১২৩. রাজা যুধিষ্ঠিরের বিলাপ

এইরূপে নরপতি কান্দে উচ্চৈঃস্বরে।
কোথা কৃষ্ণ রমানাথ রাখহ আমারে।।
এমন বিপদে কেন ফেলিলে আমায়।
কোন দোষে দোষী আমি নহি তব পায়।।
পিতৃগণ মোরে বুঝি দিল অভিশাপ।
এই জন্য জন্মাবধি পাই মনস্তাপ।।
অত্যন্ত বালককালে হৈল মহাশোক।
অজ্ঞানে পিতার হৈল গতি পরলোক।।
অনন্তর অস্ত্রশিক্ষা করি যেই কালে।
বিহার কারণে যাই ‍জাহ্নবীর জলে।।
তাহে দুঃখ দিল দুয্যোধন দুরাচার।
প্রকারে করিতেছিল ভীমের সংহার।।
উদ্ধার হইল ভীম পূর্ব্বকর্ম্মফলে।
নতুবা জীবন পায়, কে কোথা মরিলে।।
মাতার সহিত পরে ছিনু পঞ্চ জন।
বিনাশে মন্ত্রণা করে যত শত্রুগণ।।
নির্ম্মাণ করিয়া জতুগৃহে দুরাচার।
প্রকারে করিতেছিল সকলে সংহার।।
তাহে সুমন্ত্রণা দিল বিদুর সুমতি।
তাঁহার কৃপায় তথা পাই অব্যাহতি।।
ঘোর বনে প্রবেশিয়া ভ্রমি বহু দেশ।
পাইলাম যত দুঃখ নাহি তার শেষ।।
ভ্রমিতে ভ্রমিতে আসি পাঞ্চালনগরে।
স্বয়ম্বর বার্ত্তা শুনি যাই সভাগৃহে।।
লক্ষ্য বিন্ধি ধনঞ্জয় জিনে রাজগণে।
দ্রৌপদী বরণ কৈল আমা পঞ্জ জনে।।
বিবাহ করিয়া পুনঃ আসিলাম দেশে।
করেছি যতেক কর্ম্ম কৃষ্ণের আদেশে।।
বিদায় হইয়া কৃষ্ণ গেল দ্বারকায়।
বিধির নিযুক্ত কর্ম্ম লঙ্ঘন না যায়।।
কপট পাশায় দুষ্ট নিল রাজ্য ধন।
তোমা সবে সঙ্গে নিয়া আসি ঘোর বন।।
কাননে অনেক দুঃখ পেলে ভ্রাতৃগণ।
অনেক প্রমাদ হৈতে হইল মোচন।।
কাননে আসিবামাত্র রাক্ষস কির্ম্মীর।
তোমা সবা বিনাশিতে করিলেক স্থির।।
রাক্ষসী মায়াতে কৈল ঘোর অন্ধকার।
মারিয়া রাক্ষসে ভীম করিল উদ্ধার।।
অনন্তর জটাসুর এল কাম্যবনে।
তারে মারি পরিত্রাণ কৈলে চারি জনে।।
খেদ করি সরোবরে চাহে নৃপমণি।
দেখিয়া সবার মুখ পড়েন ধরণী।।
কতক্ষণে মূর্চ্ছা ত্যজি উঠেন নৃপতি।
ধনঞ্জয় ভাই বলি কান্দেন সুমতি।।
কেবা আর কুরুযুদ্ধে করিবে উদ্ধার।
যুদ্ধ হেতু স্বর্গে অস্ত্র শিখিলে অপার।।
যুদ্ধেতে হইয়া তুষ্ট দেব ত্রিলোচন।
পাশুপাত অস্ত্র তোমা করেন অর্পণ।।
মাতলিরে পাঠালেন দেব পুরন্দর।
আদর করিয়া নিল স্বর্গের উপর।।
শিখিরে যতেক বিদ্যা নাহিক অবধি।
স্বর্গেতে আছিল বহু অমর বিবাদী।।
ছলে পাঠাইলা ইন্দ্র নগর ভ্রমণে।
করিলে দেবের কার্য্য মারি দৈত্যগণে।।
দৈত্যবধে হৃষ্ট হয়ে যত দেবগণ।
নিজ নিজ মায়া সবে করিল অর্পণ।।
দেবের অসাধ্য কার্য্য করিলে সাধন।
তুষ্ট হয়ে অস্ত্র দিল সহস্রলোচন।।
কিরীট শোভন শিরে হাতে ধনুঃশর।
এ সব স্মরিয়া ভাই দহে কলেবর।।
রহিল প্রচণ্ড শত্রু রাজা দুর্য্যোধন।
সহায় যাহার আছে সূতের নন্দন।।
শেষ দুঃখ আছে মাত্র অজ্ঞাত বৎসর।
চল ভাই বঞ্চি গিয়া পঞ্চ সহোদর।।
এত বলি নরপতি চাহি মায়াজলে।
মূর্চ্ছাগত হয়ে পুনঃ পড়ে ধরাতলে।।
মূর্চ্ছা ত্যজি পুনর্ব্বার উঠেন সত্বর।
চাহিয়া সবার মুখ রোদন তৎপর।।
ধিক্ ধিক্ দুর্য্যোধন অতি কুলাঙ্গার।
কপটেতে অতি দুঃখ দিল দুরাচার।।
কাননে করিনু বাস ভাই পঞ্চ জন।
অবশেষে সকলেতে হলেম নিধন।।
দুর্য্যোধনে কি দূষিব, মম কর্ম্মফলে।
জন্মাবধি বিধি লিখিল কপালে।।
ভাবিয়া ভবিষ্য তত্ত্ব বুঝিয়া অসার।
নিতান্ত দেখেন রাজা, নাহি প্রতিকার।।
মনোদুঃখে নরপতি মরিবার যান।
পাছে থাকি বকরূপী ধর্ম্মরাজ কন।।
মৃত্যুপতি বলে, রাজা তুমি জ্ঞানবান।
পৃথিবীতে নাহি দেখি তোমার সমান।।
বুদ্ধিহ্রাস হৈল দেখি, তোমা হেন জনে।
অগতি মরণ ইচ্ছা কর কি কারণে।।
অপঘাতে প্রাণ নষ্ট করে যেই জন।
অধোগতি হয় তার, বেদের বচন।।
তোমার মহিমা শুনি দেব ঋষিমুখে।
উপমার যোগ্য তব নাহি তিন লোকে।।
আত্মঘাতী জনে ত্রাণ নাহি কদাচন।
স্বর্গেতে তাহার স্থান নাহিক রাজন।।
ধর্ম্মবাক্যে যুধিষ্ঠির কহে সবিনয়।
আমার দুঃখের কথা শুন মহাশয়।।
অল্পকালে পিতৃহীন, হৈল বড় শোক।
মন্ত্রণা করিয়া ‍দুঃখ দিল দুষ্ট লোক।।
কপট পাশায় শেষে লৈয়া রাজ্যধন।
বাকল পরায়ে সবে পাঠাইল বন।।
বহু দুঃখে বঞ্চিলাম কানন ভিতর।
এক আত্মা এই মোরা পঞ্চ সহোদর।।
দুঃখের উপয়ে বিধি এত দুঃখ দিল।
এবে সে জানিনু, কৃষ্ণ মো সবে ত্যজিল।।
আমি ত শরীর ধরি, পঞ্চজন প্রাণ।
সে প্রাণ হরিয়া যদি নিল ভগবান।।
নিতান্ত যদ্যপি কৃষ্ণ ছাড়েন আমারে।
আমিও ত্যজিব প্রাণ মৃত্যু সরোবরে।।
আমার যতেক দুঃখ শুনিলে নিশ্চয়।
তুমি কেন নিবারণ কর মহাশয়।।
নিষেধ না কর মোরে, করহ প্রয়াণ।
ভ্রাতৃগণ শোকে আমি ত্যজিব পরাণ।।
এত বলি নরপতি অধৈর্য্য হইয়া।
মরিবারে যান দ্রুত শ্রীকৃষ্ণ স্মরিয়া।।
ধর্ম্মরাজ বলিলেন, কর অবধান।
ধৈর্য্য ধর নরপতি, ত্যজ দুঃখজ্ঞান।।
অসার সংসার মধ্যে সারমাত্র ধর্ম্ম।
তাহা ছাড়ি কেন তুমি করহ অধর্ম্ম।।
পিতা মাতা ভাই বন্ধু কেহ কার নয়।
ভবিষ্য বৃত্তান্ত এই, শুন মহাশয়।।
কালপ্রাপ্ত হয়ে তব ভাই চরি জন।
আসিয়া এ সরোবরে ত্যজিল জীবন।।
যুধিষ্ঠির বলিলেন, জানিনু কারণ।
এত দিনে বিধি মোরে করিল বঞ্চন।।
জীবন রাখিতে আর নাহি লয় মতি।
এত বলি মরিবারে যান নরপতি।।
বকরূপী ধর্ম্মরাজ ডাকে পুনরায়।
না শুনিয়া যান রাজা মরণ আশায়।।
অত্যন্ত কাতর দেখি কহে মৃত্যুপতি।
শুন শুন যুধিষ্ঠির আমার ভারতী।।
অতিশয় তৃষ্ণা যদি থাকয়ে তোমার।
চারিটী প্রশ্নের দেহ উত্তর আমার।।
না শুনিয়া অহঙ্কারে এই চারি জন।
পানমাত্র এই জলে হইল মরণ।।
রাজা কহে, মৃত্যুভয় নাহিক আমার।
মৃত্যুই একমাত্র নাহিক আমার।।
শমনের ভয় না দেখাও পক্ষীবর।
বিজ্ঞপ্রাজ্ঞ যে জন সে দিবে প্রশ্নোত্তর।।
এই নীতি বিধি হেতু দিব যে উত্তর।
কিবা প্রশ্ন তব হয় প্রকাশ সত্বর।।
পুত্রবাক্যে প্রীত হৈয়া ধর্ম্ম মহাশয়।
প্রশ্ন তবে করিতে লাগিলেন রাজায়।।

যুধিষ্ঠিরের প্রতি ধর্ম্মের চারি প্রশ্ন জিজ্ঞাসা।

‘‘কা চ বার্ত্তা কিমাশ্চর্য্যং কঃ পন্থাঃ কশ্চ মোদতে।
মমৈতাংশ্চতুরঃ প্রশ্নান কথরিত্বা জলং পিব।’’
কিবা বার্ত্তা, কি আশ্চর্য্য, পথ বলি কারে।
কোন্ জন সুখী হয় এই চরাচরে।।
পাণ্ডুপুত্র আমার যে এই প্রশ্ন চারি।
উত্তর করিয়া তুমি পান কর বারি।।

যুধিষ্ঠিরের প্রথম প্রশ্নের উত্তর।

মাসত্তুদব্বীপরিঘট্টনেন
সূর্য্যগ্নিনা রাত্রিদিনেন্ধনেন।
অস্মিন্ মহামোহময়ে কটাহে
ভূতানি কালঃ পচতীতি বার্ত্তা।।
অস্যার্থঃ

ঘটন কারণ হৈল মাস ঋতু হাতা।
রাত্রি দিবা কাষ্ঠ তাহে পাবক সবিতা।।
মোহময় সংসার কটাহে কাল কর্ত্তা।
ভূতগণে করে পাক, এই শুন বার্ত্তা।।

দ্বিতীয় প্রশ্নের উত্তর।

অহন্যহনি ভূতানি গচ্ছন্তি যমমন্দিরম্
শেষাঃ স্থিরত্বমিচ্ছন্তি কিমাশ্চর্য্যমতঃপরম।।
অস্যার্থঃ।

প্রতিদিন জীব জন্তু যায় যমঘরে।
শেষে থাকে যারা, তারা ইহা মনে করে।।
আপনারা চিরজীবী নাহি হৈব ক্ষয়।
ইহা হৈতে কি আশ্চর্য্য আছে মহাশয়।।

তৃতীয় প্রশ্নের উত্তর।

বেদা বিভিন্নাঃ স্মৃতয়ো বিভিন্না
নাসৌ মুনিযর্স্যমতং না ভিন্নম।
ধর্ম্মস্য তত্ত্বং নিহিতং গুহায়াং
মহাজনো যেন গতঃ স পন্থাঃ।।
অস্যার্থঃ।

বেদ আর স্মৃতিশাস্ত্র একমত নয়।
স্বেচ্ছামত নানা মুনি নানা মত কয়।।
কে জানে নিগূঢ় ধর্ম্মতত্ত্ব নিরূপণ।
সেই পথ গ্রাহ্য, যাহে যায় মহাজন।।

চতুর্থ প্রশ্নের উত্তর।

দিবসস্যাষ্টমে ভাগে শাকং পচতি যো নরঃ।
অঋণী চাপ্রবাসী চ স বারিচর মোদতে।।
অস্যার্থঃ।

অপ্রবাসে ঋণ বিনা যার কাল যায়।
যদ্যপি মধ্যাহ্নকালে শাক অন্ন খায়।।
তথাপি সে জন সুখী সংসার ভিতর।
বারিচর শুন চারি প্রশ্নের উত্তর।।