০৫. শ্রীকৃষ্ণ-যুধিষ্ঠির সংবাদ

বলেন গোবিন্দ প্রতি ধর্ম্মের কুমার।
নারদেরে কহিলেন জনক আমার।।
রাজসূয় মহাযজ্ঞ, দুর্ল্লভ সংসারে।
যুধিষ্ঠিরে কহ রাজসূয় করিবারে।।
এই হেতু যজ্ঞ-বাঞ্ছা হইলে আমার।
শুন এই কথা কৃষ্ণ, কহি সারোদ্ধার।।
পরস্পর আমারে সুহৃদ বলে সবে।
কেহ প্রীতে কেহ নিতে কেহ ধনলোভে।।
যে যত বলেন, নাহি লয় মম মনে।
যতক্ষণ নাহি শুনি তোমার বদনে।।
বুঝিয়া সন্দেহ প্রভু ভাঙ্গহ আমার।
কর্ত্তব্যাকর্ত্তব্য যুক্তি তোমার বিচার।।
পাণ্ডবের গতি তুমি, পাণ্ডবের পতি।
তোমা বিনা পাণ্ডবের নাহি অব্যাহতি।।
গোবিন্দ বলেন, তুমি সর্ব্ব গুণবাণ।
পৃথিবীর মধ্যে রাজা কে তব সমান।।
যোগ্য হও রাজা তুমি যজ্ঞ করিবারে।
এক নিবেদন আমি করিব তোমারে।।
আমি যাহা কহি, তাহা জান ভালমতে।
এক লক্ষ রাজা চাহি এ মহা যজ্ঞেতে।।
মগধ-ঈশ্বর জরাসন্ধ শ্রেষ্ঠ রাজা।
পৃথিবীর যত রাজা করে তার পূজা।।
তাহারে না মানে হেন, নাহি ক্ষিতিমাঝে।
বলেতে বান্ধিয়া আনে যে জন না ভজে।।
তাহার সহায় বহু দুষ্ট রাজগণ।
শিশুপাল দন্তবক্র নৃপতি যবন।।
পুণ্ডরীক বাসুদেব কোশল-ঈশ্বর।
রুক্মী ভগদত্ত রাজা মহাবলধর।।
এমত অনেক যত দুষ্ট নরপতি।
সদাকাল থাকে সবে তাহার সংহতি।।
ইক্ষবাকু ইলার বংশে যত যত জন।।
তার ভয়ে নিজ দেশে রহিতে নারিয়া।
উত্তর দেশেতে সবে গেল পলাইয়া।।
জরাসন্ধের দুই কন্যা অস্তি প্রাপ্তি বলি।
কংসের বনিতা দোঁহে আমার মাতুলী।।
স্বামীর কারণে বাপে গোহারী করিল।
সসৈন্য মগধপতি মথুরা বেড়িল।।
অসংখ্য তাহার সৈন্য, কে গণিতে পারে।
ক্ষয় নাহি, মারিলেক শতেক বৎসরে।।
রাম আমি দুই ভাই করিনু সংহার।
সে হেতু আইল সাজি অষ্টাদশবার।।
তবে চিত্তে বিচার করিনু সর্ব্বজন।
মথুরা বসতি আর নহে সুশোভন।।
নিরন্তর দুই কন্যা কহিবেক বাপে।
পুনঃ পুনঃ জরাসন্ধ আসিবেক কোপে।।
এমত বিচারি সবে মথুরা ত্যজিয়া।
দূরস্থান দ্বারকিয় রহিলাম গিয়া।।
তার পক্ষে না যুঝে যে সব রাজগণে।
বন্দী করি রাখিয়াছে আপন ভবনে।।
পশুবৎ করি সব রাখিয়াছে রাজা।
সবাকারে বলি দিবে করি রুদ্র পূজা।।
ছিয়াশী হাজার ভূপ আছে বন্দিশালে।
তব যজ্ঞ হয় রাজা সব মুক্ত হৈলে।।
জরাসন্ধে বিনাশিলে সর্ব্ব সিদ্ধ হয়।
নিষ্কণ্টকে যজ্ঞ তবে কর মহাশয়।।
জরাসন্ধ জীয়ন্তে না হয় কোন কাজ।
তারে মারি বশ কর রাজার সমাজ।।
হইবে অতুল যশ সংসার ভিতরে।
আমার যুকতি এই কহিনু তোমারে।।
এতেক বলিলা যদি কমললোচন।
কৃষ্ণের কহেন রাজা ধর্ম্মের নন্দন।।
সমুচিত যতেক কহিলা মহাশয়।
ইহা না করিলে যজ্ঞ কি প্রকারে হয়।।
শান্তি আচরণ আমি করি যে প্রথমে।
পৃথিবীর রাজা বাধ্য করি ক্রমে ক্রমে।।
পশ্চাতে করিব জরাসন্ধের উপায়।
মম মত এই, কহিলাম যে তোমায়।।
ভীমসেন বলে, না লয় মম মনে।
প্রথমে মারিব বৃহদ্রথের নন্দনে।।
তারে মারি মুক্ত যদি করি রাজগণ।
যজ্ঞে বিঘ্ন করে তবে, নাহি হেন জন।।
রাজা হৈয়া শান্তি ভজে, লক্ষ্মী নাহি পায়।
পূর্ব্ব-রাজগণ কর্ম্ম কহি শুন রায়।।
বাহুবলে ভারত শাসিল ভূমণ্ডল।
মান্ধাতা নৃপতি কর ত্যাজিল সকল।।
প্রতাপেতে কার্ত্তবীর্য্য ঘোষে জগজ্জন।
ভগীরথ খ্যাত করি প্রজার পালন।।
শ্রীকৃষ্ণ বলেন, রাজা কর অবগতি।
যেমতে হইবে হত মগধের পতি।।
সৈন্যে সাজি তাহারে নারিবে কদাচিত।
অসংখ্য দুর্দ্দান্ত সৈন্য যাহার রক্ষিত।।
ভীমার্জ্জুন দেহ রাজা আমার সংহতি।
উপায়ে করিব হত মগধের পতি।।
শুনিয়া বলেন তবে ধর্ম্মের তনয়।
যতেক কহিলা মম চিত্তে নাহি লয়।।
মহারাজ জরাসন্ধ রাজচক্রবর্ত্তী।
যাহারে করেন ভয় ইন্দ্র সুরপতি।।
যার ভয়ে জগন্নাথ মথুরা ত্যজিয়া।
পশ্চিম সমুদ্রতীরে রহিলেন গিয়া।।
ভীমার্জ্জুন চক্ষু মম, কৃষ্ণ ‍তুমি প্রাণ।
সঙ্কটেতে পাঠাইব, না হয় বিধান।।
হেন যজ্ঞে প্রয়োজন নাহিক আমার।
সন্ন্যাসী হইয়া পাছে ভ্রমিব সংসার।।
এত শুনি তখন কহেন ধনঞ্জয়।
কেন হেন না বুঝিয়া বল মহাশয়।।
চিরজীবী নহে কেহ সংসার ভিতর।
যুদ্ধ না করিয়া কেবা আছয়ে অমর।।
বিনা দুঃখে সঙ্কটেতে নহে কোন কর্ম্ম।
সুকম্ম বিহীন রাজা, বৃথা তার জন্ম।।
এ উপায়ে কর্ম্ম যদি না হয় সাধন।
পশ্চাৎ করিব তাহা, যাহা লয় মন।।
এতেক বলেন যদি ইন্দ্রের নন্দন।
সাধু বলি প্রশংসা করেন নারায়ণ।।
সভাপর্ব্ব সুধারস জরাসন্ধ-বধে।
কাশীরাম দাস কহে, গোবিন্দের পদে।।