৩৩. দ্যূত-ক্রীড়ার মন্ত্রণা

জন্মেজয় বলে, কহ শুনি মুনিবর।
কি হেতু হইল পাশা অনর্থের ঘর।।
পিতামহ পিতামহী দুঃখ যাহে পাইল।
কেবা খেলা নিবর্ত্তিল কেবা প্রবর্ত্তিল।।
কোন্ কোন্ জন ছিল সভার ভিতর।
যেই পাশা হৈতে হৈল ভারত-সমর।।
মুনি বলে, শুন পরীক্ষিতের তনয়।
ক্ষত্তাবাক্য শুনি অন্ধ চিন্তিত হৃদয়।।
দৃঢ় করি জানিল এ কর্ম্ম ভাল নয়।
একান্তে ডাকিয়া রাজা দুর্য্যোধনে কয়।।
হে পুত্র কদাচ তুমি না খেলিহ পাশা।
এ কর্ম্মেতে বিদুর না করিল ভরসা।।
সুবুদ্ধি বিদুর মত অহিত না ইচ্ছে।
তাঁর বাক্য না শুনিলে দুঃখ পাবে পিছে।।
দেবে যেন বৃহস্পতি দেবরাজ হিত।
এইরূপ ক্ষত্তা মম, জানিও নিশ্চিত।।
গুরুর অধিক পুত্র! ক্ষত্তার মন্ত্রণা।
বিচক্ষণ ক্ষত্তা কুরু-বংশেতে গণনা।।
সুরকুলে বৃহস্পতি, কুরুকুলে ক্ষত্তা।
বৃষ্ণিকুলে উদ্ভব, সুবুদ্ধি জ্ঞানদাতা।।
বিদুর কহিল, পাশা অনর্থের ঘর।
দ্যূত হৈতে ভেদাভেদ আছে সুগোচর।।
ভ্রাতৃভেদ হৈলে যে হৈবে সর্ব্বনাশ।
বিদুরের বাক্য শুনি হৈল মম ত্রাস।।
মাতা পিতা যদি তুমি মান দুর্য্যোধন।
না খেলাও দ্যূত, তুমি শুনহ বচন।।
পরম পণ্ডিত তুমি না বুঝহ কেনে।
কি কারণে হিংসা কর পাণ্ডব নন্দনে।।
কুরুকুলে জ্যেষ্ঠ শ্রেষ্ঠ যুধিষ্ঠিরে গণি।
হস্তিনা-নগর কুরুকুল-রাজধানী।।
যুধিষ্ঠির বর্ত্তমানে পাইলে হস্তিনা।
তুমি যাহা দিলে, তাহা নিল পঞ্চজনা।।
ইন্দ্রের সমান পুত্র! তোমার বৈভব।
নরজন্ম লভি কার এমত সম্ভব।।
ইথে অনুশোচ পুত্র কিসের কারণ।
কি হেতু উদ্বেগ কর, কহ দুর্য্যোধন।।
দুর্য্যোধন বলে, পিতা সমর্থ হইয়া।
অহঙ্কার নাহি যার শত্রুকে দেখিয়া।।
কাপুরুষ মধ্যে গণ্য হয় হেন জন।
বিশেষ ক্ষত্রিয় জাতি, জানহ আপন।।
মোরে যে বলিলে, লক্ষ্মী গণি সাধারণ।
এই মত লক্ষ্মী পিতা ভুঞ্জে বহুজন।।
কুন্তী-পুত্র-লক্ষ্মী যেন দীপ্ত হুতাশন।
দেখি মোর ধন্য প্রাণ আছে এতক্ষণ।।
পৃথিবী ব্যাপিল পিতা পাণ্ডবের যশে।
যতেক নৃপতি পিতা হৈল তার বশে।।
যদু ভোজ অন্ধক কুক্কুর লোক অঙ্গ।
কারস্কর বৃষ্ণি, এই সপ্ত বংশ সঙ্গ।।
যুধিষ্ঠির-বচনে সদাই কৃষ্ণ খাটে।
সমস্ত ভূপতি কর দেয় করপুটে।।
আর করিলেক কত কপট পাণ্ডব।
মম স্থানে ধন রত্ন রাখিলেক সব।।
পূর্ব্বে নাহি শুনি পিতা যে রত্নের নাম।
সে সকল দেখিলাম যুধিষ্ঠির-ধাম।।
নানাবর্ণ-রত্ন সব, না যায় কথন।
সিন্ধুমধ্যে গিরিমধ্যে জন্মে যত ধন।।
ধরামধ্যে বৃক্ষমধ্যে জীবের অঙ্গেতে।
সর্ব্বরত্ন আছে পিতা তার ভাণ্ডারেতে।।
লোমজ পট্টজ চীর বিবিধ বসন।
গজদন্ত-বিরচিত দিব্য সিংহাসন।।
হস্তী অশ্ব উট গাধা মেষ আর অজা।
নানাবর্ণে আনি দিল নানাদেশী রাজা।।
শ্যামলা তরুণী দিব্যরূপা দীর্ঘকেশী।
সহস্র সহস্র দাসী নানাবর্ণে ভূষি।।
দেখিতে দেখিতে মম ভ্রম হৈল মন।
অপমান কৈল যত, শুনহ কারণ।।
মায়া-সভা মধ্যে কিছু না পাই দেখিতে।
স্ফটিকের বেদী সব হেন লয় চিতে।।
জল জানি তুলিলাম পিন্ধন-বসন।
দেখিয়া হাসিল লোক যত সভাজন।।
তথা হৈতে কতদূরে দেখি জলাশয়।
স্ফটিক বলিয়া তায় মনোভ্রম হয়।।
পড়িলাম মহাশব্দে সবস্ত্র তাহাতে।
চতুর্দ্দিকে লোকগণ লাগিল হাসিতে।।
ভীম ধনঞ্জয় আর যত সভাজন।
দ্রৌপদীর সহিত যতেক নারীগণ।।
সর্ব্বজন আমারে করিল উপহাস।
যুধিষ্ঠির পরিবারে দিল অন্য বাস।।
বলিল কিঙ্করগণে বস্ত্র আনিবারে।
পরাইল বাপী হৈতে তুলিয়া আমারে।।
কার প্রাণে সহে পিতা এত অপমান।
আরে যে করিল পিতা কর অবধান।।
স্থানে স্থানে ফটিকের নির্ম্মিত প্রাচীর।
দ্বার হেন বুঝিলাম আসিতে বাহির।।
মস্তকে লাগিল ঘাত, পড়িনু ভূতলে।
মাদ্রী-পুত্র ‍দুই আসি ত্বরিত তুলিলে।।
মম দুঃখে দুঃখিত হইল দুইজন।
হাতে ধরি দেখাইল দুয়ার তখন।।
এত অপমান পিতা সহে কার প্রাণে।
ক্ষত্র কি সহিতে পারে, সহে হীন জনে।।
এই হেতু হৈল পিতা মোর অভিমান।
কিবা তার লক্ষ্মী লই, কিবা যাক্ প্রাণ।।
ধৃতরাষ্ট্র বলে, পুত্র হিংসা বড় পাপ।
হিংস্রক জনের পুত্র জন্মে বড় তাপ।।
অহিংসক পাণ্ডবের না করিবে হিংসা।
শান্ত হয়ে থাক পুত্র! পাইবে প্রশংসা।।
সেই মত যজ্ঞ করিবারে যদি মন।
কহ পুত্র নিমন্ত্রণ করি রাজগণ।।
আমার গৌরব করে সব নৃপবর।
ততোধিক রত্ন দিকে আমার বিস্তর।।
ইহা না করিয়া যাহা করহ বিচার।
অসৎ মার্গেতে গেলে দূষিবে সংসার।।
পরদ্রব্য দেখি হিংসা না কের যে জন।
স্বধর্ম্মেতে সদা বঞ্চে সন্তোষিত মন।।
স্বকর্ম্মে উদ্যোগ করে পর-উপকারী।
সদাকাল সুখে বঞ্চে, কি দুঃখ তাহারি।।
পর নহে নিজ ভাই পাণ্ডুর নন্দন।
দ্বেষভাব তার নাহি করিহ কখন।।
পাণ্ডবের যশ যত নিজ করি জানি।
যথোচিত ভোগ কর অতি প্রীত মানি।।
তোমারেও করে স্নেহ ধর্ম্মের নন্দন।
দ্বেষভাব তারে না করিও কদাচন।।
দুর্য্যোধন বলে, পিতা প্রজ্ঞাবান্ নহি।
বহু শুনিয়াছি বলি শাস্ত্রকথা কহি।।
সে জন কি জানে পিতা শাস্ত্রের বিবাদ।
চাটু যেন নাহি জানে পিষ্টকের স্বাদ।।
রাজা হয়ে এক আজ্ঞঅ নহিল যাহার।
তারে রাজা নাহি বলি শাস্ত্র-অনুসার।।
রাজা হৈয়ে সন্তোষ না রাখিবে কদাচন।
ধনে জনে শান্তি না রাখিবে কখন।।
শত্রুকে বিশ্বাস আর নাহি কদাচন।
নমুচি-দানবে যথা সহস্রলোচন।।
এক পিতা হৈতে হৈল দোঁহার উৎপত্তি।
বহুকাল প্রীতে ছিল নমুচি সংহতি।।
সময়ে তাহারে ইন্দ্র করিল সংহার।
নিষ্কণ্টকে ভোগ করে অদিতি-কুমার।।
শত্রু অল্প যদি, তবু নাশে সে কারণ।
মূলস্থ বল্মীক যেন গ্রাসে তরুগণ।।
জ্ঞাতিমধ্যে যেই জন ধনে বলবান।
ক্ষত্রমধ্যে সেই শত্রু, গণি যে প্রধান।।
আপনি জানিয়া কেন করহ বঞ্চন।
নিশ্চয় জানিনু চাহ আমার নিধন।।
পুনঃ ধৃতরাষ্ট্র বহু মধুর বচনে।
নিবারিতে না পারিয়া পুত্র দুর্য্যোধনে।।
দৈবগতি জানিয়া বিদুরে ডাকাইল।
যুধিষ্ঠিরে আন গিয়া বলি আজ্ঞা দিল।।
বিদুর বলিল, রাজা শ্রেয়ঃ নহে কথা।
কুলনাশ হৈবে জানি মনে পাই ব্যথা।।
অন্ধ বলে, আমারে যে না বলিহ আর।
দৈববশ দেখি এই সকল সংসার।।
নারিল বিদুর আজ্ঞা করিতে হেলন।
রথে চড়ি ইন্দ্রপ্রস্থে করিল গমন।।
ধর্ম্মরাজ বিদুরে করিয়া দরশন।
যথাবিধি পূজা করিলেন পঞ্চজন।।
জিজ্ঞাসা করেন, কহ ভদ্র সমাচার।
কি কারণে অন্যচিত্ত দেখি যে তোমার।।
বিদুর বলেন, রাজা চল হস্তিনায়।
বিলম্ব না কর ধৃতরাষ্ট্রের আজ্ঞায়।।
আর যে বলিব, তাহা শুনহ সুমতি।
তব সভা তুল্য সভা করিয়াছে তথি।।
ভ্রাতৃগণ সহ মম সভা দেখ আসি।
দ্যূত-আদি ক্রীড়া কর সভামধ্যে বসি।।
সভায় বসিলে মম তৃপ্ত হয় মন।
এই হেতু আমারে পাঠাইল, রাজন।।
যুধিষ্ঠির বলে, দ্যূত অনর্থের ঘর।
দ্যূত-ক্রীড়া ইচ্ছে যত জ্ঞানভ্রষ্ট নর।।
যে হৌক সে হৌক, আমি অধীন তোমার।
কি কাজ করিব, মোরে কহ সমাচার।।
বিদুর বলেন, দ্যূত অনর্থের মূল।
দ্যূতেতে অনর্থ জন্মে, ভ্রষ্ট হয় কুল।।
করিলাম অন্ধ নৃপে অনেক বারণ।
আমারে পাঠাল তবু না শুনি বচন।।
বুঝিয়া করহ রাজা যাহে শ্রেয়ঃ হয়।
যাহ বা না যাহ তথা, যেবা চিত্তে লয়।।
ধর্ম্ম বলিলেন, আজ্ঞা দেন কুরুপতি।
গুরু-আজ্ঞা ভঙ্গ কৈলে নরকে বসতি।।
ক্ষত্রিয়ের ধর্ম্ম তাত জানহ যেমন।
দ্যূতে কিম্বা যুদ্ধে যদি করে আবাহন।।
বিশেষে আমার সত্য প্রতিজ্ঞা-বচন।
দ্যূত কিম্বা যুদ্ধে আমি না ফিরি কখন।।
এত বলি যুধিষ্ঠির সহ ভ্রাতৃগণ।
দ্রৌপদীরে কহিয়া গেলেন ততক্ষণ।।
দৈবপাশে বান্ধি যেন লোকে লৈয়ে যায়।
ক্ষত্তাসহ পঞ্চ ভাই যায় হস্তিনায়।।
ধৃতরাষ্ট্র ভীষ্ম দ্রোণ কৃপ সোমদত্ত।
গান্ধারী সহিত অন্তঃপুর-নারী যত।।
একে একে সবাকারে করি সম্ভাষণ।
রজনী বঞ্চেন তথা সুখে পঞ্চজন।।