০৪০. নল রাজার উপাখ্যান

যুধিষ্ঠির বলে মুনি কর অবধান।
আমারে দুঃখের কথা নাহি পরিমাণ।।
কপটে সকল মম নিল রাজ্য ধন।
জটাচীর পরাইয়া পাঠাইল বন।।
যত ক্লেশ দুঃখে আমি বঞ্চি যে হেথায়।
রাজপুত্র হয়ে এত দুঃখ নাহি পায়।।
রাজার বচন শুনি হাসে মুনিবর।
কতক্ষণে বৃহদশ্ব করিল উত্তর।।
কি দুঃখ তোমার রাজা অরণ্য ভিতর।
ইন্দ্র চন্দ্র সম তব সঙ্গে সহোদর।।
ব্রহ্মার সদৃশ দ্বিজ সঙ্গে শত শত।
দাস দাসী আর যত তব অনুগত।।
এই হেতু দুঃখ নাহি দেখি যে তোমার।
তোমা হৈতে নল দুঃখ পাইল অপার।।
এত শুনি জিজ্ঞাসেন ধর্ম্মের নন্দন।
কহ শুনি মুনি সেই নল বিবরণ।।
রাজপুত্র হয়ে আমা সমান দুঃখিত।
অবশ্য শুনিতে হয় তাঁহার চরিত।।
কহ ‍শুনি মুনিরাজ তাঁহার কথন।
কোন দেশে ঘর তাঁর, কাহার নন্দন।।
বৃহদশ্ব বলে, শুন ধর্ম্মের নন্দন।
তোমা হতে বড় দুঃখী নিষধ রাজন।।
নল নামে নরপতি বীরসেন সুত।
ইন্দ্রের সদৃশ রাজা মহাগুণযুত।।
রূপেতে কন্দর্প তুল্য অতি জিতেন্দ্রিয়।
যশস্বী তেজস্বী ধীর, অক্ষে বড় প্রিয়।।
নিষধ রাজ্যেতে নল মহাগুণবান।
বিদর্ভেতে ভীম রাজা তাঁহার সমান।।
বংশের কারণ রাজা বড় চিন্তা মন।
কত দিনে আসে তথা মহর্ষি দমন।।
পুত্র হেতু ভার্য্যা সহ তাঁহারে পূজিল।
হৃষ্ট হয়ে মুনি তাঁরে এই বর দিল।।
রূপেতে সংসারে নারী করিবে দমন।
দময়ন্তী কন্যা পাবে বড় সুলক্ষণ।।
দমনের বরে কন্যা হল দময়ন্তী।
যক্ষ রক্ষ দেব নর না দেখে সে কান্তি।।
নাহিক সমান রূপে, গুণে লক্ষ্মী সমা।
নলের কারণে হৈল অতি নিরুপমা।।
সমান বয়স্কা যত আছে সখীগণ।
দময়ন্তী পাশে তারা থাকে অনুক্ষণ।।
দময়ন্তী সাক্ষাতে সখীরা পুনঃপুনঃ।
নিরবধি বাখানে নলের রূপ গুণ।।
নলের চরিত্র শুনি ভীমের নন্দিনী।
বংশীরব শুনি মুগ্ধা যেমন হরিণী।।
দময়ন্তী রূপ গুণ লোকমুখে শুনি।
হেরিতে ব্যাকুল হন নল নৃপমণি।।
দময়ন্তী চিন্তাতে নলের মগ্ন মন।
কত দিনে দেখ তার দৈবের ঘটন।।
অন্তঃপুর উদ্যানে বিহরে দুঃখমতি।
জলতটে হংস এক দেখে নরপতি।।
নিকটে পাইয়া হংস ধরিল তখন।
রাজা প্রতি বলে হংস বিনয় বচন।।
ছাড়হ আমারে রাজা, না কর নিধন।
করিব তোমার প্রীতি চিন্ত যে কারণ।।
তব অনুরূপ রূপা ভীমের নন্দিনী।
তার সহ মিলন করাব নৃপমণি।।
এতেক শুনিয়া রাজা হংসেরে ছাড়িল।
অন্তরীক্ষ গতি পক্ষী বিদর্ভেতে গেল।।
অন্তঃপুর মধ্যে যথা সরোবর ছিল।
সেইখানে গিয়া হংস খেলিতে লাগিল।।
এইকালে দময়ন্তী সহচরী সনে।
পুষ্প তুলিবার তরে আইল সেখানে।।
সরোবর মধ্যে হংস দেখি রূপবতী।
ধরিবার আশে যান মন্দ মন্দ গতি।।
চতুর্দ্দিকে বেড়ি হংসে ধরিল স্ত্রীগণে।
বৈদর্ভীরে হংস কহে মনুষ্য বচনে।।
নিষধ রাজ্যেতে রাজা নল মহামতি।
অশ্বিনীকুমার রূপে নিন্দে রতিপতি।।
নরলোকে তার সম নাহি রূপে গুণে।
করাইব মিলন তোমার তাঁর সনে।।
যদি ভাগ্যে থাকে, তব ভর্ত্তা হবে নল।
তোমার যৌবন রূপ হইবে সফল।।
সার্থক হইবে রূপ শুনহ বচন।
নল নৃপতিরে যদি করহ বরণ।।
এতেক শুনিয়া ভৈমীর মন মোহিল।
বিধাতা আমার হেতু নলেরে সৃজিল।।
নল নৃপতিরে আমি করিব বরণ।
এত বলি হংসে পাঠাইল সেইক্ষণ।।
কহে হংস সব কথা নলের গোচর।
ভৈমী কথা শুনি আকুল হৈল নৃপবর।।
হেথা হংস কথা ভৈমী যে হৈতে শুনিল।
সেই হইতে বৈদর্ভী সকলি ত্যজিল।।
ত্যজিল আহার নিদ্রা, সদাই হুতাশ।
সদা চিন্তাযুতা, বহে সঘনে নিশ্বাস।।
দময়ন্তী দুঃখ দেখি সব সখীগণ।
ভীম নরপতি পাশে করে নিবেদন।।
শুনিয়া নৃপতি বড় হৈল চিন্তিত।
কোন হেতু দময়ন্তী হইল দুঃখিত।।
মহাদেবী কন, কিবা চিন্ত নৃপবর।
যুবতী হইল কন্যা কর স্বয়ন্বর।।
শুনিয়া বিদর্ভপতি উদযোগী হইল।
রাজ্যে রাজ্যে দূত গিয়া নিমন্ত্রণ দিল।।
দেশে দেশে বার্ত্তা পেয়ে যত রাজগণ।
বিদর্ভ নগরে সবে করিল গমন।।
হয় হস্তী পদাতিকে পূরিল মেদিনী।
বার্ত্তা পেয়ে আসিলেন যত নৃপমণি।।
বিদর্ভে আইল যত ‍রাজ্যের ঈশ্বর।
যথাযোগ্য স্থানে সব বসে নৃপবর।।
মহাভারতের কথা অমৃত সমান।
কাশীরাম দাস কহে, শুনে পুণ্যবান।।