৪৪. বিদুর কর্ত্তৃক বিরোচন ও সুধম্বা ব্রাহ্মণের প্রসঙ্গ কথন

বিদুর কহেন, শুন পূর্বব বিবরণ।
প্রহ্লাদ দৈত্যের পুত্র নাম বিরোচন।।
অঙ্গিরা-ঋষির পুত্র সুধম্বা নামেতে।
দুই জনে কোন্দল হইল আচম্বিতে।।
বিরোচন বলে, নাহি রাজার সমান।
সুধম্বা বলেন, দ্বিজ সবার প্রধান।।
এই হেতু কোন্দল করিল দুই জন।
ক্রুদ্ধ হৈয়ে পণ করিলেন ততক্ষণ।।
যে জন হারিবে, তার লইব পরাণ।
চল সাধুজন স্থানে, জিজ্ঞাসি বিধান।।
বিরোচন বলে, জিজ্ঞাসিব কার স্থানে।
দ্বিজ বলে, চল তব বাপের সদনে।।
দুই জনে এই যুক্তি করিয়া তখন।
শীঘ্রগতি চলি গেল যথায় রাজন।।
সুধম্বা বলিল, শুন দৈত্যের প্রধান।
মোর সহ দ্বন্দ্ব কৈল তোমার সন্তান।।
পণ কৈল যে হারিবে, লইবে পরাণ।
সত্য করি কহ তুমি ইহার বিধান।।
দ্বিজপুত্রে রাজপুত্রে শ্রেষ্ঠ কোন্ জন।
শুনিয়া বিস্ময় মানে প্রহ্লাদের মন।।
চিত্ত কৈল, সত্য কৈলে হারিবে কুমার।
কেমনে কহিব মিথ্যা নরক দুর্ব্বার।।
এত চিন্তি জিজ্ঞাসিল কশ্যপের স্থান।
কহ মুনিবর মোরে ইহার বিধান।।
অসুর সুরের ধর্ম্ম তোমার গোচর।
কেমনে হইবে শ্রেয়ঃ বলহ উত্তর।।
কশ্যপ বলেন, যেই বিষণ্ণ হইয়া।
মহাতাপে সভামধ্যে পড়য়ে আসিয়া।।
সভামধ্যে থাকে যেই সাধু মহাজন।
ন্যায় করি তার তাপ করে নিবারণ।।
সভায় থাকিয়া যেই না করে বিচার।
নরক হইতে তার নহিক নিস্তার।।
যে পক্ষে অন্যায় করে, হয় সেই গতি।
ইহলোকে মহাদুঃখ পায় নিতি নিতি।।
হৃদয়ের শেল তার কদাচ না টুটে।
অর্থশোক পুত্রশোক অবিলম্বে ঘটে।।
অধর্ম্মীর পক্ষ হৈয়ে কহে যেই জন।
তার দুই পাদ পাপ সে করে গ্রহণ।।
অধর্ম্মী জানিয়া যেই নিন্দা নাহি করে।
এক পাদ পাপ তার শরীরেতে ধরে।।
সাক্ষী হৈয়ে যেই জন পক্ষ হৈয়ে কয়।
শতেক পুরুষ সহ নরকে পড়য়।।
কশ্যপের স্থানে শুনি এতেক বিধান।
পুত্রমুখ চাহি বলে দৈত্যের প্রধান।।
তারে শ্রেষ্ঠ বলি, যারে করি যে বন্দন।
তেঁই তোমা হতে শ্রেষ্ঠ সুধন্বা ব্রাহ্মণ।।
আমার হইতে শ্রেষ্ঠ অঙ্গিরারে গণি।
তব মাতা হৈতে শ্রেষ্ঠা ইহার জননী।।
পুত্রে এত বলিয়া সুধম্বা প্রতি কয়।
তোমার অধীন আজি বিরোচন হয়।।
মারহ রাখহ তুমি, যেই তব মন।
যাহা ইচ্ছা কর, নাহি করি নিবারণ।।
এত শুনি হৃষ্ট হৈয়ে বলে তপোধন।
দ্বিগুণ লভুক আয়ু তোমার নন্দন।।
কখনই তাপ নাই সত্যবাদী জনে।
সে কারণে তব পুত্র বাড়ুক কল্যাণে।।
এত বলি সুধম্বা আপন গৃহে গেল।
সভাজন চাহি ক্ষত্তা এতেক বলিল।।
তথাপি উত্তর নাহি দিল কোন জন।
দুঃশাসনে বলে তবে সূর্য্যের নন্দন।।
আনহ ধরিয়া দাসী কার মুখ চাহ।
সভামধ্যে আনি পরে গৃহে লৈয়ে যাহ।।
শুনিয়া দ্রৌপদী দেবী কাঁপে থরথরে।
স্বামিগণ পানে চাহে কান্দি উচ্চৈঃস্বরে।।
অধোমুখে রয়েছেন ভাই পঞ্চ জনে।
দ্রৌপদী যতেক ডাকে শুনিয়া না শুনে।।
স্বামিগণ অধোমুখে দেখি যাজ্ঞসেনী।
সভাজনে চাহি বলে শিরে কর হানি।।
পূর্ব্বেতে উত্তম কর্ম্ম আমার না ছিল।
এই হেতু বিধাতা আমারে দুঃখ দিল।।
পূর্ব্বে পিতৃগৃহে মম স্বয়ম্বর-কালে।
আমারে দেখিয়াছিল নৃপতি সকলে।।
আর কভু আমারে না দেখে অন্য জনে।
আজি পুনঃ সভাজন দেখিল নয়নে।।
চন্দ্র সূর্য্যা নিরখিলে যারা ক্রোধ করে।
আমার এ দুর্গতি সে সবার গোচরে।।
যত গুরুজনে আমি করি নমস্কার।
একবাক্য বল সবে করিয়া বিচার।।
দ্রুপদ-নন্দিনী আমি পাণ্ডব-গৃহিণী।
সখা মম যাদবেন্দ্র গদা-চক্রপাণি।।
কুরুকুলে শ্রেষ্ঠ সবর্ণা মহিষী।
কহিতেছে সবে মোরে হইবারে দাসী।।
আজ্ঞা কর আমারে যে ইহার বিধানে।
আর ক্লেশ নাহি সহে আমার পরাণে।।
শুনিয়া উত্তর দেন গঙ্গার নন্দন।
পুনঃ পুনঃ কল্যাণী জিজ্ঞাস কি কারণ।।
দ্রোণ আদি বৃদ্ধ যত আছেন সভায়।
কাহার জীবন নাহি, সবে মৃতপ্রায়।।
মৃতজনে জিজ্ঞাসিলে কি পাবে উত্তর।
ধর্ম্ম বিনা সখা নাহি, ধর্ম্মাশ্রয় কর।।
বহু কষ্টযুত নহে ধার্ম্মিক যে জন।
ধর্ম্মবলে করে সব শত্রুর নিধন।।
দাসীযোগ্যা অযোগ্যা যে পুছিলা বিধান।
কহি আমি, শুন দেবি! মোর অনুমান।।
তুমি দাসী হৈবে, যুধিষ্ঠিরের স্বীকার।
যুধিষ্ঠিরে জিজ্ঞাসহ ইহার বিচার।।
জিতা কি অজিতা তুমি, কহিবা আপনে।
নির্ণয় করিতে ইহা নারে অন্য জনে।।
সভাপর্ব্বে সুধারস পাশার নির্ণয়।
ব্যাস-বিরচিত গীত কাশীদাস কয়।।