০১. ময়দানব কর্ত্তৃক ইন্দ্রপ্রস্থে সভাগৃহ নির্মাণ

জন্মেজয় বলে, মুনি কর অবধান।
কৃষ্ণসহ পিতামহ দানব প্রধান।।
খাণ্ডব দহিয়া ইন্দ্রপস্থে উত্তরিয়া।
কি কি কর্ম্ম করিলেন কহ বিস্তারিয়া।।
শুনিতে আমার চিত্তে পরম আনন্দ।
তব মুখে শুনিয়া ঘুচুক মনোধন্ধ।।
বৈশম্পায়ন বলেন, শুন নৃপবর।
অগ্নি সত্যে পার হৈয়া পার্থ ধনুর্দ্ধর।।
ধর্ম্মরাজে কহিলেন সব বিবরণ।
পরম আনন্দে রাজা কৈলা আলিঙ্গন।।
লক্ষ লক্ষ ধেনু স্বর্ণ দ্বিজে দিল দান।
ময়দানবের বহু করিল সম্মান।।
পাণ্ডবের মহাকীর্ত্তি ব্যাপিল সংসার।
রিপুগণে শুনি লাগে অতি চমৎকার।।
হেনমতে নানাসুখে থাকেন পাণ্ডব।
সদা যাগ যজ্ঞ দান মহোৎসব।।
মুনি বলে, শুন পরীক্ষিতের নন্দন।
ভারতের সভাপর্ব্ব বিচিত্র কথন।।
শ্রীকৃষ্ণ পার্থের অগ্রে করি যোড়কর।
বিনয় করিয়া বলে দানব-ঈশ্বর।।
সুদর্শন-চক্রে ভয় করে তিনলোকে।
হেন চক্র হৈতে উদ্ধারিলে হে আমাকে।।
প্রচণ্ড অনল মুখে কৈলে পরিত্রাণ।
আজি হৈতে তোমাতে বিক্রীত মম প্রাণ।।
কি করিব আজ্ঞা মোরে কর মহাশয়।
তব প্রীতি হেতু আমি ব্যাকুল হৃদয়।।
অর্জ্জুন বলেন, যাহ দানব-ঈশ্বর।
রাখিও আমাতে প্রীতি তুমি নিরন্তর।।
ময় বলে, যাবৎ না করি তব কর্ম্ম।
তাবৎ রহিবে মম মানবে অধর্ম্ম।।
দানবকুলের শ্রেষ্ট বিশ্বকর্ম্মা আমি।
করিব অবশ্য যাহা আজ্ঞা কর তুমি।।
পার্থ বলে, কিছু আমি না চাহি তোমারে।
যা পারহ করহ প্রীত দেব দামোদরে।।
করযোড়ে বলে ময় কৃষ্ণের গোচর।
কি করিব, আজ্ঞা কর দেব দামোদর।।
হৃদয়ে চিন্তিয়া কৃষ্ণ বলেন বচন।
দিব্য চিন্তিয়া কৃষ্ণ বলেন বচন।।
হেন সভা কর যাহা কেহ নাহি দেখে।
অদ্ভুত হইবে সুরাসুর তিনলোকে।।
কৃষ্ণের আদেশে ময় আনন্দিত হৈল।
নির্ম্মিতে সুন্দর সভা শীঘ্রগতি গেল।।
কনক-রচিত চিত্র বিচিত্র নিম্মার্ণ।
নানাগুণযুত যেন দেবতার স্থান।।
চৌদিকে সহস্র-দশ ক্রোশ পরিসর।
সুরাসুর নাগ নর সব অগোচর।।
রচিয়া বিচিত্র সভা দানব-প্রধান।
সবিনয়ে জানাইলে কৃষ্ণ-বিদ্যমান।।
যুধিষ্ঠির ‍কৃষ্ণ পার্থ প্রশংসি দানবে।
দেখিতে গেলেন সভা মহানন্দে সবে।।
দ্বিজগণে পায়সান্ন করান ভোজন।
নানা রত্ন দান দেন রজত কাঞ্চন।।
শুভক্ষণে করিলেন প্রবেশ সভায়।
পাণ্ডব সপরিবারে রহেন তথায়।।
বহুদিন রহি কৃষ্ণ পাণ্ডবের প্রীতে।
পিতৃ-দরশনে যাব ভাবিলেন চিতে।।
পিতৃষ্বাসা কুন্তীর বন্দিলা দুই পাদ।
আলিঙ্গনে ভোজসুতা করেন প্রসাদ।।
সুভদ্রা ভগিনী স্থানে করিয়া গমন।
গদগদ মৃদুবাক্য সজল নয়ন।।
কহেন রুক্মিণীকান্ত ভদ্রা প্রবোধিয়া।
স্নেহেতে চক্ষুর জল পড়িছে বহিয়া।।
সেবিবে শাশুড়ী কুন্তীদেবীর চরণে।
সমভাবে সর্ব্বদা বঞ্চিবে কৃষ্ণা সনে।।
তত্ত্বকথা কহিয়া চলেন গদাধর।
প্রণমিয়া ভদ্রা দেবী কান্দে উচ্চৈঃস্বর।।
ভদ্রা প্রবোধিয়া কৃষ্ণ গিয়া কৃষ্ণা-পাশে।
বিনয়ে কহেন তাঁকে মৃদুমন্দ-ভাষে।।
প্রাণের অধিক মম সুভদ্রা ভগিনী।
সদাকাল স্নেহ তারে করিবে আপনি।।
দ্রৌপদীরে সম্ভাষিয়া যান নারায়ণ।
ধৌম্য পুরোহিত সহ করি সম্ভাষণ।।
যুধিষ্ঠিরে কহিলেন করি নমস্কার।
আজ্ঞা কর গৃহে আমি যাব আপনার।।
শুনিয়া ধর্ম্মের পুত্র বিষণ্ন বদন।
কৃষ্ণে আলিঙ্গন করি সজল লোচন।।
ভীমার্জ্জুন সহ কৃষ্ণ কৈল কোলাকুলি।
কৃষ্ণে প্রণমিল মাদ্রীপুত্র মহাবলী।।
শুভ তিথি নক্ষত্র গণক জানাইল।
বেদবিধি মঙ্গল ব্রাহ্মণ উচ্চারিল।।
দারুক গরুড়ধ্বজ করিয়া সাজন।
গোবিন্দের অগ্রে লয়ে দিল ততক্ষণ।।
যাত্রা শুভ, যাঁর নাম করিলে স্মরণ।
তিনি যাত্রা করিলেন করি শুভক্ষণ।।
স্নেহেতে কৃষ্ণের সহ ধর্ম্মের নন্দন।
খড়পতিধ্বজে আরোহেন ছয় জন।।
রথ চালাইয়া দিল দারুক সারথি।
যোজনান্তে গিয়া ধর্ম্মে কহিলা শ্রীপতি।।
নিবর্ত্তহ মহারাজ, যাহ নিজালয়।
আমাতে রাখিহ সদা সদয় হৃদয়।।
আলিঙ্গন করি পার্থ সজল নয়ন।
বহুকষ্টে নিবৃত্ত হইল পঞ্চজন।।
আত্মা যেন পাণ্ডবের কৃষ্ণ সহ গেল।
কেবল শরীর লৈয়ে পাণ্ডব রহিল।।
বিরস বদনে ফিরিলেন পঞ্চ জন।
গেলেন দ্বারকাপুরে দ্বারকা-রমণ।।
তবে ময় বলে ধনঞ্জয়-বিদ্যমান।
মম মনোমত সভা নহিল নির্ম্মাণ।।
আজ্ঞা কর, যাব আমি মৈনাক-পর্ব্বতে।
কৈলাস উত্তরে হিমালয় সন্নিহিতে।।
বৃষপর্ব্বা নামে ছিল দানবের পতি।
চৌদিকে শাসিয়া তথা করিল বসতি।।
করিলাম তার সভা পূর্ব্বেতে নির্ম্মাণ।
নানা রত্ন-মণিময় আছে সেই স্থান।।
এ তিন লোকেতে যত দিব্য রত্ন ছিল।
নানা রত্নে নানা শস্ত্রে গৃহ পূর্ণ কৈল।।
কৌমোদকী গদা তুল্য আছে গদাবর।
সে গদার যোগ্য হয় বীর বৃকোদর।।
তব হস্তে যেমন গাণ্ডীব ধনু সাজে।
হেন গদাবর আছে বিন্দু-সরো-মাঝে।।
বরুণে জিনিয়া বৃষপর্ব্বা দৈত্যেস্বর।
দেবদত্ত শঙ্খ সে পাইল মনোহর।।
যার শব্দ শুনি দর্প ত্যজে রিপুগণ।
সে শঙ্খ তোমারে হয় বিশেষ শোভন।।
এই সব দ্রব্য আছে বিন্দু সরোবরে।
আজ্ঞা কর, গিয়া আমি আনিব সত্বরে।।
অর্জ্জুন বলেন, যদি করিয়াছ মনে।
যাহা চিত্তে লয়, তাহা করহ আপনে।।
ইহা শুনি চলিল দানবরাজ ময়।
কৈলাসের উত্তরেতে মৈনাক যথা রয়।।
ভাগীরথী হেতু যথা রাজা ভগীরথ।
বহুকাল পর্য্যন্ত করিয়াছিল ব্রত।।
নর নারায়ণ শিব যম পুরন্দর।
যথা করিলেক যজ্ঞ অনেক বৎসর।।
যথা স্রষ্টা করিলেন সৃষ্টির কল্পনা।
বহু গুণবন্ত স্থান, না হয় বর্ণনা।।
ময় গিয়া সব দ্রব্য বাহির করিল।
রাক্ষস কিন্নরগণ শিরে করি নিল।।
দেবদত্ত শঙ্খ নিল গদা অনুপাম।
যত রত্ন নিল, তার কত লব নাম।।
ভীমে গদা দিল, শঙ্খ দিল অর্জ্জুনেরে।
দেখি আনন্দিত হৈল দুই সহোদরে।।
কনক বৈদূর্যমণি মুকুতা প্রবাল।
মরকত স্ফটিক রজত চিত্র ঢাল।।
স্ফটিকের স্তম্ভ সব, চিত্র মণিহীরা।
সর্ব্ব গৃহে লম্বে মণি মুকুতার ঝারা।।
বসিবার স্থান সব কৈল রত্নছেদি।
বিচিত্র রচন কৈল নানামত বেদী।।
নানা জাতি বৃক্ষে সব ফল ফুল শোভে।
ভ্রময়ে ভ্রমরগ মকরন্দ লোভে।।
ভানু বৃহদ্ভানু জিনি পূর্ণ চন্দ্রপ্রভা।
সুরাসুর অপূর্ব্ব করিল ময় সভা।।
উচ্চ নীচ বুঝিবারে ভ্রম হয় লোকে।
বিশেষে বিপক্ষগণ চক্ষে নাহি দেখে।।
একমাসে সভা ময় করিয়া রচন।
কুন্তী-পুত্র প্রতি করিলেন নিবেদন।।
সভা দেখি আনন্দিত ধর্ম্মের নন্দন।
আনিলেন দেখাইতে ধর্ম্মের নন্দন।।
আনিলেন দেখাইতে পরিবারগণ।।
দশ লক্ষ ব্রাহ্মণেরে করান ভোজন।
আনন্দ-সাগরে মগ্ন ভাই পঞ্চ জন।।
ঘৃত দুগ্ধ অন্ন ফল মূল যত ভক্ষ্য।
হরিণ বরাহ মেষ কটি লক্ষ লক্ষ।।
যে জন যে ভক্ষ্যে তৃপ্ত তাহা সে পাইল।
ভোজনান্তে দ্বিজগণ স্বস্তি উচ্চারিল।।
দ্বিজগণ স্বস্তি শব্দে পরম উল্লাসে।
নানা রত্ন দান পেয়ে চলিল সন্তোষে।।
কত মুনিগণ তবে ধর্ম্মপুত্র-প্রীতে।
আশ্রম করিয়া রহিলেন সভাতে।।
অসিত দেবল সত্য সর্পমালী ঋষি।
মহাশিরা অর্ব্বাবসু সুমিত্র তপস্বী।।
মৈত্রেয় শুনক বলি সুমন্ত জৈমিনি।
কৃষ্ণদ্বৈপায়ন পৈল চারি শিষ্য গণি।।
জাতুকর্ণ শিখাবান পৈঙ্গ অপ্সু হৌম্য।
কৌশিক মাণ্ডব্য মার্কণ্ডেয় বক ধৌম্য।।
জঙ্ঘাবন্ধু রৈভ্য কোপবেগ পরাশয়।
পারিজাত সত্যপাল শাণ্ডিল্য প্রবর।।
গালব কৌণ্ডিন্য সনাতন বভ্রুমালী।
বরাহ সাবর্ণ ভৃগু কালাপ ত্রৈবলি।।
ইত্যাদি অনেক ঋষি না যায় গণন।
সত্যবাদী জিতেন্দ্রিয় প্রতি তপোধন।।
যুধিষ্টির সভাতে থাকেন অহর্নিশি।
পুরাণ প্রসঙ্গ ধর্ম্ম নানা কথা ভাষি।।
পৃথিবীতে বৈসে যত মুখ্য ক্ষত্রগণ।
যুধিষ্টির সভায় থাকেন অনুক্ষণ।।
মুঞ্জকেতু বির্বন্ধন কুন্তি উগ্রসেন।
সুধর্ম্মা সুকর্ম্মা কৃতবর্ম্মা জয়সেন।।
অঙ্গ বঙ্গ কলিঙ্গ মগধ-অধিপতি।
সুমিত্র সুমনা ভোজ সুশর্ম্মা প্রভৃতি।।
বসুদান চেকিতান মালবাধিকারী।
কেতুমান জয়ন্ত সুষেণ দণ্ডধারী।।
মৎস্যরাজ ভীষ্মক কৈকেয় শিশুপাল।
সুমিত্র যবনপতি শল্য মহাশাল।।
বৃষ্ণি ভোজ যদুবংশে যতেক কুমার।
ইত্যাদি অনেক রাজা গণিতে অপার।।
অর্জ্জুনের স্থানে অস্ত্র শিক্ষার কারণ।
জিতেন্দ্রিয় বৃত্তি হৈয়া থাকে সর্ব্বক্ষণ।।
চিত্রসেন তুম্বুরু-গন্ধর্ব্ব-অধিপতি।
অপ্সর কিন্নর নিজ অমাত্য সংহতি।।
নৃত্য গীত বাদ্যরসে পাণ্ডবেরে সেবে।
বিবিঞ্চি সেবে যেন ইন্দ্র আদি দেবে।।
না হইল না হইবে আর সভান্তর।
হেনমতে বঞ্চে সুখে পঞ্চ সহোদর।।
নৃত্য গীত বাদ্যরসে পাণ্ডবেরে সেবে।
বিরিঞ্চিকে সেবে যেন ইন্দ্র আদি দেবে।।
না হইল না হইবে আর সভান্তর।
হেনমতে বঞ্চে সুখে পঞ্চ সহোদর।।
পভাপর্ব্বে উত্তম সভার অনুবদ্ধ।
কাশীরাম দেব কহে, পাঁচালীর ছন্দ।।