০৪৬. দেবযানীর বিবাহ

হেনমতে নানা রঙ্গে বঞ্চে দেবযানী।
দাসীভাবে সেবে তারে দৈত্যের নন্দিনী।।
কতদিনে দেবযানী শর্ম্মিষ্ঠা লইয়া।
সহস্রেক দাসীগণ সংহতি করিয়া।।
চৈত্ররথ-নামে বন অতি মনোহর।
নানা রঙ্গে ক্রীড়া করে তাহার ভিতর।।
কেহ নাচে, কেহ গায়, কেহ দেয় তালি।
নানা বাদ্যারম্ভে, কেহ দেয় হুলাহুলি।।
কিশলয়-শয্যায় শয়ানা দেবযানী।
পদসেবা করে তাঁর দৈত্যের নন্দিনী।।
হেনকালে সেই বনে দৈবের লিখন।
যযাতি নৃপতি এল মৃগয়া কারণ।।
কন্যাকে দেখিয়া জিজ্ঞাসিল নৃপমণি।
কি নাম ধরহ তুমি কাহার নন্দিনী।।
এত শুনি দেবযানী করিল উত্তর।
দৈত্যগুরু শুক্র নামে খ্যাত চরাচর।।
তাঁহার তনয়া আমি, নাম দেবযানী।
শর্ম্মিষ্ঠা আমার সখী দৈত্যেশ-নন্দিনী।।
তুমি কিবা নাম ধর, কাহার নন্দন।
এথাকারে এলে তুমি কোন্ প্রয়োজন।।
শুনিয়া কন্যার বাক্য বলেন নৃপতি।
নহুষ-নন্দন আমি নামেতে যযাতি।।
ব্রহ্মচর্য্য-শীল আমি বিখ্যাত সংসারে।
মৃগয়া কারণে আইলাম এথাকারে।।
দেবযানী বলে, আমি ভালমতে জানি।
তোমার বংশের কথা অদ্ভুত কাহিনী।।
পরম সুন্দর তুমি, বলে মহাতেজা।
ব্রহ্মচর্য্য-বিজ্ঞ তুমি ধর্ম্মশীল রাজা।।
পূর্ব্বে কূপ হৈতে তুমি তুলিলা আমারে।
পুরুষ হইয়া তুমি ধরিয়াছ করে।।
এক্ষণে আমারে বিভা কর নরপতি।
সহস্রেক দাসী পাবে শর্ম্মিষ্ঠা-সংহতি।।
তোমার বংশেতে কেহ বিভা নাহি করে।
হাত ধরি লৈয়া যায় কন্যা নিজ ঘরে।।
এক্ষণে আমার হস্ত ধরি লহ তুমি।
স্বেচ্ছায় তোমারে রাজা বরিলাম আমি।।
রাজা বলে, জানি শুক্র তপঃকল্পতরু।
ব্রাহ্মণের শ্রেষ্ঠ আর দৈত্যগণ-গুরু।।
তাঁহার নন্দিনী তুমি বন্দিতা আমার।
সে কারণে যোগ্য আমি না হই তোমার।।
তোমা বিভা করিবারে বড় ভয় মন।
শুক্র-ক্রোধে হবে মোর সংশয়-জীবন।।
সর্পের বিষের তেজে একজন মরে।
ব্রাহ্মণের ক্রোধ-বিষ স্বংশে-জীবন।।
সর্পের বিষের তেজে একজন মরে।
ব্রাহ্মণের ক্রোধ-বিষ সবংশে সংহারে।।
দেবযানী বলে, রাজা কি তোমার ভয়।
অযাচকে যাচি দিলে কিবা তার হয়।।
রাজা বলে, শুক্র যদি দেন অনুমতি।
তবে বিভা করিবারে পারি গুণবতি।।
এত শুনি দেবযানী রাজার উত্তর।
ভাবিয়া চিন্তিয়া গেল পিতার গোচর।।
পিতারে কহিল কন্যা যত বিবরণ।
যযাতি নৃপতি এল মৃগয়া কারণ।।
মহা-ধর্ম্মশীল রাজা নহুষ-তনয়।
তাঁরে সম্প্রদান কর মোরে মহাশয়।।
শুনিয়া কন্যার বাক্য বলে শুক্রাচার্য্য।
যযাতিকে দিব তোমা, এ নহে আশ্চর্য্য।।
এত বলি দৈত্যগুরু চলে শীঘ্রগতি।
দেবযানী সহ গেল যথা নরপতি।।
শুক্রে দেখি নরপতি প্রণতি করিল।
কৃতাঞ্জলি হইয়া সম্মুখে দাঁড়াইল।।
শুক্র বলে, শুনহ যযাতি নৃপমণি।
এই দেবযানী হয় আমার নন্দিনী।।
স্বেচ্ছামত ইহারে বিবাহ কর তুমি।
করে ধরি সম্প্রদান করিতেছি আমি।।
রাজা বলে, ধর্ম্মাধর্ম্ম জানহ আপনি।
ক্ষত্রিয়ের যোগ্য নহে ব্রাহ্মণ-নন্দিনী।।
শুক্র বলে, আছে দোষ বলে দেববাণী।
ব্রাহ্মণ-তনয়া তিন বর্ণের জননী।।
শুক্র কন, বিভা কর আজ্ঞায় আমার।
মম তপোবলে দোষ খণ্ডিবে তোমার।।
এই বাক্য আমার শুনহ নৃপমণি।
শর্ম্মিষ্ঠা দেখহ এই দৈত্যের-নন্দিনী।।
মম কন্যা দেবযানীর সেবিকা এ হয়।
কদাচ না করো কভু অবৈধ প্রণয়।।
এত বলি সম্প্রদান কৈল দেবযানী।
শুক্রে প্রণমিয়া দেশে গেল নৃপমণি।।
শর্ম্মিষ্ঠার সহ দুই সহস্র যুবতী।
অশোক বনেতে রাজা দিলেন বসতি।।
যথাযোগ্য ভক্ষ্য ভোজ্য বসন ভূষণ।
প্রত্যক্ষে সবার রাজা কৈল নিয়োজন।।
দেবযানী হইল প্রধান পাটেশ্বরী।
হেনমতে ক্রীড়া করে দিবস-শর্ব্বরী।।
ধরিল প্রথম গর্ভ শুক্রের নন্দিনী।
দশ মাসে প্রসব হইল দেবযানী।।
দ্বিতীয়ার চন্দ্র সম হইল নন্দন।
নন্দনের যদু নাম রাখিল রাজন।।
কতদিন পরে দেখ দৈবের যে গতি।
দৈত্যকন্যা শর্ম্মিষ্ঠা হইল ঋতুমতী।।
ঋতুস্নান করি কন্যা চিন্তিতা মানসে।
স্বামীহীনা হইলাম নিজ কর্ম্মদোষে।।
বৃথা জন্ম গেল মোর, এ নব যৌবনে।
পুত্রহীনা হইলাম বঞ্চি দাসীপণে।।
হরি হরি বিধি মোরে হইলা নিষ্ঠুর।
কোন্ কর্ম্ম লভিলাম জন্মি মর্ত্ত্যপুর।।
ভাগ্যবতী দেবযানী যৌবন-সময়।
লভিল আপন পতি পাইল তনয়।।
এতেক বিষাদ করি ভাবে মনে মনে।
পুত্রবর মাগি লব যযাতি রাজনে।।
দেবযানী সখী মোর হয় ত ঈশ্বরী।
তাঁহার ঈশ্বর হৈল মোর অধিকারী।।
যদি পাই একান্তে নৃপতি দরশন।
ঋতুদান মাগি লব, এই লয় মন।।
যযাতি যে সত্যব্রত বিখ্যাত সংসারে।
যে কিছু যে চাহে, তাহা অন্যথা না করে।।
এতেক চিন্তিতে দেখ দৈবের লিখন।
আইল নৃপতি তথা বিহার-কারণ।।
নানা বৃক্ষ ফল ফুলে শোভে রম্য বন।
একাকী ভ্রময়ে তথা যযাতি রাজন।।
হেনকালে শর্ম্মিষ্ঠা রাজারে একা দেখি।
সন্নিকটে গিয়া প্রণমিল শশীমুখী।।
কৃতাঞ্জলী হইয়া সম্মুখে দাঁড়াইল।
সবিনয়ে দৈত্য-বালা কহিতে লাগিল।।
উপেন্দ্র মহেন্দ্র চন্দ্র জলেন্দ্রর প্রায়।
সর্ব্বগুণে নৃপতি তোমারে গণি তায়।।
আমারে নৃপতি তুমি জান ভালমতে।
শুনহ প্রার্থনা এক করি যে তোমাতে।।
কামভাবে তোমারে না করি নিবেদন।
ঋতুরক্ষা কর মোর ধর্ম্মের কারণ।।
রাজা বলে, ইহা না কহিও কদাচন।
শুক্রের বচন তব নাহি কি স্মরণ।।
দেবযানী-বিবাহে বলিল বারে বারে।
প্রণয়ে আবদ্ধ না করিহ শর্ম্মিষ্ঠারে।।
শুক্রের বচন কেবা খণ্ডাইতে পারে।
কি শক্তি আমার পরশিব যে তোমারে।।
কন্যা বলে, রাজা তুমি পরম পণ্ডিত।
তোমারে ‍বুঝাব আমি, না হয় উচিত।।
বিবাহের কালে সর্ব্ব-ধন-অপহারে।
কৌতুকেতে আর নারী সহিত বিহারে।।
প্রাণের সংশয়ে যদি মিথ্যা কেহ কহে।
এই পঞ্চ স্থানে মিথ্যা পাপহেতু নহে।।
দেবযানী তোমারে বরিল যেই ক্ষণে।
আমার বরণ রাজা হৈল সেই দিনে।।
একে সখী দেবযানী দ্বিতীয়ে ঈশ্বরী।
তাঁর ভর্ত্তা তুমি মম হৈলা অধিকারী।।
রাজা বলে, নহে এই ধর্ম্মের বিচার।
মিথ্যা বাক্য কভু নাহি শোভে যে রাজার।।
লোকে মিথ্যা পাপ কৈলে দণ্ড করে রাজা।
রাজা মিথ্যাবাদী হৈলে লোকে নাহি পূজা।।
কন্যা বলে, রাজা নহে অধর্ম্ম আচার।
ভার্য্যা পুত্র দাসেতে স্বামীর অধিকার।।
ঈশ্বরী-ঈশ্বর তুমি আমার ঈশ্বর।
তে কারণে তোমাতে মাগিনু পুত্রবর।।
কন্যার বচন শুনি সত্য ধর্ম্ম নীতি।
হৃদয়ে ভাবিয়া তবে কহে নরপতি।।
রাজা বলে, পূর্ব্বে করিয়াছি অঙ্গীকার।
যেই যাহা মাগে দিব প্রতিজ্ঞা আমার।।
সে কারণে তোমার পূরাব অভিলাষ।
এত বলি গেল রাজা শর্ম্মিষ্ঠার পাশ।।
ঋতুদান শর্ম্মিষ্ঠারে দিলা নরপতি।
কেহ না জানিল, গেল আপন বসতি।।
রাজার ঔরসে গর্ভ শর্ম্মিষ্ঠা ধরিল।
দশ মাস দশ দিনে পুত্র প্রসবিল।।
পরম সুন্দর হৈল রাজার নন্দন।
হস্ত পদে চক্র শোভে কমল-লোচন।।
শর্ম্মিষ্ঠার পুত্র হৈল, লোকে কৈল শব্দ।
বার্ত্তা পেয়ে দেবযানী হৈল মহাস্তব্ধ।।
আশ্চর্য্য শুনি যে, পুত্র হইল কিমতে।
শর্ম্মিষ্ঠার গৃহে তবে চলিল ত্বরিতে।।
দেবযানী বলে, সখি! করিলে কি কর্ম্ম।
কামে মত্ত হৈয়া নষ্ট কৈলে সতীধর্ম্ম।।
শর্ম্মিষ্ঠা বলেন, সখি! দৈবের লিখন।
মোর ঋতুকালে আসে ঋষি একজন।।
কামভাবে তাহাঁরে না করিনু কামনা।
পুত্রদান দিয়া মোরে গেল সেই জনা।।
দেবযানী বলে, সখী কহ সত্য কথা।
কি নাম ঋষির হয় বাস তার কোথা।।
শর্ম্মিষ্ঠা বলেন, ঋষি পরম-সুন্দর।
মহাতেজ ধরে ঋষি যেন দিবাকর।।
তাঁরে জিজ্ঞাসিতে শক্তি হইবে কাহার।
সে কারণে নাম-গোত্র না জানি তাঁহার।।
দেবযানী বলে, সখি তুমি পুণ্যবতী।
ঋষিবরে হৈল পুত্র, চন্দ্র-সম-দ্যুতি।।
এত বলি দেবযানী গেল অন্তঃপুরে।
হেনমতে তার কত দিবস-অন্তরে।।
দেবযানী প্রসবিল দ্বিতীয় কুমার।
তুর্ব্বসু বলিয়া নাম রাখিল তাহার।।
দেবযানী প্রসবিল এই দুই নন্দন।
যদু আর তুর্ব্বসু বিখ্যাত ত্রিভুবন।।
শর্ম্মিষ্ঠার গর্ভে জন্মে রাজার ঔরসে।
তিন পুত্র হৈল নাম শুন সবিশেষে।।
জ্যেষ্ঠ দ্রুহ্যু, অনু আর দ্বিতীয় কুমার।
কনিষ্ঠ হইল পুরু সর্ব্ব-গুণাধার।।
রাজার কুমার সব বাড়ে দিনে দিনে।
ঋষি হৈতে পুত্র হয়, দেবযানী জানে।।
মহাভারতের কথা অমৃত-সমান।
কাশীরাম দাস কহে, শুনে পুণ্যবান।।