৩৪. যুধিষ্ঠিরের সহিত শকুনির প্রথমবার দ্যূতক্রীড়া ও শকুনির জয়লাভ

রজনি প্রভাতে পঞ্চ পাণ্ডুর নন্দন।
সুখে দিব্য সভামধ্যে করিল গমন।।
একে একে সম্ভাষ করিয়া সর্ব্বজনে।
বসিলেন অপূর্ব্ব কনক সিংহাসনে।।
হেনকালে শকুনি আনিল পাশা-সারি।
যুধিষ্ঠিরে বলে তবে প্রবঞ্চনা করি।।
পুরুষের মনোরম দূতক্রীড়া জানি।
দ্যূতক্রীড়া কর আজি ধর্ম্ম-নৃপমণি।।
যুধিষ্ঠির বলে, পাশা অনর্থের ঘর।
ক্ষত্র-পরাক্রম ইথে না হয় গোচর।।
কপট এ কর্ম্ম, ইথে কপট বাখান।
অনীতি কর্ম্মেতে মম নাহি লয় মন।।
শকুনি বলিল, পাশা সুবুদ্ধির কর্ম্ম।
দ্যূত কিম্বা যুদ্ধ এই ক্ষত্রিয়ের ধর্ম্ম।।
যুদ্ধেতে অজাতি জাতি নাহিক বিচার।
হীনজাতি যবনাদি করয়ে প্রহার।।
পাশার সমান সেহ বুদ্ধির সমর।
ক্ষত্রধর্ম্ম আছে হেন, বলে মুনিবর।।
যুধিষ্ঠির বলে, পাশা অনর্থের মূল।
অধর্ম্ম করিয়া মোরে না জিনি মাতুল।।
অন্য নাহি মনে মম দ্বিজ সেবা বিনা।
এ কর্ম্ম মাতুল আমি না করি কামনা।।
শকুনি বলিল, তুমি যাও নিজ স্থানে।
পণ্ডিতে পণ্ডিতে ক্রীড়া, পণ্ডিত সে জানে।।
যদি দ্যূতক্রীড়া ইচ্ছা নাহিক তোমার।
নিবর্ত্তিয়া গৃহে তবে যাহ আপনার।।
যুধিষ্ঠির বলে, যবে ডাকিলা আমারে।
সত্য মম না টলিবে পাশার সমরে।।
সত্য আমি খেলিব পাশার আবাহনে।
তব সহ পণ কিন্তু করে কোন্ জনে।।
মেরুতুল্য আমার যে আছে বহু ধন।
চারি সমুদ্রের মধ্যে যতেক রতন।।
দুর্য্যোধন বলে, মম মাতুল খেলিবে।
সর্ব্বরত্ন দিব আমি যতেক হারিবে।।
এইরূপে দুইজনে পাশা আরম্ভিল।
দেখিবারে সর্ব্বজন সভাতে বসিল।।
ধৃতরাষ্ট্র ভীষ্ম দ্রোণ কৃপ মহামতি।
চিত্তে অসন্তোষ অতি বিদুর প্রভৃতি।।
ধর্ম্ম বলিলেন, পণ হইল আমার।
ইন্দ্রপ্রস্থে যত মম রত্নের ভাণ্ডার।।
ঈদৃশ তোমার ধন কোথা দুর্য্যোধন।
হারিলে, কোথা হইতে দিবে এই পণ।।
দুর্য্যোধন বলে, মম আছয়ে অনেক।
অবশ্য অর্পিব আমি জিনিবে যতেক।।
নির্ণয় করিয়া সারি ফেলিল শকুনি।
কটাক্ষে সকল রত্ন লইলেক জিনি।।
ক্রোধে যুধিষ্ঠির পুনঃ করিলেন পণ।
কোটি কোটি মহাবল যত অশ্বগণ।।
শকুনি হাসিয়া ফেলি জিনিলাম কয়।
কি পণ করিবা আর কহ মহাশয়।।
যুধিষ্ঠির বলে, মোর রথ অগণন।
নানারত্নে বিভূষিত, মেঘের গর্জ্জন।।
শকুনি হাসিয়া বলে ডাকি ততক্ষণ।
এবে দেখ জিনিলাম, কর অন্য পণ।।
ধর্ম্ম বলিলেন, হস্তীবৃন্দ যে আমার।
ঈষাদন্ত মহাকায় বলে অনিবার।।
সব হস্তী করি পণ, পুনঃ খেলি পাশা।
জিনিলাম শকুনি বলিয়া কহে ভাষা।।
যুধিষ্ঠির বলে, তবে আছে দাসীগণ।
সহস্র সহস্র, নানারত্নে বিভূষণ।।
সবার সৌজন্য বড় ব্রাহ্মণ-সেবাতে।
করিলাম তাহা পণ এবার পাশাতে।।
শকুনি ফেলিয়া পাশা বলয়ে হাসিয়া।
অন্য পণ কর, হের নিলাম জিনিয়া।।
ধর্ম্ম বলে, গন্ধর্ব্বাশ্ব আছে অগণন।
তিলেক না হয় শ্রম ভ্রমিলে ভুবন।।
চিত্ররথ গন্ধর্ব্ব তুরঙ্গ আনি দিল।
এবার দ্যুতেতে সেই অশ্ব পণ হৈল।।
হাসিয়া বলয়ে তবে সুবল-কুমার।
অশ্বগণ জিনিলাম, কর পণ আর।।
যুধিষ্ঠির বলে, যে আছয়ে যোদ্ধাগণ।
মহারথী-মধ্যে করি সে সব গণন।।
এবার দ্যুতেতে আমি করিলাম পণ।
হাসিয়া জিনিনু বলে গান্ধার-নন্দন।।
এই মত প্রবর্ত্তিল কপট দেবন।
একে একে হারিলেন ধর্ম্ম সর্ব্বধন।।