১২. সহদেবের দিগ্বিজয়

যাম্যদিকে সহদেব সৈন্যগণ লৈয়া।
শূরসেন রাজ্যে আগে উত্তলরিল গিয়া।।
প্রীতি-পূর্ব্ব বহুরত্ন দিল নরপতি।
মৎস্যদেশ হেলায় জিনিল মহামতি।।
অধিরাজ দন্তবক্র মহা-বলধর।
সংগ্রামে জিনিয়া বীর নিল বহু কর।।
সুকুমার সুমিত্র জিনিল দুই নৃপে।
গোশৃঙ্গে জিনিল বীর নিষাদ-অধীপে।।
শ্রেণীমান রাজাকে জিনিল অবহেলে।
কুন্তীভোজ-রাজ্যে গেলা চতুরঙ্গ-দলে।।
কুন্তীভোজ-রাজা সহদেবের শাসন।
শিরোধার্য্য করিলেন হৈয়ে প্রীতমন।।
অবন্তী- নগরে বাস অনুবিন্ধ রাজা।
নানা ধন দিয়া সহদেবে কৈল পূজা।।
বিদর্ভ-নগরে চলি গেল পাণ্ডুসুত।
ভীষ্মক জানিল ইহা গোবিন্দের প্রীত।।
নানা রত্নে সহদেবে পূজা যথোচিত।
কান্তার কোশলাধিপ নাটকেয় আর।
হেরম্ব মারুধ আর মঞ্জুগ্রাম সার।।
বাতাধিপ পাণ্ড্যদেশ জিনিল সকল।
কিষ্কিন্ধ্যা প্রবেশ কৈল তবে মহাবল।।
মৈন্দ ও দ্বিবিদ নামে দুই কপিপতি।
পরসৈন্য দেখিয়া ধাইল শীঘ্রগতি।।
শিলা বৃক্ষ লইয়া সহিত কপিগণ।
বানর-মনুষ্যে তথা হৈল মহারণ।।
সপ্ত দিবারাত্র যুদ্ধ সহদেব সনে।
দেখি দুই কপিপতি প্রীতি পাইল মনে।।
জিজ্ঞাসিল কে তুমি, আইলা কি কারণ।
সহদেব কহিল সকল বিবরণ।।
বানর বলিল, এই কিষ্কিন্ধ্যনগরী।
মনুষ্যে কি শক্তি যে ইহাতে হয় অরি।।
ধর্ম্মপুত্র যুধিষ্ঠির যজ্ঞ আরম্ভিবে।
আমি কর নাহি দিলে যজ্ঞে বিঘ্ন হৈবে।।
সে কারণে দিব ধন লৈতে পার যত।
এত বলি রত্নরাজি দেয় শত শত।।
যত রত্ন পাইল, বীর দিল পাঠাইয়া।
মাহিষ্মতী-পুরে বীর উত্তরিল গিয়া।।
মাহিষ্মতী-পুরে নীলধ্বজ নামে রাজা।
পরপক্ষ শুনিয়া ধাইল মহাতেজা।।
সহদেব সহিত হইল মহারণ।
নীলধ্বজ ‍নৃপের জামাতা হুতাশন।।
বিপক্ষ দেখিয়া অগ্নি নিজ মূর্ত্তি ধরে।
সর্ব্ব-সৈন্য দহে সহদেবের গোচরে।।
দাবানলে বন যেন করয়ে দহন।
দেখিয়া বিস্ময় মানে ‍পাণ্ডুর নন্দন।।
জন্মেজয় বলে, কহ ইহার কারণ।
যজ্ঞেতে বাধক কেন হৈল হুতাশন।।
মুনি বলে, নীলধ্বজ সদা যজ্ঞ করে।
তাহার তনয়া আগে পূজে বৈশ্বানরে।।
যতক্ষণ নাহি পূজে তাহার নন্দিনী।
ততক্ষণ প্রজ্বলিত না হয় অগিনি।।
বিম্বোষ্ঠ আনন চন্দ্র দেখিয়া তাহার।
কামানলে দহে অঙ্গ অগ্নি দেবতার।।
দ্বিজমূর্ত্তি হৈয়া অগ্নি গেল তার পাশে।
মধুর বচন বলি কন্যারে সম্ভাষে।।
শুনিয়া নৃপতি ক্রোধে হইল প্রচণ্ড।
আজ্ঞা কৈল করিবারে পরদান-দণ্ড।।
ক্রোধেতে আপন মূর্ত্তি ধরে বৈশ্বানর।
আস্তে-ব্যস্তে উঠি স্তব করে নরবর।।
হৃষ্ট হৈয়ে কন্যাদান ভূপতি করিল।
সন্তুষ্ট হইয়া অগ্নি রাজারে বলিল।।
বর মাগে নরপতি, যেই লয় মনে।
রাজা বলে, সদা মম থাকিবা সদনে।।
পর-চক্র যেন মোরে নহে বলবান।
এই বর মাগি আজ্ঞা কর ভগবান।।
সন্তুষ্ট হইয়া অগ্নি বর দিল তায়।
কন্যা সহ বৈশ্বানর রহিল তথায়।।
যতেক নৃপতি আসে না জানি এমন।
মাহিষ্মতী-পুরে গেলে অবশ্য মরণ।।
ভয়েতে তথায় আর কেহ নাহি যা।
নিষ্কণ্টক রাজ্য ভুঞ্জে নীলধ্বজ-রায়।।
সহদেব-সৈন্য দহে দেব হুতাশন।
সহিতে না পারি ভঙ্গ দিল সর্ব্বজন।।
অচল পর্ব্বত প্রায় মদ্রসুতা-সুত।
বিস্ময় মানিল বীর দেখিয়া অদ্ভুত।।
হৃদয়ে চিন্তিল এই দেব হুতাশন।
অস্ত্র-শস্ত্র ত্যজি বীর করয়ে স্তবন।।
জাতবেদা হেতু দেব তোমার উৎপত্তি।
পাপহন্তা তব নাম সর্ব্বঘটে স্থিতি।।
রুদ্রগর্ভ জলোদ্ভব বায়ুসখা শিখী।
চিত্রভানু বিভাবসু নাম পিঙ্গ-আঁখি।।
তোমা আরাধিলে তুষ্ট দেব-পিতৃগণ।
যুধিষ্ঠির যজ্ঞ করে এই সে কারণ।।
নিজ ভক্তে বিঘ্ন করা নহে সমুচিত।
জগতে বিখ্যাত তুমি সবাকার হিত।।
সহদেব-স্তুতি-বশে দেব হুতাশন।
নিবর্ত্তিয়া শান্তমূর্ত্তি হইল তখন।।
আশ্বাসিয়া সহদেবে বলে বৈশ্বানর।
উঠ উঠ কুরুপুত্র না করিহ ডর।।
এই নীলধ্বজ-পুর আমার রক্ষণ।
তব সেনা দহিলাম এই সে কারণ।।
তুমি প্রিয়পাত্র মম, ক্ষমিনু তোমারে।
করিব তোমার কার্য্য জানিবে সাদরে।।
রাজারে বলিল, পূজা কর সহদেবে।
নানারত্ন ধন দিয়া পরম-গৌরবে।।
তবে নীলধ্বজ তারে পূজিল বিশেষে।
তথা হৈতে গেল বীর ত্রিপুরের দেশে।।
কৌশিক সৌরাষ্ট্র ভোজ কটকে পশিল।
ভীষ্মক-নন্দন রুক্মী সহ যুদ্ধ হৈল।।
যুদ্ধে হারি দিল কর বহু রত্ন ধন।
শূর্পাকর দেশে গেল দণ্ডক-কানন।।
সমুদ্রের তীরে ম্লেচ্ছ কিরাত-বসতি।
ক্ষণমাত্রে সবারে জিনিল মহামতি।।
রাক্ষস আছয়ে বহু তাহার দক্ষিণ।
অনেক মারিল বীর পাণ্ডুর নন্দন।।
তথা হৈতে গেল বীর দেশ দীর্ঘকর্ণ।
অতি দীর্ঘ দুই কর্ণ, শরীর বিবর্ণ।।
কালমুখ হ্রস্বমুখ কোলগিরি আদি।
বহু রাজা জিনিয়া আনিল রত্ন নিধি।।
তাম্রদ্বীপ রামগিরি জিনি অবহেলে।
একপাদ দেশে গেল অতি কুতূহলে।।
রাজ্যের যতেক লোক সবে এক ঠ্যাঙ্গ্।
অস্ত্র ধনু হাতে করি চলে যেন ব্যাঙ্গ্।।
সঞ্জয়ন্তী নগরীর ভূপতিকে জিনি।
কর্ণাট কলিঙ্গ পাণ্ড্য যত নৃপমণি।।
দ্রাবিঢ় কেরল ওড্র আটবীর রাজা।
দূত-মুখে শুনি আসি সবে কৈল পূজা।।
সেতুবন্ধ দক্ষিণ সমুদ্র-তীরে গিয়ে।
বিভীষণে লঙ্কায় দূত দিল পাঠায়ে।।
সময় বুঝিয়া রাজা রাক্ষস-ঈশ্বর।
আজ্ঞা লৈয়ে ধন রত্ন দিল বহুতর।।
তথা হৈতে নিবর্ত্তিল মাদ্রীর নন্দন।
আনন্দেতে ইন্দ্রপ্রস্থে করিল গমন।।
ধন-রত্ন নিবেদিল ধর্ম্মের নন্দনে।
সকল কহিল বার্ত্তা আনন্দিত মনে।।
দক্ষিণে পাণ্ডব-জয় যেই জন শুনে।
তাহার সর্ব্বত্র জয়, কাশীদাস ভণে।।