০৪৪. কচ ও দেবযানীর পরস্পর অভিশাপ প্রদান

তবে কতদিনে কচে বলে দেবযানী।
দেব আরাধিব, কিছু পুষ্প দেহ আনি।।
আজ্ঞা পেয়ে গেল কচ পুষ্প আনিবারে।
পুনরপি দেখি তারে ধরিল অসুরে।।
তিলেক-প্রমাণ কৈল খড়্গেতে কাটিয়া।
ঘৃতে ভাজে অস্থি মাংস একত্র করিয়া।।
তবে সব দৈত্যগণ করিল বিচার।
অন্যজনে খেলে তার নাহিক নিস্তার।।
পুনঃ জিয়াইবে শুক্র মন্ত্রের প্রভাবে।
কচ প্রাণ পাবে আর তার প্রাণ যাবে।।
এতেক বিচার করি যত দৈত্যগণ।
করাইল সুরাসহ শুক্রেরে ভোজন।।
পুনরপি দেবযানী বাপে জিজ্ঞাসিল।
পুষ্প আনিবারে কচ কাননেতে গেল।।
এতক্ষণ হৈল পিতা, কচ না আইল।
হেন বুঝি, দৈত্যগণ পুনশ্চ মারিল।।
নিশ্চয় মরিব পিতা কচে না দেখিয়া।
পুনরপি তারে পিতা দেহ জিয়াইয়া।।
শুক্র বলে, দেবযানী না কর বিলাপ।
মৃত-জন-হেতু কেন কর পরিতাপ।।
ব্রহ্মা ইন্দ্র চন্দ্র সূর্য্য মরিলে না জীয়ে।
কচ হেতু কেন মর ক্রন্দন করিয়ে।।
দেবযানী বলে, পিতা যাহা কহ তুমি।
নিশ্চয় মরিব, কচে না দেখিলে আমি।।
কচের যতেক গুণ কহিতে না পারি।
কচের সৌজন্য পিতা পাসরিতে নারি।।
আজি হৈতে এই মোর সত্য অঙ্গীকার।
শরীর ত্যজিব আমি করি অনাহার।।
এত বলি দেবযানী করিছে ক্রন্দন।
প্রবোধিয়া শুক্র বলে মধুর বচন।।
কন্যা-প্রবোধিয়া শুক্র ভাবিল অন্তরে।
ধ্যানে দেখে কচ আছে আপন উদরে।।
শুক্র বলে, কচ তুমি কহ বিবরণ।
আমার উদরে আইলা কিসের কারণ।।
কচ বল আমারে মারিল দৈত্যগণ।
করাইল সুরাসহ তোমায় ভক্ষণ।।
জ্ঞান নাহি টুটে মম তব অধ্যয়নে।
কেমনে বাহির হৈব ভাবিতেছি মনে।।
এত শুনি শুক্র তবে বলে আরবার।
তোমারে বাহির কৈলে আমার সংহার।।
বাহির না করিলে ব্রাহ্মণ-বধ হয়।
মরণ হইতে বড় বিপ্র-বধে ভয়।।
ব্রহ্মা-আদি দেবগণ আছে যত জন।
ব্রহ্মবধ-পাপে নয় কাহারো মোচন।।
এত ভাবি কচে শুক্র বলিল বচন।
নিশ্চয় দেখি যে পুত্র আমার মরণ।।
সঞ্জীবনী-মন্ত্রী আমি দিতেছে তোমারে।
বাহির হইয়া তুমি জীয়াইবা মোরে।।
এত বলি মন্ত্র দিল ভৃগুর নন্দন।
গর্ভে থাকি কচ করে মন্ত্র উচ্চারণ।।
তবে দৈত্যগুরু নিজ করে খড়্গ লৈয়া।
বাহির করিল কচে উদর চিরিয়া।।
হইল বাহির কচ, শুক্র ত্যজে প্রাণ।
পুনরপি জীয়াইল মন্ত্র করি ধ্যান।।
তবে মহাক্রুদ্ধ হৈল ভৃগুর নন্দন।
সুরা প্রতি শাপ দিল মুনি ততক্ষণ।।
ব্রাহ্মণ হইয়া যেই করে সুরাপান।
থাকুক পানের কাজ লহে যদি ঘ্রাণ।।
অধার্ম্মিক ব্রহ্মঘাতী বলিবা সে জনে।
ব্রহ্মাতেজ নষ্ট তার হৈবে সেইক্ষণে।।
ইহলোকে অপূজিত হৈবে সেই জনে।
মরিলে নরক মধ্যে হইবে গমন।।
তবে শুক্র ডাকি বলে দৈত্যগণ প্রতি।
মম শিষ্যে মারিলে এ কেমন প্রকৃতি।।
আজি হৈতে কচে তোমা কেহ না হিংসিবে।
এই বাক্য হেলা কৈলে বড় দুঃখ পাবে।।
কচেরে বলিল শুক্র আশ্বাস করিয়া।
যথা ইচ্ছা ভ্রম সুখে নির্ভয় হইয়া।।
শুক্রের বচনে কচ নির্ভয় হইল।
নানা বিদ্যা ব্রহ্মচর্য্য অধ্যয়ন কৈল।।
অধ্যয়ন শেষে বৃহস্পতির তনয়।
দেবযানী স্থানে গেল মাগিতে বিদায়।।
আজ্ঞা কর দেবযানী যাই নিজ দেশ।
চিত্তে অনুগ্রহ মোরে রাখিও বিশেষ।।
এত শুনি দেবযানী বিষণ্ণ-বদন।
কচেরে ডাকিয়া তবে বলেন বচন।।
দেখহ আমার কচ যৌবন-সময়।
তোমারে দেখি যে যোগ্য, কম পরিণয়।।
শুনিয়া বিস্ময়ে কহে জীবের কুমার।
হেন অনুচিত বাক্য না বলিও আর।।
গুরুর তনয়া তুমি আমার ভগিনী।
এমত কুৎসিত কেন বল দেবযানী।।
দেবযানী বলে তুমি না কর খণ্ডন।
তোমারে করিতে বিভা হইয়াছে মন।।
মরেছিলে তুমি, জীয়াইনু বার বার।
মোর বাক্য নাহি রাখ, কেমন বিচার।।
পূর্ব্বের সৌহৃদ্য রাখ জীবের নন্দন।
এত শুনি কচ হৈল বিষণ্ণ-বদন।।
কচ বলে, দেবযানী এ নহে উচিত।
তোমায় আমায় হেন না হয় বিহিত।।
যেই শুক্র হইতে তোমার জন্ম হয়।
সেই শুক্র হইতে আমার জ্ঞানোদয়।।
সহোদরা তুমি হও সহজে আমার।
কি মতে এমত বল বাক্য কদাচার।।
আজ্ঞা কর যাই আমি আপন আলয়।
শুনি দেবযানী কোপ করে অতিশয়।।
নারী হৈয়া বারে বারে করিনু বিনয়।
না রাখ আমার বাক্য তুমি দুরাশয়।।
যত বিদ্যা তোরে পড়াইল মোর বাপে।
সকল নিষ্ফল তোর হবে মোর শাপে।।
কচ বলে, দেবযানী করিলা কি কর্ম্ম।
বিনা দোষে শাপ দিলা, নহে এই ধর্ম্ম।।
গর্ব্বিতা হইয়া কথা বল অনুচিত।
সে কারণে দিব শাপ ইহার বিহিত।।
ব্রাহ্মণের শ্রেষ্ঠ শুক্র, তুমি কন্যা তাঁর।
মোর শাপে ক্ষত্রভর্ত্তা হইবে তোমার।।
মোরে শাপ দিলা তুমি, না যাবে খণ্ডন।
বিফল হইবে যে করিলাম পঠন।।
আমি যত পড়াইব আর শিষ্যগণে।
সে সবারে ফলদায়ী হৈবে অধ্যাপনে।।
এত বলি গেল কচ ইন্দ্রের নগর।
কচে দেখি আনন্দিত সকল অমর।।
কহিল সকল কচ যত বিবরণ।
নিঃশঙ্ক হইয়া যুদ্ধ করে দেবগণ।।
দেব-দৈত্য-যুদ্ধ-কথা না যায় লিখন।
এতেক শুনিলা দেবযানীর কথন।।
কচ-দেবযানী-কথা মহা-পুণ্যময়।
কাশী ভণে, সাধু শুনে হইয়া তন্ময়।।
মহাভারতের কথা ব্যাসের রচিত।
পাঁচালী প্রবন্ধে কাশীরাম বিরচিত।।