০২৫. জরুৎকারুর পত্নীত্যাগ

শৌনকাদি মুনি বলে শুন সূত-সুত।
কহিলা সকল কথা শ্রবণে অদ্ভুত।।
জরৎকারু মুনিরে বাসুকি ভগ্নী দিল।
কহ শুনি আস্তিকের কিরূপে জন্ম হৈল।।
সৌতি বলে, জরৎকারু বিবাহ করিয়া।
পূর্ব্ববৎ বনে বনে বেড়ায় ভ্রমিয়া।।
একদা ভগ্নীরে ডাকি বাসুকি কহিল।
কহ ভগ্নি মুনি-সহ কি কথা হইল।।
রক্ষন ভরণ মুনি করে কি তোমার।
সত্য করি কহ তুমি অগ্রেতে আমার।।
জরৎকারী বলে, আমি মুনি নাহি দেখি।
কোথা যায় কোথা থাকে বঞ্চি যে একাকী।।
এত শুনি বাসুকির বিষণ্ণ-বদন।
আর দিনে মুনির পাইল দরশন।।
বাসুকি বলেন, মুনি কর অবধান।
তোমাকে আপন ভগ্নী করিলাম দান।।
রাখিয়াছিলাম যত্নে তোমার কারণ।
বিবাহ করিয়া তারে করিবে পালন।।
মুনি বলে, মোর চিত্তে বিবাহ না ছিল।
পিতৃগণ-দুঃখে বিভা করিতে হইল।।
গৃহে বাস করিতে না লয় মোর মন।
শরীরে না সহে মোর কাহার বচন।।
তোমার ভগিনী সত্য করুক গোচরে।
কখন না কোন বাক্য বলিবে আমারে।।
যদি বলে ত্যজিব আমার সত্য-বাণী।
বাসুকি বলিল, সত্য যাহা বল মুনি।।
মম ভগ্নী করিবে অপ্রিয় যেই দিনে।
নিশ্চয় করিও ত্যাগ তাহারে সে দিনে।।
তবে ত বাসুকি গৃহ নির্ম্মাণ করিয়া।
বহু মণিরত্নে তাহা দিলেন ভরিয়া।।
পত্নী-সহ মুনি তথা করেন বসতি।
কতদিনে জরুৎকারী হৈল ঋতুমতী।।
ধরিল নাগিনী গর্ভ মুনির ঔরসে।
শশিকলা বাড়ে যেন দিবসে দিবসে।।
বহু সেবা করে কন্যা জানি মুনি-মন।
করযোড়ে সম্মুখেতে থাকে অনুক্ষণ।।
যখন যে আজ্ঞা করে জরৎকারু মুনি।
আজ্ঞামাত্র সেই কর্ম্ম করয়ে নাগিনী।।
হেনমতে বহু সেবা করে প্রতিদিনে।
দৈবে এক দিন দেখ দিবা অবসানে।।
মুনি নিদ্রাযুক্ত কন্যা-উরে শির দিয়া।
শয়ন করিয়া আছে অচেতন হৈয়া।।
নিদ্রা যায় মুনি, হৈল সন্ধ্যার সময়।
দেখিয়া নাগিনী মনে ভাবিলেক ভয়।।
অস্ত গেল দিনকর সন্ধ্যা যায় বৈয়া।
না বলিলে ক্রোধ মোরে করিবে জাগিয়া।।
নিদ্রাভঙ্গ হৈলে পাছে ক্রোধ করে মুনি।
হইল পরম চিন্তা এত সব গণি।।
যাহা করে করিবেক পরে মুনিরাজে।
সন্ধ্যা-ধর্ম্ম না রাখিলে হইবে অকাজ।।
অবহেলে যেই দ্বিজ সন্ধ্যা নাহি করে।
পঞ্চ মহাপাপ জন্মে তাহার শরীরে।।
এত ভাবি জরৎকারী বলিল ডাকিয়া।
উঠ সন্ধ্যা কর প্রভু সন্ধ্যা যায় বৈয়া।।
নিদ্রাভঙ্গ হৈয়া মুনি উঠে মহাকোপে।
লোহিত বরণ মুখ অধরোষ্ঠ কাঁপে।।
অমান্য করিলি মোরে করি অহঙ্কার।
এই দোষে তোর মুখ না দেখিব আর।।
জরৎকারী বলে, প্রভু মোর নাহি দোষ।
অকারণে মের প্রতি কেন কর রোষ।।
সন্ধ্যা বহি যায় প্রভু সূর্য্য গেল অস্ত।
সন্ধ্যাহীনে যত পাপ জানহ সমস্ত।।
সে কারণে নিদ্রাভঙ্গ করিনু তোমার।
তবে ত্যাগ কর দোষ বুঝিয়া আমার।।
মুনি বলে, নাগিনী বলিস না বুঝিয়া।
আমি সন্ধ্যা না করিলে যাবে কি বহিয়া।।
অরে অরে সন্ধ্যা তোর কেমন বিচার।
মোরে না বলিয়া যাহ বড় অহঙ্কার।।
সন্ধ্যা বলে মুনিরাজ না করিহ ক্রোধ।
এই যে আছি যে, আমি তব উপরোধ।।
মুনি বলে, নাগিনী শুনিলি নিজ কানে।
অবজ্ঞা করিলি মোরে কি সামান্য জ্ঞানে।।
নিশ্চয় ত্যজিয়া তোরে যাই আমি বন।
পুনরপি না দেখিব তোর এ বদন।।
মুনির নির্ঘাত বাক্য শুনিয়া সুন্দরী।
কান্দিতে কান্দিতে কহে চরণেতে ধরি।।
না জানিয়া করিলাম প্রভু অপরাধ।
এবার ক্ষমহ মোরে করহ প্রসাদ।।
ভাই সব শুনি মোর হইবে নিরাশ।
তোমারে দিলেক ভাই করি বড় আশ।।
মাতৃশাপে ভ্রাতৃ-মনে বড় ছিল ভয়।
তোমারে আমাকে দিয়া খণ্ডিল সংশয়।।
তোমার ঔরসে যেই হইবে নন্দন।
তাহা হৈতে রক্ষা পাবে মোর ভ্রাতৃগণ।।
বংশ না হৈতে তুমি যাহ যে ছাড়িয়া।
ভ্রাতৃগণে প্রবোধিব কি বোল বলিয়া।।।
নিশ্চয় ছাড়িয়া যদি যাবে তুমি মোরে।
শরীর ত্যজিব আমি তোমার গোচরে।।
এত শুনি সদয় হইল মুনিবর।
আশ্বাসিয়া কন্যার উদরে দিল কর।।
অস্তি অস্তি বলিয়া বুলায় গর্ভে হাত।
এই গর্ভে হবে পুত্র নাগ-কুল-নাথ।।
এই গর্ভে আছে যেই পুরুষ রতন।
তোমার আমার কুল করিবে রক্ষণ।।
চিন্তা ছাড়ি যাহ প্রিয়ে নিজ ভ্রাতৃগৃহে।
ভ্রাতৃগণ প্রবোধিবে যেন দুঃখী নহে।।
বলিলাম বাক্য মোর কভু মিথ্যা নয়।
ত্যজিলায় তোমারে যে জানিহ নিশ্চয়।।
এত বলি আশ্বাসিয়া নিজ বনিতায়।
গৃহ ত্যজি পুনঃ মুনি যান তপস্যায়।।
অব্যর্থ ব্রাহ্মণবাক্য অন্তরেতে গণি।
মুনিবরে কিছু আর না কহে নাগিনী।।
মস্তকে বন্দিয়া ব্রাহ্মণের পদরজ।
কহে কাশীরাম দাস গদাধরাগ্রজ।।