০২০. গজ-কচ্ছপের বিবরণ

বিভাবসু সুপ্রতীক দুই সহোদর।
মহাধনে ধনী দোঁহে মুনির কোঙর।।
শত্রুগণ দোঁহারে করিল ভেদাভেদ।
ধনের কারণে দোঁহে হইল বিচ্ছেদ।।
সুপ্রতীক কনিষ্ঠ সে পৃথক হইল।
আপনার সমুচিত বিভাগ মাগিল।।
শত্রুগণ বলিল, অনেক ধন আছে।
আপন উচিত ভাগ ছাড়ি দেহ পাছে।।
বিভাবসু জ্যেষ্ঠ কহে, এ ভাগ উহার।
অকারণে দ্বন্দ্ব করে সহিত আমার।।
দোঁহাকারে দুই রূপ কহে শত্রুগণে।
বহুদিন এই মত দ্বন্দ্ব দুই জনে।।
নিত্য আসি সুপ্রতীক প্রাতে মাগে ধন।
ক্রোধে বিভাবসা শাপ দিল ততক্ষণ।।
যে কিছু তোমার ভাগ তাহা দিনু আমি।
না লইয়া দ্বন্দ্ব কর পরবাক্যে তুমি।।
নিত্য আসি বিসম্বাদ কর মম সনে।
দিনু শাপ, গজ হৈয়া কর মম সনে।।
সুপ্রতীক বলে, মোরে ভাগ নাহি দিয়া।
শাপ দিলে, বল মোরে কিসের লাগিয়া।।
তুমিও কচ্ছপ হও জলের ভিতরে।
দুই জনে দুই শাপ দিলেক দোঁহারে।।
গজ গেল অরণ্যে, কচ্ছপ গেল জলে।
ভাই ভাই বিসম্বাদ কৈলে হে ফলে।।
পরবাক্যে যারা সব করে যে বিবাদ।
অতি ক্লেশ জন্মে তার, হয় ত প্রমাদ।।
সেই সে কচ্ছপ আছে জলের ভিতর।
যুড়িয়া যোজন দশ তার কলেবর।।
তাহার দ্বিগুণ দেহ করিবর ধরে।
নিত্য আসি যুদ্ধ করে সরোবর-তীরে।।
সেই গজ-কূর্ম্ম গিয়া করহ ভক্ষণ।
সর্ব্বত্র মঙ্গল হবে বিনতা-নন্দন।।
সমরে প্রবৃত্ত হৈলে দেবগণ সনে।
বেদহবীরহস্য রাখিবে তোমা ধনে।।
ত্রিভুবন বিজয়ী হও মহাবীর।
ব্রহ্মা বিষ্ণু শিব তব রাখুন শরীর।।
কশ্যপের আজ্ঞা পেয়ে গরুড় সত্বর।
চক্ষুর নিমিষে গেল যথা সরোবর।।
অন্তরীক্ষ হৈতে দেখি বিনতা-কোঙর।
বন হইতে বাহির হৈল গজবর।।
সরোবর-তীরে আসি করিল গর্জ্জন।
ক্রোধ করি কূর্ম্ম দেখা দিলেক তখন।।
দুই জনে মহাযুদ্ধ, কহনে না যায়।
অন্তরীক্ষে থাকি তাহা দেখে খগরায়।।
এক নখে গজে ধরি কূর্ম্ম আর নখে।
চক্ষুর নিমিষে উড়ি গেল তপঃলোকে।।
কোথায় খাইব বসি ভাবে মনে মন।
নানাজাতি বৃক্ষ দেখে পরশে গগন।।
এক বটবৃক্ষ তথা অতি উচ্চতর।
দেখিয়া গরুড়ে ডাকি বলিল উত্তর।।
মোর ডাল দেখ শতযোজন বিস্তার।
সুস্থ হয়ে ইথে বসি করহ আহার।।
বৃক্ষের বচন শুনি বিনতা-নন্দন।
ডালেতে বসিল গিয়া করিতে ভক্ষণ।।
ভাঙ্গিল বৃক্ষের ডাল গরুড়ের ভরে।
বালখিল্য-মুনিগণ তাহে তপ করে।।
শাখা করি অধোমুখে আছে মুনিগণ।
দেখিয়া হইল ভীত বিনতা-নন্দন।।
ভূমিতে ফেলিলে ডাল মরিবেক মুনি।
ঠোঁটেতে ধরিল ডাল, মনে ভয় গণি।।
ঠোঁটেতে ধরিল ডাল, গজ-কূর্ম্ম নখে।
উড়িয়া বেড়ায় পক্ষী, উপায় না দেখে।।
বহুদিন গরুড় উড়িল হেনমতে।
কশ্যপে দেখিল গন্ধমাদন-পর্ব্বতে।।
গরুড়ের মুখে ডাল দেখি বিপরীত।
বালখিল্য মুনিগণ তাহে বিলম্বিত।।
কশ্যপ বলেন, পুত্র করিলা কি কাজ।
হের দেখ ডালে আছে মুনির সমাজ।।
অঙ্গুষ্ঠ প্রমাণ ষাটি-সহস্র ব্রাহ্মণ।
উপায় করহ, ক্রোধ নহে যতক্ষণ।।
তবে ত কশ্যপ মুনি করি যোড় কর।
মুনিগণ প্রতি স্তুতি করিলা বিস্তর।।
এই ত গরুড় হয় সবাকার হিত।
সে কারণে ক্রোধ তারে না হয় উচিত।।
কশ্যপের স্তবে তুষ্ট হয়ে ঋষিগণ।
হিমগিরি পরে সবে করিল গমন।।
তবে খগেশ্বর জিজ্ঞাসিল কশ্যপেরে।
কোথায় ফেলিব ডাল আজ্ঞা কর মোরে।।
কাশ্যপ বলিল, যাও ঋষ্য-শৃঙ্গ-গিরি।
জীবজন্তু নাহি সেই পর্ব্বত উপরি।।
কশ্যপের আজ্ঞা-ক্রমে বীর খগেশ্বর।
ফেলিল সে ডাল লয়ে পর্ব্বত উপর।।
গজ-কূর্ম্ম খাইলেক পর্ব্বতে বসিয়।
অমৃত আনিতে যায় তৃপ্তমনা হৈয়া।।
মহাতেজে গগনে উঠিল মহাবল।
পাখসাটে উড়ি গেল পর্ব্বত সকল।।
দিনকর আচ্ছাদিল হৈল অন্ধকার।
অমর-নগরে হৈল উৎপাত অপার।।
উল্কাপাত নির্ঘাত হইছে ঘন-ঘন।
ঘোর বায়ু, মেঘে করে রক্ত বরিষণ।।
ইহা দেখি ইন্দ্র বৃহস্পতিরে পুছিল।
এত অমঙ্গল কেন স্বর্গেতে হইল।।
বৃহস্পতি বলিল, তোমার পূর্ব্ব পাপে।
আসিছে গরুড়-পক্ষী অদ্ভুত-প্রতাপে।।
সুধার কারণে আসে বিনতা-নন্দন।
অবশ্য লইবে সুধা জিনি দেবগণ।।
এত শুনি কুপিত হইল পুরন্দর।
ততক্ষণে আজ্ঞা দিল ডাকি অনুচর।।
পাইয়া ইন্দ্রের আজ্ঞা যত দেবগণ।
সসজ্জ হইল সবে করিবারে রণ।।
মুনিগণ বলে, শুন সূতের নন্দন।
ইন্দ্রের হইল পাপ কিসের কারণ।।
কশ্যপ ব্রাহ্মণ-শ্রেষ্ঠ বিদিত ভুবনে।
তাঁর পুত্র পক্ষী হৈল কিসের কারণে।।
কামরূপী পক্ষী সেই মহাবলবন্ত।
কি হেতু হইল কহ পূর্ব্বের বৃত্তান্ত।।
সৌতি কহে, সেই কথা কহিত বিস্তার।
সংক্ষেপে কহি যে কিছু শুন সারোদ্ধার।।
মহাভারতের কথা অমৃত-সমান।
কাশীরাম দাস কহে শুনে পুণ্যবান।।