২৬. শ্রীকৃষ্ণের বিশ্বরূপা দর্শনে সকলের মূর্চ্ছা

তবে জন্মেজয় রাজা মুনিরে পুছিল।
কহ শুনি অনন্তর কি প্রসঙ্গ হৈল।।
মুনি বলে,শুন পরীক্ষিতের নন্দন।
বিভীষণ সহ বসিলেন নারায়ণ।।
পথশ্রম হয়েছিল পদব্রজে চলি।
চতুর্দ্দিকে বিশেষে লোকের ঠেলাঠেলি।।
চৌদিকে অযুত ক্রোশ সভা-পরিসর।
ভ্রমিয়া দোঁহার শ্রম হৈল কলেবর।।
সিংহাসন উপরে বসিল দুইজন।
হেনকালে উপনীত মাদ্রীর নন্দন।।
গোবিন্দে দেখিয়া বীর কৈল নমস্কার।
তারে ডাকি কৃষ্ণ জিজ্ঞাসেন সমাচার।।
দুই তিন দিন নাহি রাজ-সম্ভাষণ।
কহ দেখি সহদেব সব বিবরণ।।
সহদেব বলে, শুন দেব দামোদর।
তুমি গেলে আসিলেন যতেক অমর।।
সকলের হইয়াছে রাজ-দরশন।
তব পদ দেখিবারে আছে সর্ব্বজন।।
দেববৃন্দ লইয়া আছয়ে দেবরাজ।
তুমি গেলে ভেটিবেক দেবের সমাজ।।
এত শুনি উঠিলেন শ্রীবৎস-লাঞ্ছন।
তাঁহার সহিত গেল নিকষা-নন্দন।।
সভামধ্যে প্রবেশের দেব নারায়ণ।
গোবিন্দেরে নিরখিয়া উঠে সর্ব্বজন।।
মণ্ডলী করিয়াছিল বেদীর উপরে।
কৃষ্ণে দৃষ্টিমাত্র সবে পড়ে বায়ুভরে।।
কত দূরে পড়ি গেল করি কৃতাঞ্জলি।
মহা-বাতাঘাতে যেন পড়িল কদলী।।
দেবতা গন্ধর্ব্ব আর অপ্সর কিন্নর।
দেব-ঋষি ব্রহ্ম-ঋষি রক্ষ খগবর।।
একজন বিনা আর যে ছিল যখায়।
কত দূরে পড়ি সবে হৈল নম্রকায়।।
শতেক সোপান উঠেন নারায়ণ।
বিশ্বরূপ প্রকাশেন দেব জনার্দ্দন।।
যে রূপ দেখিয়া মুগ্ধ হৈল পদ্মাসন।।
সহস্র মস্তকে শোভে সহস্র নয়ন।
সহস্র মুকুট মণি কিরীট-ভূষণ।।
সহস্র শ্রবণে শোভে সহস্র কুণ্ডল।
সহস্র নয়নে রবি সহস্র মণ্ডল।।
বিবিধ আয়ুধ শোভে সহস্রেক করে।
সহস্র চরণে শোভা কত শশধরে।।
সহস্র সহস্র যেন সূর্য্যের উদয়।
শ্রীবৎস-কৌস্তুভমণি-শোভিত হৃদয়।।
গলে দোলে আজানুলম্বিত বনমালা।
পীতাম্বর শোভে যেন মেঘেতে চপলা।।
শঙ্খ চক্র গদা পদ্ম আর শার্ঙ্গ ধনু।
নানাবর্ন মণিময় বিভূষিত তনু।।
সহস্র সহস্র শম্ভু আছে করযোড়ে।
কত শত মুখে তারা স্তুতি বাণী পড়ে।।
সহস্র সহস্র চক্ষু বুকে দিয়া হাত।
সহস্র সহস্র অংশু করে প্রণিপাত।।
বিশ্বরূপ বিশ্বপতি দেখি দেবগণ।
চকিত হইয়া সবে হৈল অচেতন।।
অন্তরীক্ষে থাকি ধাতা বিশ্বরূপ দেখি।
নিমিষে চাহিয়া মুদিলেন অষ্ট আঁখি।।
অজ্ঞান হইয়া ধাতা আপনা পাসরে।
করযোড় করি শেষে পড়ে কত দূরে।।
লুকায়ে ছিলেন শিব যোগীরূপে হৈয়ে।
চরণে পড়িল বিশ্বরূপ নিরখিয়ে।।
ইন্দ্র যম কুবের বরুণ হুতাশন।
চন্দ্র সূর্য্য খগ নাগ গ্রহ রাশিগণ।।
যেই যথা ছিল সব গেল ধরা পড়ি।
অচেতন হৈয়ে সবে যায় গড়াগড়ি।।
সকলে পড়িল যদি করি প্রণিপাত।
যুধিষ্ঠিরে চাহি কন দেব জগন্নাথ।।
করযোড় করি বলে দেব ভগবান।
পূর্ব্বভিতে মহারাজ কর অবধান।।
কমণ্ডলু জপমালা যায় গড়াগড়ি।
পড়িয়াছে চতুর্ম্মুখ অষ্টভুজ যড়ি।।
তাঁহার পশ্চাতে দেখ প্রজাপতি গণ।
কর্দ্দম কশ্যপ দক্ষ আদি যত জন।।
ব্রহ্মার দক্ষিণে দেখ যোগী মহাবেশ।
ত্রিলোচন পঞ্চানন প্রণমে মহেশ।।
কার্ত্তিক গনেশ দেখ তাহার পশ্চাৎ।
স্তুতি করি নমে তোমা, ধন্য তুমি তাত।।
সহস্র নয়নে বহে ধারা অগণন।
হের দেখ প্রণমিছে সহস্র-লোচন।।
দ্বাদশ আদিত্য আর দেব শশধর।
কুব্জ বুধ আর গুরু শুক্র শনৈশ্চর।।
রাহু কেতু অগ্নি তারা বসু অষ্ট জন।
মেঘ বার তিথি যোগ ঋষি পক্ষগণ।।
দেব-ঋষি ব্রহ্ম-ঋষি রাজ-ঋষিগণ।
প্রণাম করিছে সবে তোমার চরণ।।
যাম্যভিতে মহারাজ কর অবগতি।
প্রণাম করিছে পড়ি মৃত্যু-অধিপতি।।
পশ্চিমেতে অবধান কর নৃপবর।
করযোড়ে পড়িয়াছে জলের ঈশ্বর।।
সিন্ধুগণ সহ দেখ যত নদ-নদী।
যতেক দানব দৈত্য অমর-বিবাদী।।
হের দেখ মহারাজ সহস্র-সোদর।
সহস্র মস্তক ধরে শেষ বিষধর।।
প্রণাম করিছে তোমা ভূমিতলে পড়ি।
ধূলিতে সহস্র শির যায় গড়াগড়ি।।
উত্তরেতে মহারাজ কর অবধান।
প্রণাম করিছে তোমা যক্ষের প্রধান।।
গন্ধর্ব্ব ধবল অশ্ব দিয়া চারিশত।
ওই দেখ প্রণমিছে রাজা চিত্ররথ।।
গন্ধর্ব্ব কিন্নর যক্ষ অপ্সরী অপ্সর।
গড়াগড়ি যায় দেখ ভূমির উপর।।
তার বামভাগে দেখ রাক্ষসের শ্রেষ্ঠ।
শ্রীরামের মিত্র হয় রাবণ-কণিষ্ঠ।।
হের অবধান কর কুন্তীর কোঙর।
ছয় সহোদর দেখ খগের ঈশ্বর।।
ভীষ্ম দ্রোণ দেখ ধৃতরাষ্ট্র জ্যেষ্ঠতাত।
উগ্রসেন যজ্ঞসেন শল্য মদ্রনাথ।।
বসুদেব বাসুদেব আদি যত জন।
তব পদে প্রণাম করিছে সর্ব্বজন।।
পৃথিবীতে নাহি রাজা তোমার তুলনা।
কে করিতে পারে তব গুণের বর্ণনা।।
ব্রহ্মাণ্ড পূরিল রাজা তব কীর্ত্তি যশ।
তব গুণে মহারাজ হইলাম বশ।।
কৃষ্ণের বচন শুনি রাজা যুধিষ্ঠির।
ভয়েতে আকুল হয়ে কম্পিত শরীর।।
নয়ন-যুগলে পড়ে, শতধারা নীর।
মুহুমুহু অচেতন হয় পাণ্ডুবীর।।
ধৈর্য্য ধরি বলেন রাজা গদগদ-বচন।
আকিঞ্চন জনে প্রভু এত কি কারণ।।
তোমার চরণে মম অসংখ্য প্রণাম।
অবধানে নিবেদন শুন ঘনশ্যাম।।
তড়িত-জড়িত পীত কৌষবাস সাজে।
শ্রীবৎস-কৌস্তুভ-বিভূষিত অঙ্গ মাঝে।।
শ্রবণে পরশে চক্ষু পুণ্ডরীক-পাত।
বিষ্ণু বিশ্বরূপ প্রভু সর্ব্বলোক-নাথ।।
সংসারে আছেন যত পুণ্য-আত্মজন।
সতত বন্দয়ে প্রভু তোমার চরণ।।
তব পদ সবাকার বন্দিবারে আশা।
আকাঙ্কায় মাগিবারে না করি ভরসা।।
যদি বর দিবা, এই করি নিবেদন।
অনুক্ষণ বন্দি যেন তোমার চরণ।।
এ সব অনিত্য যেন বাদিয়ার বাজি।
তোমার বিষম মায়া কিবা শক্তি বুঝি।।
গোবিন্দ বলেন, রাজ সবে ক্ষম তুমি।
ভক্তিমূলে তোমাতে বিক্রীত আছি আমি।।
আমার নিয়মে বর্ত্তে, ভকত আমাতে।
সেইজন মুক্তি লভে এই সংসারেতে।।
ব্রহ্মা-আদি দেবরাজ সম নহে তার।
প্রত্যক্ষ দেখহ যত চরণে তোমার।।
তব তুল্য প্রিয় মম নাহিক ভুবনে।
আমিও প্রণাম করি ভক্তের চরণে।।
এত বলি জগন্নাথে পড়িয়া ধরণী।
করপুটে কহিলেন কত স্তুতি বাণী।।
মোহিলেন মায়বশে পুনঃ নারায়ণ।
যতেক দেখিল সবে হৈল পাসরণ।।
মাতুল-নন্দন হেন দেখিয়া অচ্যুতে।
সহদেব কৈল আজ্ঞা বলহ উঠিতে।।
সহদেব ডাকি বলে, উঠ নারায়ণ।
আজ্ঞা হৈল নিবেদন কর প্রয়োজন।।
আজ্ঞা পেয়ে গোবিন্দ উঠেন ততক্ষণ।
বুকে হাত দিয়া কৃষ্ণ কহেন বচন।।
বহুদিন হৈল আছে দেব খগনাথ।
আজ্ঞা হৈলে যায় সবে লৈয়ে যজ্ঞভাগ।।
ভারত-মণ্ডলে বৈসে যত নরপতি।
বহুদিন হৈল সবে দ্বারে করে স্থিতি।।
বিদায় হইয়া গেলে যত দেবগণ।
রাজগণ আসি তবে করিবে দর্শন।।
ইতিমধ্যে অবিলম্বে যাক নিজ দেশ।
বিদায় করহ শীঘ্র নাগরাজ শেষ।।
যজ্ঞস্থানে নাগরাজ আছে সাত দিন।
সপ্ত দিন হৈল সখা অন্নজল-হীন।।
না জানি না বুঝি নাগ কৈল অবিচার।
সখার উপরে দিল ধরণীর ভার।।
এতেক কহেন যদি দেব জগৎপতি।
লজ্জায় মলিনমুখ শেষ-অধিপতি।।
তবে অনুমতি কৈল ধর্ম্মের নন্দন।
যার যেই ভাগে লৈয়া গেলা দেবগণ।।
কাশীরাম দাস কহে রচিয়া পয়ার।
যাহার শ্রবণে হয় পাপের সংহার।।