২৫. কৃষ্ণের প্রতি শোকসন্তপ্তা গান্ধারীর অভিশাপ

২৫তম অধ্যায়

কৃষ্ণের প্রতি শোকসন্তপ্তা গান্ধারীর অভিশাপ

“হে কৃষ্ণ! ঐ দেখ, বৃষভস্কন্ধ দুর্দ্ধর্ষ কাম্বোজরাজ নিহত হইয়া ধূলিশয্যায় শয়ান রহিয়াছেন। উনি পুরের্ব্ব কাম্বোজদেশীয় মহার্হ। আস্তরণমণ্ডিত শয্যায় শয়ন করিতেন। ওই দেখ, উহার বনিতা প্রিয়তমের চন্দনচর্চিত বাহুদ্বয় শোণিতলিপ্ত দেখিয়া শোকা কুলিতচিত্তে বিলাপবাক্যে কহিতেছে, ‘হা নাথ! তোমার এই সুন্দর। অঙ্গুলিসমন্বিত বাহুদ্বয় পরিঘতুল্য ছিল। পূর্বে যখন আমি তোমার এই ভুজদ্বয়ের মধ্যে অবস্থান করিতাম, তখন রতি আমাকে এক মুহূর্ত্তও পরিত্যাগ করিত না। এক্ষণে তোমার অভাবে আমার কি গতি হইবে?’ কাম্বোজরাজমহিষী এই বলিয়া অনাথার ন্যায় মধুরস্বরে রোদন করিয়া বিকম্পিত হইতেছে। ঐ দেখ, কলিঙ্গরাজের উভয়পার্শ্বে সমবস্থিত কামিনীগণ দিব্যমাল্যের ন্যায় আতপতাপিত হইয়াও শ্রীভ্রষ্ট হইতেছে না। ঐ দেখ, মগধদেশীয় রমণীগণ প্রদীপ্তাঙ্গদধারী মগধরাজ জয়ৎসেনের চতুর্দ্দিক পরিবেষ্টন করিয়া রোদন করিতেছে। ঐ বিশাললোচনা সুস্বরসম্পন্না রমণীগণের শ্রুতিসুখকর মধুরনিনাদে আমার অন্তঃকরণ বিমোহিতপ্রায় হইতেছে। ঐ কামিনীগণ পূর্বে মহামূল্য আস্তরণমণ্ডিত শয্যায় শয়ন করিত। এক্ষণে উহারা শোকাকুলিত চিত্তে আভরণসকল ইতস্ততঃ নিক্ষেপ করিয়া রোদন করিতে করিতে ধরাতলে নিপতিত হইতেছে। ঐ দেখ, কোশলরাজপুত্র বৃহদ্বলের নারীগণ পতিকে পরিবেষ্টনপূর্ব্বক রোদন করিতেছে এবং ব্যাকুলমনে উহার হৃদয়গত শরজাল উদ্ধৃত করিতে করিতে বারংবার মূর্চ্ছিত হইতেছে। আতপতাপ ও পরিশ্রমে উহাদিগের মুখমণ্ডল ম্লান হইয়া গিয়াছে। ঐ দেখ, ধৃষ্টদ্যুম্নের সুবর্ণমাল্যধারী অঙ্গদসমলঙ্কৃত অল্পবয়স্ক আত্মজগণ নিহত হইয়া সমরাঙ্গনে শয়ান রহিয়াছে। উহার পাবকতুল্য প্রতাপশালী দ্রোণের বাণপথে পতিত হইয়া শলভের ন্যায় নিহত হইয়াছে। ঐ দেখ, রুচিরাঙ্গদধারী কেকয়দেশীয় পাঁচভ্রাতা দ্রোণশরে নিহত ও সমরশয্যায় শয়ান হইয়া প্রজ্বলিত পাবকের ন্যায় শোভা পাইতেছেন। উহাদের তপ্তকাঞ্চননির্মিত বর্ম্ম, বিচিত্র ধ্বজ, রথ ও মাল্যের প্রভাবে সমরাঙ্গন দেদীপ্যমান হইয়াছে। ঐ দেখ, পাঞ্চালরাজ দ্রুপদ অরণ্যমধ্যে সিংহনিপাতিত মত্তমাতঙ্গের ন্যায় দ্রোণশরে নিহত হইয়া ধরাতলে শয়ান রহিয়াছেন। উঁহার সুনির্ম্মল পাণ্ডুবর্ণ আতপত্র শরৎকালীন নিশাকরের ন্যায় শোভা পাইতেছে। ঐ পাঞ্চালরাজের পুত্রবধূ ও ভাৰ্য্যারা দুঃখিতমনে উহার মৃতদেহ দগ্ধ করিয়া দক্ষিণদিক্‌ দিয়া গমন করিতেছে।

“ঐ দেখ, চেদিদেশাধিপতি মহাবীর ধৃষ্টকেতু অসংখ্য শত্রু সংহারপূর্ব্বক, স্বয়ং দ্রোণশরে নিহত হইয়া সমরাঙ্গনে শয়ান রহিয়াছেন। বিহঙ্গেরা উঁহার কলেবর ছিন্নভিন্ন করিয়াছে। উঁহার ভাৰ্যারা রণস্থলে উপস্থিত হইয়া উঁহাকে অঙ্কে আরোপণপূর্ব্বক অনবরত রোদন করিয়া স্থানান্তরিত করিতেছে। ঐ দেখ, উহার চারুকুণ্ডলমণ্ডিত মহাবলপরাক্রান্ত আত্মজ দ্রোণশরে ছিন্নভিন্ন হইয়া রণস্থলে নিপতিত রহিয়াছে। ঐ বীর অদ্যাপি স্বীয় পিতাকে পরিত্যাগ করে নাই। আমার পৌত্র লক্ষ্মণও ধৃষ্টকেতুতনয়ের ন্যায় স্বীয় পিতার অনুগমন করিয়াছে। ঐ দেখ, কাঞ্চনাঙ্গদসমলঙ্কৃত কাঞ্চনবর্ম্মধারী বিমলমাল্যসুশোভিত বৃষভলোচন অবন্তিদেশীয় বিন্দ ও অনুবিন্দ বসন্তকালে বায়ুবেগবিপাটিত কুসুমপরিশোভিত শালবৃক্ষদ্বয়ের ন্যায় ভূতলে শয়ান রহিয়াছে। হে কৃষ্ণ! পাণ্ডবেরা যখন মহাবীর ভীষ্ম, দ্রোণ, কর্ণ, কৃপ, দুৰ্য্যোধন, অশ্বত্থামা, জয়দ্ৰথ, সোমদত্ত, বিকর্ণ ও কৃতবর্ম্মার হস্ত হইতে বিমুক্ত হইয়াছে, তখন উহারা ও তুমি অবধ্য। ভীষ্ম, দ্ৰোণ প্রভৃতি মহাবীরগণ শস্ত্রবলে দেবগণকেও বিনাশ করিতে সমর্থ ছিলেন; কিন্তু কালের কি কুটিল গতি! আজ তাঁহারাই নিহত হইয়া সমরাঙ্গনে শয়ান রহিয়াছেন। দৈবের অসাধ্য কিছুই নাই। হে বাসুদেব! তুমি যখন শান্তিস্থাপনে অকৃতকার্য্য হইয়া বিরাটনগরে প্রত্যাগমন করিয়াছিলে, তখনই আমি স্থির করিয়াছিলাম যে, আমার পুত্রগণ নিহত হইয়াছে। তৎকালে মহাত্মা ভীষ্ম ও বিদুর আমাকে কহিয়াছিলেন, তুমি আপনার পুত্রগণের প্রতি আর স্নেহ প্রদর্শন করিও না। সেই মহাত্মাদিগের বাক্য কদাপি মিথ্যা হইবার নহে। ঐ দেখ, আমার পুত্রেরা পাণ্ডবগণের রোষানলে ভস্মসাৎ হইয়া গিয়াছে।”

হে মহারাজ! গান্ধাররাজতনয়া এই বলিয়া দুঃখশোকে একান্ত অধীর ও হতজ্ঞান হইয়া ভূতলে নিপতিত হইলেন এবং কিয়ৎক্ষণ পরে ক্রোধভরে বাসুদেবের প্রতি দোষারোপ করিয়া কহিলেন, “জনার্দ্দন! যখন কৌরব ও পাণ্ডবগণ পরস্পরের ক্ৰোধানলে পরস্পর দগ্ধ হয়, তৎকালে তুমি কি নিমিত্ত তদ্বিষয়ে উপেক্ষা প্রদর্শন করিলে? তোমার বহুসংখ্যক ভৃত্য ও সৈন্য বিদ্যমান আছে; তুমি শাস্ত্রজ্ঞানসম্পন্ন, বাক্যবিশারদ ও অসাধারণ বলবীৰ্য্যশালী, তথাপি তুমি ইচ্ছাপূর্ব্বক কৌরবগণের বিনাশে উপেক্ষা প্রদর্শন করিয়াছ, অতএব তোমাকে অবশ্যই ইহার ফলভোগ করিতে হইবে। আমি পতিশুশ্রুষাদ্বারা যে কিছু তপঃসঞ্চয় করিয়াছি, সেই নিতান্ত দুর্লভ তপঃপ্রভাবে তোমাকে অভিশাপ প্রদান করিতেছি যে, তুমি যেমন কৌরব ও পাণ্ডবগণের জ্ঞাতিবিনাশে উপেক্ষা প্রদর্শন করিয়াছ, তেমনি তোমার আপনার জ্ঞাতিবর্গ তোমাকর্ত্তৃক বিনষ্ট হইবে। অতঃপর ষট্‌ত্রিংশৎ বর্ষ সমুপস্থিত হইলে তুমি অমাত্য, জ্ঞাতি ও পুত্রহীন এবং বনচারী হইয়া অতি কুৎসিত উপায়দ্বারা নিহত হইবে। তোমার কুলরমণীগণও ভরতবংশীয় মহিলাগণের ন্যায় পুত্রহীন ও বন্ধুবান্ধববিহীন হইয়া বিলাপ ও পরিতাপ করিবে।”

তখন মহামতি বাসুদেব গান্ধারীর মুখে এই কথা শ্রবণ করিয়া হাস্যমুখে তাঁহাকে কহিলেন, “দেবি! আমা ব্যতিরেকে যদুবংশীয় দিগকে বিনাশ করে, এমন আর কেহই নাই। আমি যে যদুবংশ ধ্বংস করিব, তাহা বহুদিন অবধারণ করিয়া রাখিয়াছি। আমার যাহা অবশ্য কর্ত্তব্য, এক্ষণে আপনি তাহাই কহিলেন। যাদবেরা মনুষ্য বা দেবদানবগণের বধ্য নহে; সুতরাং তাহারা পরস্পর বিনষ্ট হইবেন।” বাসুদেব এই কথা কহিবামাত্র পাণ্ডবেরা ভীত ও উদ্বিগ্ন হইয়া প্রাণধারণবিষয়ে এককালে হতাশ হইলেন।

স্ত্রীবিলাপপর্বাধ্যায় সমাপ্ত