৪০. ভীষ্মের যুদ্ধ ও পরাজয়

উত্তরে চাহিয়ে বলিলেন ধনঞ্জয়।
হেথা হৈতে লহ রথ বিরাট-তনয়।।
ভয়েতে আবৃত হয়ে সকলে পলায়।
ভয়ার্ত্ত জনেরে মারিবারে না যুয়ায়।।
ক্ষুদ্রজীবী হীনবলে মারি কোন্ কর্ম্ম।
বিশেষে ভয়ার্ত্ত জনে মারিলে অধর্ম্ম।।
যথায় শান্তনু পুত্র ভীষ্ম পিতামহ।
শীঘ্র তাঁর সন্নিধানে মম রথ লহ।।
তাঁহার রক্ষিত সব কৌরবের সেনা।
তাঁহারে জিনিলে তবে জিনি সর্ব্বজনা।।
উত্তর বলিল, মোর শক্তি নাহি আর।
কিমতে রথের অশ্ব চালাব তোমার।।
এই দেখ অঙ্গ মোর হইল বিবর্ণ।
শব্দেতে বধির দেখ হৈল মম কর্ণ।।
কুম্ভকার চক্র প্রায় ভ্রমে মোর মনে।
দিবানিশি নাহি জ্ঞান, না দেখি নয়নে।।
তোমার গর্জ্জন আর মহা হুহুঙ্কার।
বিপরীত শব্দ তব ধনুক-টঙ্কার।।
শরীরের রক্ত মোর হৈল জলবৎ।
দিক্গণ ভ্রমে যেন নাহি দেখি পথ।।
বিশেষে তোমার কর্ম্ম অদ্ভুত কাহিনী।
দেখিবারে থাক কভু কর্ণে নাহি শুনি।।
কখন আদান কর কখন সন্ধান।
লক্ষিতে না পারি তুমি কারে ছাড় বাণ।।
অনুক্ষণ দেখি দনু মণ্ডল আকার।
শতহস্ত হও চিত্তে লাগয়ে আমার।।
পূর্ব্বের সে রূপ তব নাহিক এখন।
ভয়ঙ্কর মূর্ত্তি দেখি ভয় হয় মন।।
শীঘ্র কর মহাবীর ইহার উপায়।
কহিনু নিশ্চয় মোর প্রাণ বাহিরায়।।
পার্থ বলে, কি কহিছ বিরাট-কুমার।
ক্ষত্রিয় লক্ষণ কিছু না দেখি তোমার।।
সমূহ শত্রুর মাঝে কহিছ এমত।
কি উপায় আছে ইথে কে চালাবে রথ।।
স্থির হও, ভয় ত্যজ, ধর অশ্বদড়ি।
চাপিয়া বৈসহ, লহ প্রবোধের বাড়ি।।
এখনি কেমনে চাহ ত্যজিবারে রণ।
ক্ষণেক থাকিয়া দেখ বিরাট-নন্দন।।
আজি সব বিনাশিব কৌরবের সেনা।
দেখুক আমার তেজ আজি সর্ব্বজনা।।
ক্ষিতিমধ্যে দেখাইব রক্তের কর্দ্দম।
বহাইব রক্ত নদী, দেখাইব যম।।
রুধির করিব নীর, কুম্ভীর কুঞ্জর।
কচ্ছপ হইবে অশ্ব, মীন হবে নর।।
হস্ত পদ হবে সব তৃণ কাষ্ঠবৎ।
হংসবৎ ভাসি যাবে যত সব রথ।।
কি যুদ্ধ দেখিয়া তব শুষ্ক হৈল কায়।
রাজপুত্র তোর হেন কর্ম্ম কি যুয়ায়।।
কালানল প্রায় দেখ এই ভীষ্ম বীর।
কুরুসৈন্য মীন, যেন সাগর গভীর।।
শীঘ্র রথ লহ মম তাঁহার সম্মুখে।
আমার হস্তের বেগ দেখাব তাঁহাকে।।
পূর্ব্বে আমি সুরপুরে এই ধনু ধরি।
নিষ্কণ্টক স্বর্গ করিলাম দৈত্য মারি।।
নিবাতকবচ পুলোমাদি কালকেয়।
সিন্ধুপুর হেমপুরবাসী অপ্রমেয়।।
ইন্দ্রতুল্য পরাক্রম সবে মহাবলা।
বায়ে উড়াইনু যেন শিমূলের তূলা।।
সেইমত আজি আমি করিব সমর।
ক্ষত্র-পরাক্রমে বৈস রথের উপর।।
এত বলি অঙ্গে তার হাত বুলাইয়া।
উত্তরে করেন শান্ত আশ্বাস করিয়া।।
উত্তর বসিল পুনরপি সিংহবৎ।
ধরিয়া ঘোড়ার দড়ি চালাইল রথ।।
বায়ুবেগে নিল রথ ভীষ্মের গোচর।
পার্থে দেখি আগু হৈল ভীষ্ম বীরবর।।
পিতামহ পদ ধৌত বিচারিয়া মনে।
বরুণ যুগল অস্ত্র মারেন চরণে।।
দেখি ‍দুই অস্ত্র ভীষ্ম মারিল তখন।
অর্জ্জুনের শিরে গিয়া করিল চুম্বন।।
রক্ষক আছিল ভীষ্ম-রথে চারি জন।
দুঃসহ দুর্ম্মুখ বিবিংশতি দুঃশাসন।।
আগু হয়ে পথে আসি আগুলিল পথ।
জ্বলন্ত আগুনে যেন পতঙ্গের মত।।
আকর্ণ পূরিয়া বাণ মারে দুঃশাসন।
অর্জ্জুন উপরে করে বাণ বরিষণ।।
হাসিয়া মারেন পার্থ তারে পঞ্চ শর।
বাণাঘাতে দুঃশাসন হইল ফাঁফর।।
বেগে পলাইয়া যায়, নাহি চায় পাছে।
আর তিন বীর গিয়া বেড়িলেক কাছে।।
দুবানে দুর্ম্মুখে পার্থ করে অচেতন।
দেখি ভঙ্গ দিয়া যায় আর দুই জন।।
ভঙ্গ দিল চারি বীর দেখিয়া সংগ্রাম।
আগু হয়ে পার্থ ভীষ্মে করেন প্রণাম।।
পার্থ বলিলেন, দেব ভদ্র আপনার।
কি হেতু এ মৎস্যদেশে গমন তোমার।।
বিরাটের গবী নিতে আসিয়াছ প্রায়।
এমত কুকর্ম্ম নাহি তোমা শোভা পায়।।
গরগবী নিলে দেব যত হয় পাপ।
আপনি জানহ তুমি, অঙ্গে ভুঞ্জে তাপ।।
তথাপিহ লোভ নাহি পার সম্বরিতে।
সসৈন্যেতে আসিয়াছ গরগবী নিতে।।
ভীষ্ম বলে, নাহি আসি গবীর কারণ।
তুমি আছ এই স্থানে, শুনিনু বচন।।
বহুদি নাহি দেখি ব্যাকুলিত চিত্ত।
দুর্য্যোধন সহ আসিলাম এ নিমিত্ত।।
ক্ষত্রিয় নিয়ম আছে, বেদের বচন।
বাহুবলে শাসিবেক পররাজ্য জন।।
আমার এ ধন রাজ্যে কোন্ প্রয়োজন।
যতেক করি যে তোমা সবার কারণ।।
পার্থ বলে, পিতামহ তোমার প্রসাদে।
বঞ্চিলাম ত্রয়োদশ বর্ষ অপ্রমাদে।।
তোমার প্রসাদে মোরা ‍ভাই পঞ্চ জনে।
বহু বহু কষ্টে রক্ষা ‍পাইলাম বনে।।
তুমি যে গুরুর গুরু হও মহাগুরু।
কুরুবংশ কর্ত্তা তুমি যেন কল্পতরু।।
এমত সময়ে তুমি হইলে সদয়।
তোমার প্রসাদে করি কুরুসৈন্য জয়।।
পাশাকালে দুঃখ পাই, জানহ আপনে।
তাহার উচিত ফল দিব দুষ্টগণে।।
আজ্ঞা কর একভিতে নিতে নিজ রথ।
দুর্য্যোধনে ভেটি গিয়া, ছাড়ি দেহ পথ।।
ভীষ্ম বলে, আমি রক্ষা করি দুর্য্যোধন।
মোরে না জিনিলে কোথা পাবে দরশন।।
অর্জ্জুন বলেন, তবে বিলম্বে কি কাজ।
শীত্র কর উপায় রাখিতে কুরুরাজ।।
এত শুনি মহাক্রুদ্ধ হয়ে কুরুবর।
অষ্ট বাণ প্রহারিল অর্জ্জুন উপর।।
অষ্টগোটা সর্প সম সেই অষ্ট শর।
মহাশব্দে চলি যায় অর্জ্জুন উপর।।
দিব্য ভল্ল দিয়া কাটিলেন ধনঞ্জয়।
পুনঃ দিব্য অস্ত্র মারে গঙ্গার তনয়।।
মহাশব্দে আসে বাণ ভাস্কর সমান।
অর্দ্ধপথে ধনঞ্জয় করে খান খান।।
দুই জনে ‍যুদ্ধ হৈল অতি ভয়ঙ্কর।
নানাবর্ণে এড়িলেন চোক চোক শর।।
দোঁহে দোঁহাকার বাণ করেন বারণ।
অনিমিষ দোঁহাকার নয়নে নয়ন।।
অনলে বরুণ মারে, বায়ব্যে বারুণি।
আকাশে বায়ব্য মারে, শীতেতে আগুনি।।
পন্নগে পন্নাগাসন, বায়ুতে পর্ব্বত।
পুনঃ পুনঃ দোঁহে অস্ত্র ছাড়ে এইমত।।
দোঁহাকার শরজালে ত্রৈলোক্য কম্পিত।
চট্ চট্ শব্দ যেন হৈল অপ্রমিত।।
দোঁহাকার বাণে দোঁহে ব্যথিত হৃদয়।
দোঁহাকার অঙ্গে সদা শ্রমজল বয়।।
সাধু পার্থ, সাধু ভীষ্ম গঙ্গার নন্দন।
সাধু সাধু ধন্যবাদ দেয় দেবগণ।।
ইন্দ্র-অস্ত্র দিয়া তবে ইন্দ্রের নন্দন।
ভীষ্মের হাতের ধনু করেন ছেদন।।
আর ধনু ধরি ভীষ্ম বরিষয়ে বাণ।
সেই ধনু কাটিলেন করিয়া সন্ধান।।
দিব্য অস্ত্রে কাটে ‍পার্থ কবচ তাঁহার।
তীক্ষ্ণ দশ বাণ দিয়া করেন প্রহার।।
বাণাঘাতে অচেতন গঙ্গার তনয়।
দেখিয়া বিস্ময় মানি চাহে কুরুচয়।।
মহাভারতের কথা অমৃত-সমান।
কাশীরাম দাস কহে, শুন পুণ্যবাণ।।