৪৩. দুর্য্যোধনের মুকুটচ্ছেদন ও কুরুসৈন্যের নানা দুরবস্থা

সৈন্য হৈতে বাহিরায় তবে পার্থ বীর।
মেঘ হৈতে মুক্ত যেন হইল মিহির।।
চতুর্দ্দিকে ভঙ্গীয়ান যত সেনাগণ।
ভয়েতে কম্পিত সবে, শ্বাস ঘনে ঘন।।
কেশ বাস মুক্ত সবে কম্পিত হৃদয়।
পার্থে দেখি কৃতাঞ্জলি কহে সবিনয়।।
আজ্ঞা কর, কি করিব কুন্তীর কুমার।
পিতা পিতামহ সবে সেবক তোমার।।
সেবক জনেরে ক্রোধ না হয় বিচার।
রক্ষা কর লইলাম শরণ তোমর।।
অর্জ্জুন কহেন, তোরা না করিস ভয়।
যাহ নিজ স্থানে সবে নিঃশঙ্ক হৃদয়।।
যুদ্ধেতে নিবৃত্ত আমি, বিনয়ী যে জন।
তাহার নাহিক ভয় আমার সদন।।
তবে কতদূরে থাকি দেখেন অর্জ্জুন।
চৈতন্য পাইল কতক্ষণে কুরুগণ।।
একজন-মুখ আর জন নাহি চায়।
লজ্জায় যতেক বীর হৈল মৃতপ্রায়।।
কার শিরে নাহি পাগ, কার শিরে বাস।
লাজে মুখ তুলি কেহ নাহি কহে ভাষ।।
দূরে থাকি ধনঞ্জয় মারে দশ বাণ।
গুরু-বৃদ্ধ-পদরজে করিতে প্রণাম।।
অর্দ্ধচন্দ্র বাণ তবে মারেন কিরীটি।
দুর্য্যোধনের মুকুট পাড়িলেন কাটি।।
ভয়েতে আচ্ছন্ন রাজা চারিদিকে চায়।
সবাকার মধ্যে গিয়া আপনি লুকায়।।
দ্রোণাচার্য্য বলেন, না কর আর ভয়।
বড় ক্ষমাশীল হয় কুন্তীর তনয়।।
তোমারে অর্জ্জুন যদি নিশ্চয় মারিবে।
মস্তক থাকিতে কেন মুকুট কাটিবে।।
বিশেষে নৃপতি ধর্ম্ম দয়া তোমা করে।
তাঁর আজ্ঞা বিনা পার্থ মানিতে না পারে।।
সে হেতু ক্ষমিল তোমা, করি অনুমান।
বৃকোদর হৈলে নিত সবাকার প্রাণ।।
চল চল হেথা হৈতে, বিলম্ব না সয়।
মনে হয় বৃকোদর আসিবে ত্বরায়।।
হেনকালে বলিতেছে শকুনি-সারথি।
রথেতে মাতুল তব নাহি নরপতি।।
শুনি, কহে দুর্য্যোধন বিষণ্ণ বদন।
রথেতে মাতুল নাহি দেখি কি কারণ।।
কেহ বলে, তারে ক্রোধ অনেক আছিল।
বান্ধিয়া অর্জ্জুন বুঝি সঙ্গে লয়ে গেল।।
কেহ বলে, যুদ্ধে কিবা পড়িল শকুনি।
কেহ বলে, আগু পলাইল হেন জানি।।
রাজা বলে, মাতুলেরে খুঁজ, কোথা গেল।
আজ্ঞামাত্র চতুর্দ্দিকে সবাই ধাইল।।
অনেক ভ্রমই করি সবে চতুর্ভিত।
রজকের ঘরে দেখে শকুনি ব্যথিত।।
গর্দ্দভের পৃষ্ঠে বান্ধিয়াছে হাতে পায়।
ডাক দিয়া বলে মোর প্রাণ বাহিরায়।।
মুক্ত করি শকুনিরে নিল সেইক্ষণ।
নৃপতিরে কহে গিয়া সব বিবরণ।।
শকুনির দুরবস্থা সভামধ্যে দেখি।
কেহ হাসে, কেহ কান্দে, কেহ ‍ঠারে আঁখি।।
সহসা সুশর্ম্মা রাজা আসি উপনীত।
আপনা হৈতে দেখে রাজাকে দুঃখিত।।
কহিতে লাগিল তবে করিয়া বিনয়।
চল শীঘ্র নরপতি, দেরী নাহি সয়।।
বিরাট রাজারে আমি আনিনু বান্ধিয়া।
অনেক করিল ‍যুদ্ধ গন্ধর্ব্ব আসিয়া।।
সর্ব্ব সৈন্য পলাইল গন্ধর্ব্বের ত্রাসে।
একাকী পাইয়া মোরে ধরিলেক কেশে।।
বড় ধর্ম্মশীল রাজ-সভাসদ্ কঙ্ক।
দয়া করি আমারে সে করিল নিঃশঙ্ক।।
সে গন্ধর্ব্ব যদি রাজা এখানে আসিবে।
মুহূর্ত্তেকে সর্ব্ব সৈন্য নিপাত করিবে।।
কোথা আছে দুর্য্যোধন কর্ণ দুঃশাসন।
এইমাত্র শুনি ‍রাজা তাহার বচন।।
গজ শুণ্ডে ধরি তুলি অন্য গজে মারে।
তুরঙ্গে তুরঙ্গ, রথ রথেতে প্রহারে।।
অতি বিপরীত কর্ম্ম দেখি লাগে ভয়।
আসিতে পারয়ে হেথা, হেন মনে লয়।।
কৃপাচার্য্য বলিল, এ কিছু অন্য নয়।
কীচকে মারিয়া কৈল গন্ধর্ব্ব-আলয়।।
ভীষ্ম বলে, সুশর্ম্মা যে কহে সত্য কথা।
তিল এক রহিতে না হয় যুক্তি হেথা।।
গন্ধর্ব্ব না হয় সেই বীর বৃকোদর।
আসিলে সে জন ভাল নহে নৃপবর।।
যে কর্ম্ম করিল আজি বীর ধনঞ্জয়।
দয়া করি না মারিল সদয় হৃদয়।।
ভীমসেন সঙ্গে যদি থাকিত ইহার।
আজিকার মধ্যে হৈত সবার সংহার।।
নির্দ্দয় নিষ্ঠুর বড় কঠিন হৃদয়।
পলাইয়া গেলে গোড়াইয়া প্রাণ লয়।।
শরণ লইলে সেইক্ষণে প্রাণ হরে।
চল চল শীঘ্র, সেই আসিবারে পারে।।
এত বলি যে যাহার চড়িয়া বাহনে।
হস্তিনা নগরে সবে গেল দুঃখমনে।।
আকাশে অমরবৃন্দ অদ্ভুত দেখিয়া।
নিজ নিজ স্থানে যান পার্থে বাখানিয়া।।