০২৮. উতঙ্কের উপাখ্যান

উতঙ্ক তৃতীয় শিষ্য পড়ে গুরু-স্থানে।
একদিন যায় গুরু যজ্ঞ-নিমন্ত্রণে।।
উতঙ্কে বলিল গুরু থাক তুমি ঘরে।
কিছু নষ্ট নাহি হয় রাখিবা গোচরে।।
এত বলি গেল গুরু, যথা যজ্ঞস্থান।
কতদিনে গুরুপত্নী কৈল ঋতু-স্নান।।
উতঙ্কে ডাকিয়া তবে ব্রাহ্মণী বলিল।
তোমারে সমর্পি গৃহ তব গুরু গেল।।
কোন দ্রব্য নষ্ট যেন নহে কদাচন।
ঋতু নষ্ট হয় তুমি করহ রক্ষণ।।
শুনিয়া বিস্ময়-চিত্ত হইল উতঙ্ক।
উদ্বিগ্ন বসিয়া ভাবে হৃদয়ে আতঙ্ক।।
কি করিব, কি হইবে ইহার উপায়।
গৃহরক্ষা হেতু গুরু রাখিলা আমায়।।
ঋতুরক্ষা-কর্ম্ম এই না হয় আমার।
পরদার মহাপাপ, তাহে গুরুদার।।
এত চিন্তি ব্রাহ্মণীর না রাখে অনুরোধ।
নৈরাশ হইয়া ব্রাহ্মণীর হৈল ক্রোধ।।
প্রকাশ ভয়ে ক্রোধ না করিল প্রকাশ।
কিছুকাল পরে বেদ আইল নিজ বাস।।
উতঙ্কের তাপ ব্রাহ্মণীর মনে জাগে।
একান্তে ব্রাহ্মণী কহে ব্রাহ্মণের আগে।।
দিবে গুরু-দক্ষিণা উতঙ্ক যেইক্ষণে।
পাঠাইবা তাহাকে আমার সন্নিধানে।।
না জানিল দ্বিজ এ সকল বিবরণ।
সযতনে শিষ্য করেছে গৃহের রক্ষণ।।
শিষ্য প্রতি বেদ গুরু তুষ্ট অতি হন।
তুষ্ট হয়ে উতঙ্কে বলিল ততক্ষণ।।
যাহ শিষ্য সর্ব্বশাস্ত্র হও তুমি জ্ঞাত।
শুনিয়া উতঙ্ক কহে করি যোড়-হাত।।
আজ্ঞা কর গোঁসাই দক্ষিণা কিছু দিব।
গুরু বলে, তব পাশ কিছু না মাগিব।।
দেহ তবে তব গুরুপত্নী যাহা মাগে।
এত শুনি গেল শিষ্য গুরুপত্নী আগে।।
দক্ষিণা যাচয়ে শিষ্য করি যোড়পাণি।
হৃদয়ে চিন্তিয়া তবে বলিল ব্রাহ্মণী।।
পৌষ্য নৃপ মহিষীর শ্রবণ-কুণ্ডল।
আনি দিলে পাই তব দক্ষিণা সকল।।
সপ্তদিন ভিতরে আনিয়া দিবে মোরে।
না আনিলে দিব শাপ কহিলাম তোরে।।
এত শুনি উতঙ্ক গুরুরে নিবেদিল।
যাও হে নির্ব্বিঘ্নে দ্বিজ, গুরু আজ্ঞা দিল।।
গুরুকে প্রণাম করি উতঙ্ক চলিল।
কতদূরে পথে এক বৃষভ দেখিল।।
পুরীষ ত্যজিয়া বৃষ আছে দাঁড়াইয়া।
উতঙ্কে দেখিয়া বৃষ বলিল ডাকিয়া।।
হের দেখ মল মোর উতঙ্ক ব্রাহ্মণ।
হইবে তোমার শ্রেয় করহ ভক্ষণ।।
উতঙ্ক বলিল, হেন নহে কদাচান।
অসম্মান মোরে কেন কর অকারণ।।
বৃষ বলে, অসম্মান নহে দ্বিজবর।
তোমার গুরুর দিব্য, খাও এ গোবর।।
গুরু-দিব্য শুনি দ্বিজ চিন্তিয়া বিস্তর।
গোবর ভক্ষণ করি চলিল সত্বর।।
তথা হৈতে চলি গেল পৌষ্য-নৃপ-ঘর।
মাগিল কুণ্ডল-যুগ্ম নৃপতি-গোচর।।
নৃপ পাঠাইল দ্বিজে রাণীর সদনে।
কর্ণ হৈতে কুণ্ডল দিলেন ততক্ষণে।।
কর্ণ হৈতে কুণ্ডল কাটিয়া দিল রাণী।
পাইয়া কুণ্ডল চলি গেল দ্বিজমণি।।
যেইক্ষণে দ্বিজ হাতে কুণ্ডল পাইল।
যেইক্ষণে তক্ষক তাহার সঙ্গ নিল।।
পরশ করিতে দ্বিজে নাহিক শকতি।
পাছে পাছে যায় ধরি সন্ন্যাসী-মূরতি।।
কত পথে উতঙ্ক দেখিয়া সরোবর।
স্নানেতে নামিল বস্ত্র থুইয়া উপর।।
বসন-ভিতরে-দ্বিজ কুণ্ডল থুইল।
ছিদ্র প্রাপ্তে তক্ষক কুণ্ডল হরে নিল।।
উতঙ্ক দেখয়ে থাকি জলের ভিতরে।
সন্ন্যাসী কুণ্ডল লৈয়া পশিল বিবরে।।
ত্যজিয়া সে স্নান দ্বিজ ধায় মুক্তচুল।
বিবরের দ্বারে দেখে, না পশে আঙ্গুল।।
উপায় না দেখি মুনি বিষাদিত-মন।
নখেতে বিবর-দ্বার করয়ে খনন।।
এ সকল বৃত্তান্ত জানিল পুরন্দর।
ব্রাহ্মণের দুঃখে দুঃখী হইল অন্তর।।
সেই রন্ধ্রে নিজ বজ্র কৈল নিয়োজন।
বিবরের দ্বার মুক্ত হৈল ততক্ষণ।।
পাতালে উতঙ্ক গিয়া প্রবেশ করিল।
কতই অদ্ভুত দৃশ্য সেখানে দেখিল।।
চন্দ্র-সূর্য্য-গতায়াত গ্রহ তারাগণ।
মাস বর্ষ ষড়-ঋতু সবার সদন।।
অনেক ভ্রমিল দ্বিজ পাতাল-ভিতরে।
না দেখিয়া সন্ন্যাসীরে চিন্তিত অন্তরে।।
হেনকালে অশ্বরূপে বলে বৈশ্বানর।
হে উতঙ্ক-ব্রাহ্মণ আমার বাক্য ধর।।
গুরু-জ্ঞানে মোরে তুমি করহ বিশ্বাস।
শ্রেয় হবে, মোর গুহ্যে করহ বাতাস।।
গুরু-নাম শুনি দ্বিজ বিলম্ব না কৈল।
কিছু না পাইয়া মুখে গুহ্যে ফুঁক দিল।।
গুহ্যে ফুঁক দিত ধূম বাহিরিল মুখে।
ধূমময় সকলি করিল নাগলোকে।।
প্রলয়ের প্রায় হৈল ঘোর অন্ধকার।
বিস্ময় হইয়া নাগ কৈল হাহাকার।।
বাসুকি প্রভৃতি যত শ্রেষ্ঠ নাগগণ।
কি হেতু হইল ধূম জিজ্ঞাসে কারণ।।
চর-মুখে বৃত্তান্ত পাইয়া ততক্ষণ।
তক্ষকে আনিয়া বহু করিল গঞ্জন।।
দেহ শীঘ্র কুণ্ডল, ব্রাহ্মণ হোক্ সুখী।
এত বলি দ্বিজে তুষ্ট করিলা বাসুকি।।
কুণ্ডল পাইয়া দ্বিজ গেল অশ্ব-স্থানে।
পৃষ্ঠে করি অশ্ব-লয়ে থুইল ব্রাহ্মণে।।
সপ্তদিন পূর্ণে আসি গুরুর গৃহেতে।
দেখে গুরুপত্নী ক্রোধে আছে জল হাতে।।
মুখেতে নির্গত হৈতেছিল শাপবাণী।
হেনকালে উতঙ্ক দিলেন যুগ্মমণি।।
কুণ্ডল পাইয়া হৃষ্ট ব্রাহ্মণী হইল।
উতঙ্ক সকল কথা গুরুকে কহিল।।
গুরু কহে, যেই বৃষ দিলেন গোবর।
বৃষ নহে অমৃত দিলেন পুরন্দর।।
সন্ন্যাসীর বেশে যেই লইল কুণ্ডল।
তক্ষক বিবরদ্বারে গেল রসাতল।।
অশ্বরূপে যে তোমার কৈল উপকার।
অশ্ব নহে, অগ্নি ইষ্ট সহজে আমার।।
এত শুনি উতঙ্কের মনে হৈল তাপ।
বিনাদোষে দুঃখ মোরে দিল দুষ্ট সাপ।।
তার সমুচিত ফল আমি দিব তারে।
এত বলি বিদায় মাগিল দ্বিজবরে।।
গুরু প্রদক্ষিণ করি করিল গমন।
যথা রাজা জন্মেজয়, চলিল ব্রাহ্মণ।।
ব্রাহ্মণে দেখিয়া রাজা করিল বন্দন।
জিজ্ঞাসিল দ্বিজবরে কেন আগমন।।
দ্বিজ বলে, নৃপতি করহ কোন্ কর্ম্ম।
পিতৃবৈরী না শাসিলে নহে পুত্রধর্ম্ম।।
চণ্ডাল তক্ষক-নাগ বড় দুরাচার।
দংশিল তোমার বাপে বিখ্যাত সংসার।।
তাহার ‍উচিত রাজা করিতে যুয়ায়।
সর্পকুল বিনাশিতে করহ উপায়।।
উতঙ্ক-বচন শুনি রাজা জন্মেজয়।
মন্ত্রিগণে জিজ্ঞাসিল মানিয়া বিস্ময়।।
কহ সত্য মন্ত্রিগণ ইহার কারণ।
তক্ষক-দংশনে হৈল পিতার মরণ।।
ব্রহ্মশাপে মরিলেক পিতা, হেন জানি।
তক্ষক এমন কৈল, কভু নাহি শুনি।।
রাজার এমন বাক্য শুনি মন্ত্রিগণ।
কহিতে লাগিল তবে কথা পূরাতন।।
মহাভারতের কথা সুধার লহরী।
কিবা যে শকতি বর্ণিবারে তাহা পারি।।
উতঙ্ক মুনির কথা শ্রবণে অমৃত।
কাশীরাম কহে সাধু পিয়ে অনুব্রত।।