৩০. ভীষ্ম কর্ত্তৃক শিশুপালের জন্ম-বৃত্তান্ত কথন ও শিশুপালের ক্রোধ

চেদিরাজ-গৃহে জন্ম হইল যখন।
চারি গোটা হস্ত আর হৈল ত্রিলোচন।।
জন্মমাত্রে ডাকিলেক গর্দ্ধভের প্রায়।
বিপরীত দেখি কম্প লাগে বাপ মায়।।
জাতমাত্র ত্যজিবারে কৈল তারা মন।
আচম্বিতে শুনে শূন্যে আসুরী-বচন।।
শ্রীমন্ত বলিষ্ঠ এই হইবে নন্দন।
না করিহ ভয়, কর ইহারে পালন।।
বিপরীত দেখি যদি চিন্তা কর মনে।
ইহার কারণ কিছু শুন সাবধানে।।
দুই ভুজ চক্ষু যাবে পরশনে যার।
সেই জন এই শিশু করিবে সংহার।।
চতুর্ভুজ হয়েছিল চেদীর নন্দন।
রাজ্যে রাজ্যে শুনিল যতেক রাজগণ।।
আশ্চর্য্য শুনিয়া সবে যায় দেখিবারে।
দশ বিশ রাজা নিত্য যায় তার পুরে।।
সবাকারে দমঘোষ করয়ে অর্চ্চন।
সবাকার কোলে দেয় আপন নন্দন।।
তবে কত দিনে শুনি হেন বিবরণ।
দেখিতে গেলেন তথা রাম নারায়ণ।।
গোবিন্দের পিতৃষ্বসা ইহার জননী।
তার গৃহে উপস্থিত রাম যদুমণি।।
দিখি পিতৃষ্বসা করে বহু সমাদর।
হৃষ্টচিত্তে ভুঞ্জাইল দুই সহোদর।।
স্নেহেতে বালক লৈয়ে দিল কৃষ্ণকোলে।
দুই হস্ত খসি পড়ে অমনি ভুতলে।।
কপালের নয়ন কপালে লুকাইল।
দেখিয়া ইহার মাতা সশঙ্কা হইল।।
করযোড় করি বলে দেব দামোদরে।
এক বর মাগি বাপু আজ্ঞা কর মোরে।।
তুমি ভয় ভাঙ্গিলে যে দেহ হয় স্থির।।
শ্রীকৃষ্ণ বলেন, মাতা না ভাবিও মনে।
কোন বর আজ্ঞা কর দিব এইক্ষণে।।
মহাদেবী বলে মোরে এই বর দিবা।
এ পুত্রের অপরাধ শত যে ক্ষমিবা।।
বহু অপরাধ এই করিবে তোমার।
মোরে দেখি অপরাধ ক্ষমিবা ইহার।।
কৃষ্ণ বলে, না লঙ্ঘিব বচন তোমার।
শত অপরাধ আমি ক্ষমিব ইহার।।
অবশ্য ক্ষমিব দোষ একশত ইহার।।
অবশ্য ক্ষমিব দোষ একশত বার।
তোমার অগ্রেতে মাতা করি অঙ্গীকার।।
পূর্ব্বে হইয়াছে এই রূপেতে নির্ব্বন্ধ।
মূঢ় শিশুপাল দুই চক্ষু স্থিতে অন্ধ।।
তোমারে ডাকিছে দুষ্ট যুদ্ধের কারণ।
তব কর্ম্ম নহে ইহা কুন্তীর নন্দন।।
শ্রীকৃষ্ণের অংশ কিছু আছয়ে ইহায়।
সে কারণে ইহা সহ যুদ্ধ না যুয়ায়।।
হেন জন কেবা আছে সংসার ভিতরে।
কাহার শকতি মোরে গালি দিতে পারে।।
কু-বচন বলিল যে এই কুলাঙ্গারে।
হীনবীর্য্য হৈলে সেহ নারে সহিবারে।।
বিষ্ণু অংশ লইবারে চাহে নারায়ণ।
তোর যত গালি সহি তাহার কারণ।।
ভীষ্মের এতেক বাক্য শুনি চেদীশ্বর।
হাস্য পরিহাস্য করি বলয়ে উত্তর।।
ভাল হৈল শত্রু মোর নন্দের নন্দন।
তোর এত স্তুতি তারে কিসের কারণ।।
লোকের বর্ণনা যথা করে ভ্ট্টগণ।
এত যদি কর তুমি পরের স্তবন।।
যত স্তুতি কৈলে তুমি নন্দের নন্দনে।
অন্য জনে কৈলে বর পেতে এতক্ষণে।।
বাহ্লীক রাজার যদি করিতে স্তবন।
যত স্তুতি কৈলে তুমি নন্দের নন্দনে।।
অন্য জনে কৈলে তুমি নন্দের নন্দনে।
অন্য জনে কৈলে বর পেতে এতক্ষণে।।
বাহ্লীক রাজার যদি করিতে স্তবন।
মনোমত বর তবে পাইতে এক্ষণ।।
মহাদাতা কর্ণবীর বিখ্যাত সংসারে।
জরাসন্ধ রাজা যারে হারিলা সমরে।।
শ্রবণে কুণ্ডল যার দেবের নির্ম্মাণ।
অভেদ্য কবচ অঙ্গে সূর্য্য-দীপ্তিমান।।
অঙ্গ-রাজ্যেশ্বর সেই দানে অকাতর।
কর্ণে স্তুতি করিলে যে পেতে ভাল বর।।
দ্রোণ দ্রৌণি পিতা পুত্র বিখ্যাত সংসারে।
মুহূর্ত্তেকে ভূমণ্ডল পারে জিনিবারে।।
রাজগণ মধ্যে দুর্য্যোধন মহাবল।
সাগরান্ত পৃথিবী যাহার করতল।।
ভগদত্ত জয়দ্রথ ভীষ্মক দ্রুপদ।
রুক্মী দন্তবক্র মৎস্য কলিঙ্গ কামদ।।
বৃষসেন বিন্দ অনুবিন্দ কৃপাচার্য্য।
এ সবার স্তুতি কৈলে হৈত বড় কার্য্য।।
ধিক্ ধিক্ বুদ্ধি তব কি বলিব আর।
ভূলিঙ্গ পক্ষীর সম চরিত্র তোমার।।
ভূলিঙ্গ বলিয়া পক্ষী হিমাদ্রিতে থাকে।
তাহার সংবাদ শুনিয়াচি লোকমুখে।।
সব পক্ষিগণে সেই উপদেশ কয়।
সাহসিক কর্ম্ম ভাই কভু ভাল নয়।।
সাহসিক কর্ম্মে ভাই দুঃখ হয় পাছে।
মোর কথা নয় ইহা শাস্ত্রে হেন আছে।।
হেনরূপ পক্ষিগণে কহে অনুক্ষণ।
তাহার যে কর্ম্ম তাহা শুন সর্ব্বজন।।
আহার করিয়া সিংহ থাকয়ে শুইয়া।
ভূলিঙ্গ থাকয়ে তার নিকটে বসিয়া।।
কতক্ষণে হাই উঠে সিংহের মুখেতে।
ভক্ষ্য-মাংস লাগি থাকে তাহার দন্তেতে।।
অতি শীঘ্র সেই মাংস কাড়ি লৈয়ে খায়।
নিজকর্ম্ম এইরূপ অন্যেরে শিখায়।।
সিংহের কৃপাতে রহে ভূলিঙ্গ-জীবন।
ইঙ্গিতে মারিতে পারে যদি করে মন।।
সেইমত রাজগণ ক্ষমিছে তোমারে।
ক্রোধ কৈলে তখনি পাঠাত যমঘরে।।
অসহ্য এই কটুবাক্য শুনি ভীষ্মবীর।
কহেন কম্পিত অঙ্গ হইয়া অস্থির।।
আরে মূর্খ দুরাচার শুন ক্রূরমন।
কৃষ্ণে স্তুতি করি হেন বলিলি বচন।।
চতুর্ব্বেদ চতুর্ম্মুখ সীমা নাহি পায়।
পঞ্চমুখে ভোলানাথ যার গুণ গায়।।
সহস্র বদনে শেষ যারে করে স্তুতি।
চরাচরে আর যত বৈসে মহামতি।।
যাহার জিহ্বাতে নাহি কৃষ্ণ গুণগান।
সংসারেতে পাপতনু ধরে অকারণ।।
ক্ষুদ্র যে মনুষ্য আমি হই অল্পমতি।
আমি কি করিতে পারি কৃষ্ণ-গুণ স্তুতি।।
আরে পাপ বলিলি ক্ষমিছে রাজগণ।
সে কারণে রহিয়াছে তোমার জীবন।।
এ সভার মধ্যে যত দেখি রাজগণ।
তৃণবৎ হেন আমি করি যে গণন।।
এ প্রকার বলিলেন গঙ্গার নন্দন।
ক্রোধেতে নৃপতি সব করিছে গর্জ্জন।।
সাধু রাজগণ শুনি হইল হরষ।
দুষ্ট রাজগণ সব বলয়ে কর্কশ।।
গর্ব্বিত দুর্ম্মতি এই ভীষ্ম পাপাচার।
পশুর মতন এরে করহ সংহার।।
কেহ বলে ইচ্ছামৃত্যু অহঙ্কার ধরে।
বান্ধিয়া অনলে লৈয়ে পোড়াও ইহারে।।
হাসিয়া বলেন ভীষ্ম, শুন রাজগণ।
মুখেতে গর্জ্জন কর সব অকারণ।।
পদ দিয়া কহি আমি সবাকার শিরে।
যার মৃত্যু ইচ্ছা আছে আইস সমরে।।
কেবল না ডাকি রণে দৈবকী-নন্দন।
সমরে ডাকুক যার নিকট মরণ।।
গোবিন্দের অংশ আছে শিশুপাল-দেহে।
সেই অংশ শ্রীগোবিন্দ যাবত না লহে।।
তাবৎ পর্য্যন্ত সবে হয়ে থাক স্থির।
পশ্চাতে পাঠাব সব যমের মন্দির।।
ভীষ্মের বচনে ক্রুদ্ধ হয়ে শিশুপাল।
ক্রোধে ডাক দিয়া বলে আরেরে গোপাল।।
তোর সহ বিনাশিব পাণ্ডুর নন্দনে।
তোরে পূজা কৈল কেন ত্যজি রাজগণে।।