়্যা।
নৃপতির তরে তবে বলে ডাক দিয়া।।
কি কারণে চিন্তা তুমি করহ রাজন।
হের দেখ লহ রাজা আপন নন্দন।।
আমা হৈতে পাইলা যে অষ্টম কুমার।
দেবব্রত নাম ধরে তনয় তোমার।।
এ পুত্রের গুণ রাজা না যায় কথনে।
অস্ত্র শস্ত্র শিক্ষা কৈল বশিষ্ঠের স্থানে।।
দেবগুরু, দৈত্যগুরু সম শাস্ত্রে জ্ঞান।
অস্ত্রবিদ্যা জানে ভৃগুরামের সমান।।
সংসারে যতেক বিদ্যা নীতি-শাস্ত্র ধর্ম্ম।
এ পুত্রের অগোচর নহে কোন কর্ম্ম।।
তোমারে দিলাম পুত্র, লহ মহারাজ।
অভিষেক করিয়া করহ যুবরাজ।।
এত বলি গেল গঙ্গা অন্তর্ধান গতি।
পুত্র পেয়ে আনন্দিত হৈল নরপতি।।
পুত্র লৈয়া গেল রাজা আপন নগরে।
আনন্দিত পুরজন দেখি পুত্রবরে।।
রাজার সহিত যত মন্ত্রীর সমাজ।
শুভক্ষণ করিয়া করিল যুবরাজ।।
পুত্র পেয়ে সব দুঃখ পাসরিল রাজা।
আনন্দিত হইল রাজ্যের যত প্রজা।।
পুত্রে অধিকার দিয়া শান্তনু ভূপতি।
মৃগয়া করিয়া ভ্রমে অচিন্তিত-মতি।।
স্বচ্ছন্দে মৃগয়া করি ভ্রমে নরবীর।
একদিন গেল রাজা যমুনার তীর।।
কালিন্দীর তীরে মৃগ করে অন্বেষণ।
সুগন্ধ সহিত তথা বহিল পবন।।
গন্ধে আমোদিত রাজা চারিভিতে চায়।
কিসের সুগন্ধ আসে, না জানিল রায়।।
গন্ধ-অনুসারে তবে যায় নরপতি।
আচম্বিতে নৌকামাঝে দেখিল যুবতী।।
পরম সুন্দরী কন্যা জিনি বিদ্যাধরী।
কিরণে উজ্জ্বল করে যমুনার বারি।।
যুগল-খঞ্জন সম কন্যার নয়ন।
বিকচ-কমল প্রায় তাহার বদন।।
বচনে জিনিল মত্ত কোকিলের ভাষা।
কুসুমে কবরী-ভার সুচারু সুকেশা।।
কন্যা দেখি নৃপতিরে পীড়িল মদন।
আগু হৈয়া কন্যা প্রতি জিজ্ঞাসে রাজন।।
কোন জাতি হও তুমি, কোথা তব ধাম।
কাহার নন্দিনী তুমি কি তোমার নাম।।
কন্যা বলে, আমি দাস-রাজার দুহিতা।
ধর্ম্মার্থে বাহি যে নৌকা, আজ্ঞা দিল পিতা।।
কন্যার বচনে রাজা গেল শীঘ্রগতি।
যথায় কন্যার পিতা দাসের বসতি।।
রাজা দেখি মৎস্যজীবী উঠিল ত্বরিতে।
রত্ন-সিংহাসন লৈয়া দিলেক বসিতে।।
করযোড় দাস-রাজা নৃপ প্রতি কয়।
কি হেতু আইলা, আজ্ঞা কর মহাশয়।।
রাজা বলে, আইলাম তোমার এ স্থান।
তোমার যে কন্যা আছে, মোরে কর দান।।
দাস বলে মোর যদি বংশে ভাগ্য থাকে।
তবে মোর কন্যা দান করিব তোমাকে।।
যদি থাকে কন্যার কপালে সুলিখন।
যথাযোগ্য বর পায় ধর্ম্ম-নিবন্ধন।।
তুমি কুরু বংশধর বিখ্যাত সংসারে।
একমাত্র নিবেদন আছয়ে তোমারে।।
সত্য কর, ধর্ম্মপত্নী করিবে কন্যায়।
তবে কন্যা সম্প্রদান করিব তোমায়।।
আমার কন্যার যেই হইবে কুমার।
সেই জনে দিবে তুমি রাজ্য-অধিকার।।
রাজা বলে হেন কর্ম্ম করিতে না পারি।
দেবব্রত পুত্র মোর রাজ্য-অধিকারী।।
এমন বিবাহে মোর নাহি প্রয়োজন।
উঠিয়া নৃপতি দেশে করিল গমন।।
যেইক্ষণ হৈতে কন্যা দেখিল রাজন।
অনুক্ষণ চিন্তে রাজা নহে বিস্মরণ।।
নিরন্তর নরনাথ রহে অধোমুখে।
কন্যার ভাবনা ভাবি রহে মনোদুঃখে।।
পিতারে চিন্তিত দেখি দুঃখিত তনয়।
জিজ্ঞাসিল চিন্তা কেন কর মহাশয়।।
পৃথিবীতে কোন্ কর্ম্ম তোমার অসাধ্য।
যক্ষ-রক্ষ সুরাসুর সবে তব বাধ্য।।
আজ্ঞা কর এখনি সাধিয়া দিব কাজ।
কি কারণে অনুক্ষণ চিন্ত মহারাজ।।
পুত্রের বচন শুনি কহে নরপতি।
যে কারণে চিন্তা মোর শুনহ সুমতি।।
কুরুকুল মহাবংশ বিখ্যাত সংসার।
হেন বংশধর তুমি একই কুমার।।
জীবন যৌবন পুত্র চিরকাল নয়।
কদাচিৎ তোমার বিপদ যদি হয়।।
তবে ত কৌরব বংশ হইবে বিনাশ।
এই হেতু চিত্তে তাপ না করি প্রকাশ।।
যাবত আছহ তুমি বংশেতে নন্দন।
সহস্র কুমারে আর কোন্ প্রয়োজন।।
সংসারে যতেক ধর্ম্ম কহে পদ্মযোনি।
বংশ-রক্ষা-ধর্ম্ম ষোল-কলায় যে গণি।।
বংশহীন-লোকে ধর্ম্ম ফল নাহি ফলে।
বিবাহ না করি তুমি থাকিলে কুশলে।।
রূপে গুণে যোগ্য তুমি যে রাজকুমার।
তোমা বদ্যিমানে বিবাহে কি কাজ আমার।।
তথাপি পূর্ব্বাপর কহেন মুনিগণ।
এক পুত্র পুত্র নহে বংশের কারণ।।
এই হেতু চিন্তা মোর হয় নিরবধি।
উপায় না দেখি পুত্র ইহার ঔষধি।।
পিতার এতেক বাক্য করিয়া শ্রবণ।
দেবব্রত গেল যথা বিজ্ঞ মন্ত্রিগণ।।
কহিল পিতার কথা যত মন্ত্রিগণে।
শুনিয়া সকল মন্ত্রী বলিল তখনে।।
মৃগয়া করিতে রাজা গিয়াছিল বন।
পদ্মগন্ধা কন্যা সনে হৈল দরশন।।
তার হেতু তার বাপে বলিল বচন।
নাহি দিল কন্যা সেই তোমার কারণ।।
মন্ত্রিগণ স্থানে শুনি এতেক বচন।
রথে চড়ি তথাকারে করিল গমন।।
ততক্ষণে দেবব্রত দেখিয়া ধীবর।
রাজার বিধানে পূজা কৈল বহুতর।।
দেবব্রত বলে, রাজা তুমি ভাগ্যবান।
আমার জনকে তুমি কন্যা দেহ দান।।
এত শুনি যোড়হাতে বলিল ধীবর।
মোর নিবেদন এক অবধান কর।।
দাস বলে মোর কন্যা বিখ্যাত ভুবনে।
তাহার মহিমা বলে যত মুনিগণে।।
এত শুনি রাজা জন্মেজয় জিজ্ঞাসিল।
ধীবর সে কন্যারত্ন কেমনে পাইল।।
সহজে কৈবর্ত্ত-জাতি নীচ-মধ্যে গণি।
তার ঘরে হেন কন্যা কি কারণে মুনি।।
মুনিবর বলে রাজা কর অবধান।
সে কন্যার গুণ-কর্ম্ম শুনহ বিধান।।
মৎস্যের উদরে জন্ম ব্যাসের জননী।
দয়া করিলেন তারে পরাশর-মুনি।।
মহাভারতের কথা অমৃতের ধার।
কাশী কহে শুনি ভববারি হবে পার।।