০৩. নারদ কর্ত্তৃক লোকপালগণের সভা বর্ণন

নারদ বলেন, রাজা কর অবধান।
ইন্দ্রের সভার কথা কহি তব স্থান।।
দেবশিল্পী পটু বিশ্বকর্ম্মার দ্বারায়।
নির্ম্মাণ করান নিজ মহতী সভায়।।
বিবিধ বিধান চিত্র কোটিচন্দ্র প্রভা।
দেবঋষি ব্রহ্মঋষি ধার্ম্মিকের সভা।।
উচ্চ পঞ্চ যোজনেক শতেক বিস্তার।
শচী হস ইন্দ্র সদা করেন বিহার।।
সেই সভা শূন্যপথে পারয়ে থাকিতে।
যথা ইচ্ছা পারে তাহা যাইতে আসিতে।।
জরা শোক ভয় নাহি সতত আনন্দ।
ইন্দ্রের আশ্রমে সদা থাকে সুরবৃন্দ।।
মরুত কুবের আদি সিন্ধ সাধ্যগণ।
অম্লান কুসুম বস্ত্র সবার ভূষণ।।
অষ্টবসু নবগ্রহ ধর্ম্ম কাম অর্থ।
তড়িৎ বিদ্যুৎ সপ্তবিংশ কৃষ্ণবর্ত্ম।।
যজ্ঞ মন্ত্র দক্ষিণা আছয়ে মূর্ত্তিমন্ত।
দেব ঋষি পুণ্য জন লিখিতে অনন্ত।।
দেবতা তেত্রিশ কোটি সেবে পুরন্দরে।
বর্ণিতে না পারি সভা গুণ যত ধরে।।
হরিশচন্দ্র নরপতি আছয়ে তথায়।
আর যত পুণ্যজন লিখনে না যায়।।
নারদ বলেন, শুন সভার প্রধান।
শমন রাজার সভা কর অবধান।।
দীর্ঘ প্রস্থ শত শত যোজন বিস্তার।
আদিত্য-সমান প্রভা, গতি কামাচার।।
নহে শীত, নহে উষ্ণ, নাহি ‍দুঃখ লোকে।
প্রেমময়, নাহি হিংসা, সদাকাল সুখে।।
কতেক কহিব কথা যতেক বিষয়।
কিঞ্চিৎ কিঞ্চিৎ কহি শুন মহাশয়।।
যযাতি নহুষ পুরু মান্ধাতা ভরত।
কৃতবীর্য্য কার্ত্তবীর্য্য সুনীত সুরথ।।
শিবি মৎস্য বৃহদ্রথ নল বহীনর।
শ্রুতশ্রবা পৃথুলাশ্ব ও উপরিচর।।
দিবোদাস অম্বরীষ রঘু প্রতর্দ্দন।
পৃষদশ্ব সদশ্ব মরুত্ত বসুমান।।
শরভ সঞ্জয় বেণ ঐল উশীনর।
পুরু কুৎস প্রদ্যুন্ন বাহ্লীক নৃপবর।।
শশবিন্দু কক্ষসেন সগর কৈকয়।
জনক ত্রিগর্ত্ত বার্ত্ত জয় জন্মেজয়।।
অজ ভগীরথ দিলীপ লক্ষ্মণ রাম।
ভীমজানু পৃথু পৃথুবেগ করন্দম।।
শত ধৃতরাষ্ট্র আছে, ভীষ্ম দুই শত।
শত ভীম, কৃষ্ণার্জ্জুন শত, আর কত।।
প্রতীপ শান্তনু পাণ্ডু জনক তোমার।
কতেক কহিব তথা, যত আছে আর।।
অশ্বমেধ যজ্ঞ আদি বহু দান ফলে।
তথায় যে পুণ্যবান বৈসেন সকলে।।
বরুণের সভা কহি, কর অবধান।
অপূর্ব্ব সভার শোভা বিচিত্র বাখান।।
বিশ্বকর্ম্মা বিরচিল সভা অনুপাম।
জলের ভিতর সে পুষ্করমালী নাম।।
শত শত যোজন বিস্তার দৈর্ঘ্য তার।
নানা রত্ন বহুবর্ণ কহিতে বিস্তার।।
নিবসে বরুণ তথা বারুণী সহিত।
পুত্র পৌত্র পাত্র মিত্র সহ পুরোহিত।।
দ্বাদশ আদিত্য আর নাগগণ যত।
বাসুকি তক্ষক কর্কোটক ঐরাবত।।
সংহ্লাদ প্রহ্লাদ বলি নমুচি দানব।
বিপ্রচিত্তি কালকেয় দুর্ম্মুখ সরভ।।
মূর্ত্তিমন্ত চারি সিন্ধু আরো নদীগণ।
জাহ্নবী যমুনা সিন্ধু সরস্বতী শোণ।।
চন্দ্রভাগা বিপাশা বিতস্তা ইরাবতী।
শতদ্রু সরযূ আরো নদী চর্ম্মণ্বতী।।
কিম্পুনা বিদিশা কৃষ্ণবেণা গোদাবরী।
নর্ম্মদা বিশল্যা বেণ্বা লাঙ্গলী কাবেরী।।
দেবনদী মহানদী ভারবী ভৈরবী।
ক্ষীরবতী দুগ্ধবতী লোহিতা সুরভি।।
করতোয়া গণ্ডকী আত্রেয়ী শ্রীগোমতী।
ঝুম্ঝুমি স্বর্ণরেখা নদী পদ্মবতী।।
মূর্ত্তিমতী হইয়া তথায় আছে সবে।
তড়াগ পুষ্করিণ্যাদি বরুণেরে সেবে।।
চারি মেঘ বৈসে তথা সহ পরিবার।
কহিতে না পারি কত, যত বৈসে আর।।
কুবেরের সভা রাজা কর অবধান।
কৈলাস-শিখরে বিশ্বকর্ম্মার নির্ম্মাণ।।
শতেক যোজন দীর্ঘ বিস্তার সত্তরি।
নিবসে গুহ্যক যক্ষ কিন্নর কিন্নরী।।
চিত্রসেন রম্ভা চিত্রা ঘৃতাচী মেনকা।
চারুনেত্রা ঊর্ব্বশী বুদ্ধুদা চিত্ররেখা।।
মিশ্রকেশী অলম্বুষা কত মহাদেবী।
নৃত্য গীত বাদ্যে সদা কুবেরেরে সেবি।।
পুত্র নলকূবর আরো যে মন্ত্রিগণ।
মণিভদ্র শ্বেতভদ্র ভদ্র সুলোচন।।
গন্ধর্ব্ব কিন্নর যক্ষ আছে লক্ষ লক্ষ।
ভূত প্রেত পিশাচ রাক্ষস দৈত্য রক্ষ।।
ফলকর্ণ ফলোদক তুম্বুরু প্রভৃতি।
হাহা হূহূ বিশ্বাবসু চিত্রসেন কৃতী।।
চিত্ররথ মহেন্দ্র মাতঙ্গ বিদ্যাধর।
বিভীষণ থাকে সদা সহ সহোদর।।
আছয়ে পর্ব্বতগণ মুর্ত্তিমন্ত হৈয়া।
হিমাদ্রি মৈনাক গন্ধমাদন মলয়া।।
আমিও থাকি যে আমা তুল্য বহু আছে।
উমাসহ সদানন্দ সবাই বিরাজে।।
নন্দী ভৃঙ্গী গণপতি কার্ত্তিক বৃষভ।
পিশাচ খেচর ‍দানা শিবাগণ সব।।
আর যত আছে, তাহা কহিতে কে পারে।
কহিব ব্রহ্মার সভা শুন অতঃপরে।।
পূর্ব্বে দেবযুগে দিব্য নামে দিবাকর।
ভ্রমেন মনুষ্যলোকে হয়ে দেহধর।।
আচম্বিতে আমারে দেখিলা মহাশয়।
দিব্যচক্ষে জানিয়া নিলেন পরিচয়।।
ব্রহ্মার সভার গুণ কহিল আমারে।
শুনিয়া হইল ইচ্ছা সভা দেখিবারে।।
তাঁরে জিজ্ঞাসিলাম করিয়া সবিনয়।
কিমতে ব্রহ্মার সভা মম দৃশ্য হয়।।
সূর্য্য বৈল সহস্র বৎসর ব্রতী হৈয়া।
করহ কঠোর তপ হিমালয়ে গিয়া।।
শুনি করিলাম তপ সহস্র বৎসর।
পরে পুনঃ আইলেন দেব দিবাকর।।
আমা সঙ্গে করিয়া গেলেন ব্রহ্মপুরী।
দেখিলাম যাহা তাহা কহিতে না পারি।।
তার অন্ত নাহিক, নাহিক পরিমাণ।
অতুলন সেই সভা ব্রহ্মার নির্ম্মাণ।।
চন্দ্র সূর্য্য নিন্দিয়া সে সভার কিরণ।
শূন্যেতে শোভিছে সভা না যায় নয়ন।।
তথায় থাকিয়া বিধি করেন বিধান।
প্রজাপতিগণ থাকে তাঁর সন্নিধান।।
প্রচেতা মরীচি দক্ষ পুলহ গৌতম।
অঙ্গিরা বশিষ্ঠ ভৃগু সনক কর্দ্দম।।
কশ্যপ বলিষ্ঠ ত্রুতু পুলস্ত্য প্রহ্লাদ।
বালখিল্য অগস্ত্য মাণ্ডব্য ভরদ্বাজ।।
বিদ্যমান অন্তরীক্ষে আত্মা অক্ষগণ।
বায়ু তেজে পৃথ্বী জল শব্দ পরশন।।
গন্ধর্ব্ব সকল আছে মূর্ত্তিমন্ত হৈয়া।
আয়ুর্ব্বেদ চন্দ্র তারা সূর্য্য সন্ধ্যা ছায়া।।
ধর্ম্ম অর্থ কাম মোক্ষ কান্তি শান্তি ক্ষমা।
অষ্টবসু নবগ্রহ শিব সহ উমা।।
চতুর্ব্বেদ ষটশাস্ত্র তন্ত্র শ্রুতি স্মৃতি।
চারি যুগ বর্ষ ‍মাস দিবা সহ রাতি।।
সাবিত্রী ভারতী লক্ষ্মী অদিতি বিনতা।
ভদ্রা ষষ্ঠী অরুন্ধতী কদ্রু নাগমাতা।।
মূর্ত্তিমন্ত হইয়া আছেন নারায়ণ।
ইন্দ্র যম কুবের বরুণ হুতাশন।।
আমার কি শক্তি তাহা বর্ণিবারে পারি।
নিত্য আসি সেবে সবে সৃষ্টি অধিকারী।।
এত সভা দেখিয়াছি আমি এ নয়নে।
তব সভা তুল্য নাহি মনুষ্য-ভুবনে।।
যুধিষ্ঠির বলিলেন, তুমি মনোজব।
তোমার প্রসাদে শুনিলাম এই সব।।
এক কথা শুনিয়া বিস্ময় জন্মে মনে।
যতেক নৃপতি সব যমের ভবনে।।
একা হরিশচন্দ্র কেন ইন্দ্রের আলয়।
কোন্ পুণ্য দানফলে কহ মহাশয়।।
যমালয়ে যবে দেখিলাম মম পিতা।
আমার বারতা কিছু কহিলেন তথা।।
নারদ বলেন, শুন পাণ্ড প্রধান।
সূর্য্যবংশে শ্রেষ্ঠ হরিশচন্দ্রের আখ্যান।।
এক রথে চড়িয়া জিনিল মর্ত্ত্যপুর।
বাহুবলে হৈল সপ্তদ্বীপের ঠাকুর।।
রাজসূয়-যজ্ঞ সে করিল হরিশচন্দ্র।
আজ্ঞায় আইল যত ছিল রাজবৃন্দ।।
অনেক ব্রাহ্মণ আইল যজ্ঞের সদন।
প্রতি দ্বিজে সেই রাজা করিল সেবন।।
শাস্ত্রমত দক্ষিণা যে বলিলা ব্রাহ্মণ।
পঞ্চগুণ করি তারে দিলেন রাজন।।
সব রাজা হৈতে সে করিল বড় কর্ম্ম।
ইন্দ্রলোকে তাই রহে করি মহা ধর্ম্ম।।
আর যত রাজা রাজসূয়-যজ্ঞ কৈল।
সম্মুখ সংগ্রাম করি যাহারা মরিল।।
যোগিগণ যোগে নিজ দেহত্যাগ করে।
সেই সব লোক বৈসে ইন্দ্রের নগরে।।
কহি শুন তোমার পিতার সমাচার।
যমালয়ে দেখা হৈল সহিত তাঁহার।।
বহু কথা কহিলেন করিয়া বিনয়।
যুধিষ্ঠির ধর্ম্মরাজ আমার তনয়।।
অনুগত তাঁর বীর্য্যবন্ত ভ্রাতৃগণ।
যাঁহার সহায় কৃষ্ণ কমল-লোচন।।
পৃথিবীতে তাঁহার অসাধ্য কিছু নয়।
রাজসূয় যজ্ঞ তাঁর অবহেলে হয়।।
এই রাজসূয় যদি করে ধর্ম্মরাজ।
হরিশচন্দ্র সহ বৈসে ইন্দ্রের সমাজ।।
তোমার জনক ইহা কহিল আমারে।
যে হয় উচিত রাজা করহ বিচারে।।
সর্ব্ব যজ্ঞ হৈতে শ্রেষ্ঠ রাজসূয় গণি।
বহু বিঘ্ন হয় ইথে, আমি ভাল জানি।।
ছিদ্র পেয়ে যজ্ঞ নাশ যক্ষ রক্ষ করে।
যজ্ঞ হেতু রাজগণ যুদ্ধ করি মরে।।
যেমতে মঙ্গল হয়, কর নরপতি।
আমারে বিদায় কর যাব দ্বারাবতী।।
এত বলি প্রস্থান করেন মুনিবর।
শ্রীকৃষ্ণ দর্শন হেতু দ্বারকা-নগর।।
সভাপর্ব্বে অনুপম সভার বর্ণন।
কাশীরাম দাস কহে, শুনে সাধুজন।।