১৭. অর্জ্জুনের সহিত হনুমানের বিবাদ বিবরণ ও অর্জ্জুনের শর দ্বারা সাগর বন্ধন কথন

শিবিরেতে গিয়া যুধিষ্ঠির মহাশয়।
কহেন গোবিন্দে অতি করিয়া বিনয়।।
করিছেন পিতামহ সৈন্যের নিধন।
কি করি উপায় এবে কহ নারায়ণ।।

অর্জ্জুন বলেন শুন ধর্ম্ম নৃপবর।
অমঙ্গল চিন্তা কেন কর নিরন্তর।।
তীর্থ পর্য্যটনে আমি গেলাম যখন।
ভ্রমিতে ভ্রমিতে যাই দ্বারকাভুবন।।
সুগন্ধি কনকপদ্ম গন্ধে মনোহর।
সত্রাজিত নন্দিনীকে দেন দামোদর।।
দেখিয়া রুক্মিনী মনে ক্রোধ যে করিল।
শরীর ত্যজিব মনে হেন বিচারিল।।
এ সব বৃত্তান্ত জানিলেন নারায়ণ।
পুষ্পহেতু মোরে আজ্ঞা দিলেন তখন।।
আমি কহিলাম পুষ্প আছে কোন্ খানে।
হরি কহিলেন আছে কদলীর বনে।।
সেইক্ষণে ধনুর্ব্বাণ লইলাম আমি।
গেলাম কদলীবনে অতি শীঘ্রগামী।।
ভ্রমিতে ভ্রমিতে দেখি পুষ্প মনোহর।
রক্ষক রয়েছে চারি মর্কট বানর।।
পুষ্প তুলিবারে আমি যাইনু যখন।
দেখিয়া তাহারা মোরে করিল বারণ।।
না মানিয়া পুষ্প আমি তুলি নিজ মনে।
দেখিয়া ছুটিয়া তারা গেল চারিজনে।।
গিয়া হনুমাণে সব কহে সমাচার।
শ্রুতমাত্র আসে তথা পবন কুমার।।
আমারে দেখিয়া বলে হয়ে ক্রোধ মন।
অন্যায়ী কিরাত চোর শুন রে বচন।।
যাইবে শমন পুরী ইচ্ছা হৈল তোর।
সে কারণে পুষ্প তোল উদ্যানেতে মোর।।
ইন্দ্র চন্দ্র দেবগণ নাহি আসে ডরে।
অধম কিরাত কেন এলে মরিবারে।।
নিত্য নিত্য পূজা আমি করি রঘুবীর।
যাঁহার প্রসাদে মোর অক্ষয় শরীর।।

আমি কহিলাম, তুই জাতিতে বানর।
বনফল খেয়ে ভ্রম বনের ভিতর।।
নাহি জানি কটু কথা বলিস আমারে।
যদি প্রাণে মারি তোরে কে রাখে সংসারে।।
বড় বীর বলি মনে কর রঘুনাথ।
সংসারেতে তাঁর বল আছয়ে বিখ্যাত।।
বানর পাথর বহি সাগর বান্ধিল।
তবে সে কটক লয়ে পার হয়ে গেল।।
শরেতে আপনি যদি বান্ধিত সাগর।
তবে আমি কহিতাম তাঁরে বীরবর।।

ক্রোধে হনু বলে, শুন কিরাত অধম।
ত্রিভুবনে খ্যাত যত রামের বিক্রম।।
হরধনু ভাঙ্গিলেন যিনি অবহেলে।
পরশুরামেরে যিনি জিনিলেন বলে।।
শরেতে সাগর বান্ধা তাঁর চিত্র নহে।
কটকের মহাভার কি প্রকারে সহে।।
সে কারণে বান্ধিলেন পাষাণে সাগর।
রামের করহ নিন্দা অধম পামর।।
ইহার উচিত ফল পাবে মোর ঠাঁই।
পড়িলে আমার হাতে অব্যাহতি নাই।।
তুমি যদি মহাবীর বড় ধনুর্দ্ধর।
শরেতে সাগর বান্ধি কর মোরে পার।।
আমার ভারেতে যদি তব বাঁধ রয়।
তবে ত হইবে সখা এ কথা নিশ্চয়।।
যদ্যপি আমার ভারে বাঁধ হয় ভঙ্গ।
সাক্ষাতে তোমারে আজি দেখাইব রঙ্গ।।

আমি কহিলাম যদি বান্ধি হে সাগর।
তোমারে কি গণি পার হয় চরাচর।।
তোমার ভরেতে যদি মম বাঁধ ভাঙ্গে।
তবে পরাজিত আমি হইব তব আগে।।
সগার তীরেতে তবে গেনু দুই জন।
ধনুকে টঙ্কার আমি দিলাম তখন।।
বৃষ্টি ধারাবৎ অস্ত্র হইল বর্ষণ।
পদ্ম শঙ্খ আদি বাণ কে করে গণন।।
নিমেষেতে বান্ধিলাম শতেক যোজন।
দেখি বাঁধ হনুমান সবিস্ময় মন।।
জানি যে কিরাত নহে হবে কোন জন।
কোন দেবতার ক্রোধে পড়িনু এখন।।
এতেক ভাবিয়া বীর বলে মোরে হাসি।
ক্ষণেক বিলম্ব কর শীঘ্র আমি আসি।।

এত বলি উত্তরেতে চলে মহাবীর।
বাড়াইল উভে লক্ষ যোজন শরীর।।
লোমে লোমে মহাবীর পর্ব্বত বান্ধিল।
পর্ব্বত স্কন্ধেতে কত শত তুলি নিল।।
মহাবেগে আসে বীর কৃতান্ত আকার।
লুকাইল রবিতেজ হৈল অন্ধকার।।
নিরখিয়া দেখি রূপ অতি ভয়ঙ্কর।
হনুমানে হেরি মম কাঁপিল অন্তর।।
মহাভয় পেয়ে আমি স্মরি মনে মন।
অন্তর্য্যামী সব জানিলেন নারায়ণ।।
হনুমান অর্জ্জুনেতে হৈল বিসংবাদ।
মহাবীর হনুমান ‍পাড়িল প্রমাদ।।
এতেক চিন্তিয়া প্রভু আসিয়া ত্বরিতে।
রহে কচ্ছপ রূপে বাঁধের নীচেতে।।
কোপে হনুমান ডাকি আমাপ্রতি বলে।
এবে বাঁধ কর রক্ষা প্রতিজ্ঞা করিলে।।
বিপদেতে আমি পড়ি সাহস করিলাম।
নিঃশঙ্কাতে হও পার ডাকি বলিলাম।।
হনুমান ভরে কম্পমানা বসুমতী।
বান্ধে এক পদ দিল হয়ে ক্রুদ্ধ অতি।।
আর পদ তুলি দেয় যেমন সুধীর।
কচ্ছপের মুখ হইতে বহিল রুধির।।
হইল লোহিত বর্ণ সাগরের জল।
তাহা দেখি সচিন্তিত হৈল মহাবল।।
পৃথিবী সহিতে মোর ভয় নাহি পারে।
শর বাঁধ কি প্রকারে রহিল সাগরে।।
কেন বা এ রক্তবর্ণ সাগরের নীর।
এতেক চিন্তিয়া জ্ঞান দৃষ্টি করে বীর।।
জানিল ধ্যানেতে প্রভু বাঁধের নীচেতে।
লাফ দিয়া তটে পড়ে অতি ভীত চিতে।।
বান্ধের নীচেতে প্রভু রঘুকুলমণি।
আমি পশু মূঢ়মতি ইহা নাহি জানি।।
অজ্ঞান অধম আমি বড়ই বর্ব্বর।
না জানিয়া আরোহিনু প্রভুর উপর।।
তবে ত কচ্ছপ রূপ ত্যজিয়া শ্রীহরি।
নবদুর্ব্বাদল শ্যাম হন ধনুর্দ্ধারী।।
হনুমান প্রতি তবে বলেন বচন।
আমার পরম ভক্ত তোমরা দুজন।।
দুইজনে প্রীতি কর ছাড় মনে রোষ।
আমারে করহ ক্ষমা অর্জ্জুনের দোষ।।
কৃতাঞ্জলি বলে হনু করিয়া বিনয়।
অপরাধ ক্ষম মোর ওহে দয়াময়।।
শুনি হরি উভয়ের সখ্য করাইয়া।
উভয়েরে শান্ত করি গেলেন চলিয়া।।
আমা চাহি হনুমান বলেন বচন।
তুমি আমি সখা হইলাম দুইজন।।
তোমার সহায় আমি সদাই থাকিব।
সমর স্ঙ্কটে তব সাহায্য করিব।।
এতেক বলিয়া বীর গেলেন উত্তর।
পুষ্প লয়ে আসিলাম দ্বারকা নগর।।
বড় বড় সঙ্কটেতে রাখিলেন মোরে।
কেন বৃথা ধর্ম্ম রাজ চিন্তিছ অন্তরে।।
এত বলি প্রবোধেন পার্থ ধর্ম্মনৃপে।
রজনী বঞ্চেন নানা কথায় আলাপে।।
মহাভারতের কথা অমৃত-সমান।
কাশীরাম দাস কহে, শুনে পূণ্যবান।।