০১৯. সুধা আনিতে গরুড়ের স্বর্গে গমন

অরুণে লইয়া তবে বিনতা-নন্দন।
সূর্য্যরথে যত্ন করি করিল স্থাপন।।
সপ্ত-অশ্ব করিয়ালি ধরি বাম হাতে।
রহিল অরুণ সে সারথি হৈয়া রথে।।
সূর্য্যরথে সহোদরে রাখ পক্ষিরাজ।
জননীর ঠাঁই গেল ক্ষীর-সিন্ধু-মাঝ।।
দুঃখিত জননী দেখি মলিন-বদন।
মায়ের চরণ গিয়া করিল বন্দন।।
পুত্রে দেখি বিনতার খণ্ডিল বিষাদ।
স্নেহবাক্যে গুরুড়ের করে আশীর্ব্বাদ।।
হেনকালে কদ্রু ডাকি বলে বিনতারে।
রম্যদ্বীপে লয়ে চল কান্ধে করি মোরে।।
রম্যক দ্বীপেতে মোর পুত্রের আলয়।
ত্বরিতে লইয়া চল বিলম্ব না সয়।।
কদ্রুরে লইল কান্ধে বিনতা সুন্দরী।
নাগগণে গরুড় লইল কান্ধে করি।।
নাগগণে কান্ধে করি গরুড় উড়িল।
চক্ষুর নিমিষে সূর্য্য-মণ্ডলে উঠিল।।
সূর্য্যের কিরণে পোড়ে যত নাগগণ।
নাগ-মাতা দেখে পুড়ি মরিছে নন্দন।।
পুড়ি মরে নাগগণ, নাহিক উপায়।
আকুল হইয়া কদ্রু স্মরে দেবরায়।।
ত্রৈলোক্যের নাথ তুমি দেব শচীপতি।
আমার কুমারগণে কর অব্যাহতি।।
বহুবিধ স্তুতি কদ্রু কৈল পুরন্দরে।
ইন্দ্র ডাকি আজ্ঞা কৈল সব জলধরে।।
ততক্ষণে মেঘগণ ঢাকিল আকাশ।
জলবৃষ্টি করিয়া ভরিল দিশপাশ।।
তবে খগপতি সব লৈয়া নাগগণে।
রম্যক দ্বীপেতে বীর গেল ততক্ষণে।।
নাগের আলয় দ্বীপ অতি মনোহর।
কাঞ্চনে মণ্ডিত গৃহ প্রবাল প্রস্তর।।
ফল-ফুলে সুশোভিত চন্দনের বন।
মলয়-সুগন্ধি-বায়ু বহে অনুক্ষণ।।
আপনার আলয়ে বসিল নাগগণ।
গরুড়ে চাহিয়া তবে বলিল বচন।।
উড়িবার বড় শক্তি আছয়ে তোমার।
চড়িয়া তোমার কান্ধে করিব বিহার।।
আর এক দ্বীপে লয়ে চল খগেশ্বর।
শুনিয়া গরুড় গেল মায়ের গোচর।।
গরুড় বলিল, মাতা কহ বিবরণ।
পুনরপি কান্ধে নিতে বলে নাগগণ।।
প্রভু যেন আজ্ঞা করে সেবা করিবারে।
কি হেতু এমন বোল বলে বারে বারে।।
একবার কান্ধে কৈনু তোমার আজ্ঞায়।
পুনরপি বলে মোরে, সহনে না যায়।।
বিনতা বলেন, পুত্র দৈবের লিখন।
আমি কদ্রু-দাসী, তুমি দাসীর নন্দন।।
গরুড় বলিল, মাতা কহ বিবরণ।
তুমি তার দাসী হৈলা কিসের কারণ।।
বিনতা কহিল, পূর্ব্বে সপত্নীর সনে।
উচ্চৈঃশ্রবা তরে হই পরাজিতা পণে।।
সেই হৈতে দাসীবৃত্তি করি তার আমি।
তে কারণে দাসীপুত্র হৈলে বাপু তুমি।।
এত শুনি মহাক্রোধ করিল সুপর্ণ।
সঘনে নিশ্বাস ছাড়ে চক্ষু রক্তবর্ণ।।
মায়ে এড়ি গেল সৎ-মায়ের নিকটে।
কদ্রুর অগ্রেতে বীর কহে করপুটে।।
আজ্ঞা কর জননী গো, করি নিবেদন।
কিমতে মায়ের হয় দাসীত্ব-মোচন।।
কদ্রু বলে মুক্ত যদি করিবে জননী।
সুরলোক হৈতে সুধা মোরে দেহ আনি।।
তাহা শুনি খগবর আনন্দিত অতি।
মায়ের নিকটে বীর গেল শীঘ্রগতি।।
যা বলিল সৎ-মাতা মায়েরে কহিল।
না ভাবিহ আর, দুঃখ-অবসান হৈল।।
এখনি আনিব সুধা চক্ষু পালটিতে।
ক্ষুধায় উদর জ্বলে, দেহ কিছু খেতে।।
জননী বলিল, যাহ সমুদ্রের তীরে।
খাও গিয়া যত বৈসে নিষাদ-নগরে।।
কিন্তু কহি তাহে এক দ্বিজবর আছে।
বুঝিয়া খাইবে বাপু, দ্বিজে খাও পাছে।।
অবধ্য ব্রাহ্মণ জাতি, কহিনু তোমারে।
ক্ষুধায় আকুল বাছা, খাও পাছে তারে।।
অগ্নি সূর্য্য বিষ হৈতে আছে প্রতিকার।
ব্রাহ্মণের ক্রোধে বাছা নাহিক নিস্তার।।
গরুড় বলিল, যদি তাদৃশ ব্রাহ্মণ।
কিবা চিহ্ন ধরে দ্বিজ, কেমন লক্ষণ।।
বিনতা বলিল, তুমি ক্ষুধায় আকুল।
চিনিয়া খাইতে দুঃখ পাইবে বহুল।।
খাইতে তোমার কণ্ঠ জ্বলিবে যখন।
নিশ্চয় জানিবে পুত্র সেই সে ব্রাহ্মণ।।
এত বলি বিনতা করিল আশীর্ব্বাদ।
যাও পুত্র, অমৃত আনহ অপ্রমাদ।।
ইন্দ্র যম আদিত্য কুবের হুতাশন।
তোমারে জিনিতে শক্ত নহে কোন জন।।
এত বলি খগবরে করিল মেলানি।
মায়ে প্রণমিয়া বীর উড়িল তখনি।।
গরুড় উড়িতে তিন ভুবন কাঁপিল।
প্রলয়ের কালে যেন সিন্ধু উথলিল।।
পাখসাটে পর্ব্বত উড়িয়া যায় দূরে।
গর্জ্জনে লাগিল তালা সুরাসুর-নরে।।
কৈবর্ত্তের দেশ দেখি মুখ বিস্তারিল।
প্রশ্বাস সহিত সব মুখে প্রবেশিল।।
আছিল ব্রাহ্মণ এক তাহার ভিতরে।
অগ্নির সমান জ্বলে গরুড়-উদরে।।
গরুড় স্মরিল, তবে মায়ের বচন।
ডাকিয়া বলিল, শীঘ্র নিঃসর ব্রাহ্মণ।।
ব্রাহ্মণ বলিল, নিঃসরিব কি প্রকারে।
ভার্য্যা মোর পুড়ি মরে তোমার উদরে।।
কৈবর্ত্তিনা ভার্য্যা মোর প্রাণের সমান।
ভার্য্যার বিহনে আমি না রাখিব প্রাণ।।
গরুড় বলিল, মোর দ্বিজ বধ্য নহে।
ত্বরিতে নিঃসর, অগ্নি যাবৎ না দহে।।
ধরিয়া ভার্য্যার হাত এস হে বাহিরে।
এত শুনি ধরে দ্বিজ কৈবর্ত্তিনী-করে।।
লইয়া আপন ভার্য্যা হইল বাহির।
অন্তরীক্ষে উড়িল গরুড় মহাবীর।।
হেনকালে গরুড়েরে কশ্যপ দেখিল।
আশীর্ব্বাদ করিয়া কুশল জিজ্ঞাসিল।।
গরুড় বলিল, তাত আছি যে কুশলে।
সকলি কুশল, মাত্র ভক্ষ্য নাহি মিলে।।
মাতৃ-বোলে খাইলাম নিষাদ-নগর।
না হইল ক্ষুধা-শান্তি, পুড়িছে উদর।।
বিমাতার বাক্যে যাই অমৃত আনিতে।
ক্ষুধায় অবশ তনু জ্বলি অন্তরেতে।।
তুমি তাত কিছু মোরে দেহ খাইবারে।
ভাল করি দেহ গো উদর যেন পূরে।।
কশ্যপ বলিল, তবে শুন পুত্রবর।
দেব নরে বিখ্যাত আছয়ে সরোবর।।
গজ-কূর্ম্ম দুইজন তথা যুদ্ধ করে।
তাহার বৃত্তান্ত শুন আমার গোচরে।।