৪০. দুঃশাসনের দ্রৌপদী-সমীপে গমন ও তাঁহার কেশাকর্ষণ পূর্ব্বক সভায় আনয়ন

শুনি দুঃশাসনে ডাকি বলে দুর্য্যোধন।
পাণ্ডবেরে ভয় করে সঞ্জয়-নন্দন।।
এ কর্ম্মের যোগ্য নহে এই অল্পমতি।
তুমি গিয়া দ্রৌপদীরে আন শীঘ্রগতি।।
সভামধ্যে কেশে ধরি আনহ তাহারে।
নিস্তেজ হয়েছে শত্রু, কি আর বিচারে।।
আজ্ঞামাত্র দুঃশাসন চলিল ত্বরিত।
দ্রৌপদীর অন্তঃপুরে হৈল উপনীত।।
দ্রৌপদী চাহিয়া ডাকি বলে দুঃশাসন।
চলহ দ্রৌপদী, আজ্ঞা করিল রাজন।।
পাশায় তোমার স্বামী হারিল তোমারে।
দুর্য্যোধনে ভজ এবে ত্যজি যুধিষ্ঠিরে।।
দুঃশাসন দুষ্টবুদ্ধি দেখি গুণবতী।
সক্রোধ-বদন আর বিকৃত-আকৃতি।।
ভয়েতে দেবীর অঙ্গ কাঁপে থরথর।
শীঘ্রগতি উঠি গেল ঘরের ভিতর।।
স্ত্রীগণের মধ্যে দেবী ভয়ে লুকাইল।
দেখি দুঃশাসন ক্রোধে পাছু গোড়াইল।।
গৃহদ্বারে কুন্তীদেবী ভুজ প্রসারিয়া।
সবিনয়ে বলে দুঃশাসনেরে চাহিয়া।।
কহ দুঃশাসন এই কেমন বিহিত।
দ্রৌপদী ধরিতে চাহ, না বুঝি চরিত।।
কুলবধূ লৈয়া যাবে সভার মধ্যেতে।
কুলের কলঙ্ক-ভয় নাহিক তোমাতে।।
শুনি দুঃশাসনে ক্রোধে উঠিল গর্জ্জিয়া।
দুই হাতে কুন্তীরে সে ফেলিল ঠেলিয়া।।
অচেতন হয়ে দেবী পড়িল ভূতলে।
দুঃশাসন ধরিলেক দ্রৌপদীর চুলে।।
যেই কেশ রাজসূয়-যজ্ঞের সময়।
মন্ত্রজলে সিঞ্চিলেন ব্যাস মহাশয়।।
বাহিরিল কৃষ্ণার সেই কেশেতে ধরি।
দেখিয়া কান্দয়ে যত অন্তঃপুর-নারী।।
কেশে ধরি লয়ে যায় পবনের বেগে।
চলিতে চরণ ভূমে লাগে কি না লাগে।।
নাগিনী বিকলা যথা গরুড়ের মুখে।
ছ্‌ট্ফট্ করে দেবী, ছাড় ছাড় ডাকে।।
আরে মন্দমতি কেন না দেখ নয়নে।
রজঃস্বলা আছি আর একই বসনে।।
দুঃশাসন বলে, তুমি ছাড় হেন আশ।
রজঃস্বলা হও কিম্বা হও একবাস।।
পূর্ব্ব-অহঙ্কার এবে না করিহ মনে।
সভাতে লইতে আজ্ঞা করিল রাজনে।।
কৃষ্ণা বলে, গুরুজন আছেন সভাতে।
কি মতে দাণ্ডাব আমি তাঁদের অগ্রেতে।।
না লহ সভাতে মোরে কর পরিহার।
আরে মন্দমতি কেশ ছাড়হ আমার।।
কেন হেন জ্ঞানহারা হৈলি রে অবোধ।
সর্ব্বনাশ হবে, হৈলে পাণ্ডবের ক্রোধ।।
ইন্দ্র সভা হৈলে তবু রক্ষা না পাইবি।
ক্ষণমাত্রে যম-গৃহে সবংশেতে যাবি।।
ধর্ম্মে বদ্ধ হয়েছেন ধর্ম্ম-নরপতি।
ভ্রাতৃ-উপরোধ বশ চারি মহামতি।।
এই হেতু এতক্ষণ তোমার জীবন।
এখন যে রক্ষা পাও হৈলে নিবারণ।।
কৃষ্ণার বচন শুনি দুঃশাসন হাসে।
পুনঃ আকর্ষিয়া দুষ্ট টান দিল কেশে।।
ঝাঁকারি সবলে তাঁরে নিল সভাস্থল।
উচ্চৈঃস্বরে কান্দে কৃষ্ণা হইয়া বিকল।।
অধীর হইয়া চাহে ভূমি ধরিবারে।
না লও সভাতে মোরে, বলয়ে কাতরে।।
বড় বড় জন দেখি আছেন সভায়।
হেন এক জন নাহি, এক কথা কয়।।
কেহ তার দুর্বুদ্ধি না করে নিবারণ।
চিত্র-পুত্তলিকা মত আছেন সভাজন।।
এই ভীস্ম দ্রোণ দেখ আছেন সভাতে।
ধার্ম্মিক এই দুই বড় খ্যাত পৃথিবীতে।।
স্বধর্ম্ম ছাড়িল এরা, হেন লয় মনে।
মম এত দুঃখ কেন না দেখে নয়নে।।
বাহ্লীক বিদুর ভূরিশ্রবা সোমদ্ত্ত।
ধর্ম্মশীল জানি সবে অতুল মহত্ত্ব।।
কুরুকুল সত্যভ্রষ্ট হইল নিশ্চয়।
এক জন কেহ এক ভাষা নাহি কয়।।
এত বলি কান্দে দেবী সজল নয়নে।
কাতর হইয়া চাহে স্বামীগণ পানে।।
দ্রৌপদী-কাতর-দৃষ্টি দেখিয়া পাণ্ডব।
ঘৃত পেলে যেই মত জ্বলে জলোদ্ভব।।
রাজ্য দেশ ধন জন সকল হারিল।
তিলমাত্র তাহাতে তাপিত না হইল।।
দ্রৌপদী-কাতর-,মুখ দেখিয়া নয়নে।
কুম্ভকার-শাল যেন পোড়য়ে আগুণে।।
দুঃশাসনে টানে ঘন কেশেতে আকর্ষি।
পরিহাস করি কেহ বেল, আন দাসী।।
সাধু দুঃশাসন, বলে রাধেয় শকুনি।
সজল নয়নে কান্দে দ্রুপদ-নন্দিনী।।
মহাভারতের কথা অমৃত সমান।
কাশীরাম দাস কহে শুনে পুণ্যবান।।