০১২. পুনর্ব্বার সিন্ধু-মন্থন ও মহাদেবের বিষপান

করযোড়ে দাঁড়াইল সব দেবগণে।
শিব বলে মথ সিন্ধু, থামাইলে কেনে।।
ইন্দ্র বলে, মথন হইল দেব শেষ।
নিবারিয়া আপনি গেলেন হৃষীকেশ।।
একে ক্রোধে আছিলেন দেব-মহেশ্বর।
তাহাতে ইন্দ্রের বাক্যে কম্পে কলেবর।।
শিব বলে, এত গর্ব্ব তোমা সবাকার।
আমারে হেলন কর করি অহঙ্কার।।
রত্নাকর মথি রত্ন নিলা সবে বাঁটি।
কেহ চিত্তে না করিলা আছয়ে ধূর্জ্জটি।।
যা করিলা তাহা কিছু নাহি করি মনে।
আমি মথিবারে বলি করহ হেলনে।।
এতেক বলিলা যদি দেব-মহেশ্বর।
ভয়েতে দেবেরা কেহ না কৈল উত্তর।।
নিঃশব্দে রহিল যত দেবের সমাজ।
করযোড়ে বলয়ে কশ্যপ মুনিরাজ।।
অবধান কর দেব পার্ব্বতীর কান্ত।
কহিব ক্ষীরোদ-সিন্ধু মথন বৃত্তান্ত।।

পারিজাত মাল্য দুর্ব্বাসার গলে ছিল।
স্নেহে সেই মাল্য মুনি ইন্দ্র-গলে দিল।।
গজরাজ আরোহণে ছিল পুরন্দর।
সেই মাল্য দিল তার দন্তের উপর।।
সহজে মাতঙ্গ অনুক্ষণ মদে মত্ত।
পশুজাতি নাহি জানে মালা মুনিদত্ত।।
শুণ্ডে জড়াইয়া মালা ফেলিল ভূতলে।
দেখিয়া দুর্ব্বাসা ক্রোধে অগ্নি-সম জ্বলে।।
অহঙ্কারে ইন্দ্র মোরে অবজ্ঞা করিল।
মোর দত্ত পুষ্পমাল্য ছিঁড়িয়া ফেলিল।।
সম্পদে হইয়া মত্ত তুচ্ছ কৈল মোরে।
দিল শাপ হবে হতলক্ষ্মী পুরন্দরে।।
ব্রহ্মশাপে লোকমাতা প্রবেশিলা জলে।
লক্ষ্মী-বিনা কষ্ট হৈল ত্রৈলোক্য-মণ্ডলে।।
লোকের কারণে ব্রহ্মা কৃষ্ণে নিবেদিল।
সমুদ্র মথিতে আজ্ঞা নারায়ণ কৈল।।
এই হেতু ক্ষীরোদ মথিলা পুরন্দর।
শেষ মথনের দড়ি, মথনি মন্দর।।
অনেক উৎপাত হৈল বরুণের পুরে।
লক্ষ্মী দিয়া আসি স্তব কৈল গদাধরে।।
নিবারিয়া মথন গেলেন নারায়ণ।
পুনঃ তুমি আজ্ঞা কর মথন-কারণ।।
বিষ্ণু বলে বড় বলী আছিল অমর।
এবে বিষ্ণু বিনা শ্রান্ত সব কলেবর।।
দ্বিতীয়ে মথন-দড়ি নাগরাজ শেষ।
সাক্ষাতে আপনি দেব দেখ তার ক্লেশ।।
অঙ্গের যতেক হাড় সব হৈল চূর।
সহস্র-মুখেতে লাল বহিছে প্রচুর।।
বরুণের যত কষ্ট না যায় কথন।
আর আজ্ঞা নাহি কর করিতে মথন।।

শিব বলে, আমা হেতু মথ একবার।
আগমন অকারণ না হৌক্ আমার।।
শিব-বাক্য কার শক্তি লঙ্ঘিবারে পারে।
পুনরপি মথন করিল সুরাসুরে।।
শ্রমেতে অশক্ত-কলেবর সর্ব্বজনা।
ঘনশ্বাস বহে যেন আগুনের কণা।।
অত্যন্ত ঘর্ষণে তবে মন্দর পর্ব্বত।
সুতপ্ত হইল গিরি মহা অগ্নিবৎ।।
ছিণ্ডি খণ্ড খণ্ড হৈল নাগের শরীর।
ক্ষীরোদ-সমুদ্রে সব বহিল রুধির।।
অত্যন্ত ঘর্ষণ নাগ সহিতে নারিল।
সহস্র-মুখের পথে গরল বহিল।।
সিন্ধুর ঘর্ষণ-অগ্নি সর্পের গরল।
দেবের নিশ্বাস-অগ্নি, মন্দর-অনল।।
চারি অগ্নি মিশ্রিত হইয়া এক হৈল।
সিন্ধু হতে আচম্বিতে বাহির হইল।।
প্রাতঃ হৈতে দিনকর তেজ যেন বাড়ে।
দাবানল-তেজে যেন শুষ্ক বন পোড়ে।।
যুগান্তের কালে যেন সমুদ্রের জল।
মুহূর্ত্তে ব্যাপিল তথা সংসার সকল।।
দহিল সবার অঙ্গ বিষের জ্বলনে।
সহিতে না পারি ভঙ্গ দিল সর্ব্বজনে।।
পলায় সহস্রচক্ষু কুবের বরুণ।
প্রলয় সমান অগ্নি দেখিয়া দারুণ।।
অষ্টবসু নবগ্রহ অশ্বিনী-কুমার।
অসুর রাক্ষস যক্ষ যত ছিল আর।।
পলাইয়া গেল যত ত্রৈলোক্যের জন।
বিষণ্ন বদনে তবে চাহে ত্রিলোচন।।
দূরে থাকি দেবগণ সবে করে স্তুতি।
রক্ষা কর ভূতনাথ অনাথের গতি।।
তোমা বিনা রক্ষাকর্ত্তা নাহি দেখি আন।
সংসার হইল নষ্ট তোমা বিদ্যমান।।
রাখ রাখ বিশ্বনাথ, বিলম্ব না সয়।
ক্ষণেক রহিলে আর হইবে প্রলয়।।
দেবের বিষাদ দেখি কাকুতি-স্তবন।
বিষে দগ্ধ হয়ে সৃষ্টি দেখি ত্রিলোচন।।
বিশেষে চিন্তেন পূর্ব্বকৃত অঙ্গীকার।
এবার মথনে সিন্ধু-রত্ন যে আমার।।
আপন অর্জ্জিত তাহে সৃষ্টি করে নাশ।
হৃদয়ে চিন্তিয়া আগু হেন কৃত্তিবাস।।
সমুদ্র জুড়িয়া বিষ আকাশ পরশে।
আকর্ষণ করি হর নিলেন গণ্ডূষে।।
দূরে থাকি সুরাসুর দেখয়ে কৌতুকে।
করিলেন বিষপান একই চুমুকে।।
অঙ্গীকার-পালন স্বধর্ম্ম দেখাবারে।
কণ্ঠেতে রাখেন বিষ, না লন উদরে।।
নীলবর্ণ কণ্ঠ অদ্যাপিহ বিশ্বনাথ।
নীলকণ্ঠ নামে তাই হইল বিখ্যাত।।
আশ্চর্য্য দেখিয়া যত ত্রৈলোক্যের জন।
কৃতাঞ্জলি করি হরে করেন স্তবন।।
তুমি ব্রহ্মা, তুমি বিষ্ণু, ধনের ঈশ্বর।
যম সূর্য্য বায়ু সোম তুমি বৈশ্বানর।।
তুমি শেষ বরুণ নক্ষত্র বসু রুদ্র।
তুমি স্বর্গ ক্ষিতি অধঃ পর্ব্বত সমুদ্র।।
যোগ জ্ঞান বেদ শাস্ত্র তুমি যজ্ঞ জপ।
তুমি ধ্যান ধারণা, তুমি সে উগ্রতপ।।
অকালে করিলে তুমি এ মহাপ্রলয়।
কি করিব আজ্ঞা এবে দেহ মৃত্যুঞ্জয়।।
এত শুনি আজ্ঞা দিল দেব মহেশ্বর।
রাখ নিয়া যথাস্থানে আছিল মন্দর।।
মথন-নিবৃত্তি কর, নাহি আর কাজ।
অনেক পাইলে কষ্ট দেবের সমাজ।।
এত শুনি আনন্দিত হৈল দেবগণ।
মন্দর লইতে সবে করিল যতন।।
অমর তেত্রিশ কোটি অসুর যতেক।
মন্দর তুলিতে যত্ন করিল অনেক।।
কারো শক্তি নহিল তুলিতে গিরিবর।
তুলিয়া লইল গিরি শেষ বিষধর।।
যথাস্থানে মন্দর থুইল লয়ে শেষ।
নিবারিয়া গেল সবে যার যেই দেশ।।
কাশীরাম দাস কহে করিয়া মিনতি।
অনুক্ষণ নীলকণ্ঠ পদে থাক্ মতি।।
মহাভারতের কথা সুধা হৈতে সুধা।
করিলে শ্রবণে পান যায় ভব-ক্ষুধা।।