০২২. শ্রীবৎস রাজার সহিত চিন্তাদেবীর মিলন

শ্রীবৎসের দুঃখ কথা কহে যদুরায়।
পঞ্চ ভাই জিজ্ঞাসেন কাতর হিয়ায়।।
দ্রৌপদী কহেন, দেব কহ পুনর্ব্বার।
চিন্তার কি হৈল গতি কেমন প্রকার।।
কিরূপে ভদ্রারে লয়ে বঞ্চিল রাজন।
কহ দেব, শুনিতে ব্যাকুল বড় মন।।
শ্রীকৃষ্ণ বলেন, সবে শুন সেই কথা।
রাজগৃহে মানহীন বঞ্চে রাজা তথা।।
পরগৃহে বঞ্চে, পর অন্নেতে পালিত।
তাঁহার জীবনে ধিক্ মরণ উচিত।।
কষ্টেতে বঞ্চেন রাজা দিবস রজনী।
সান্ত্বনা করেন ভদ্রা কহি প্রিয়বাণী।।
বহুকাল গেল দুঃখে, আছে অল্পকাল।
অচিরে পাইবে রাজ্য শুন মহীপাল।।
জ্ঞানবান্ লোক কভু কাতর না হয়।
স্থির হয়ে ধর্ম্ম করে, ঈশ্বরে ধেয়ায়।।
সুখ ‍দুঃখ দেখ রায় সহযোগে কর্ম্ম।
সুখে উপার্জ্জয়ে ধর্ম্ম, দুঃখেতে অধর্ম্ম।।
ইহা বুঝি মহারাজ শান্তচিত্ত হও।
নিরবধি রামনাম বদনেতে লও।।
না জানহ মহাশয় আছয়ে শমন।
ইহা জানি নরপতি তত্ত্বে দেহ মন।।
ভদ্রার বিনয় বাক্য শুনিয়া রাজন।
অহর্নিশ করে রাজা ঈশ্বরে স্মরণ।।
এরূপে দ্বাদশ বর্ষ হৈল অবশেষ।
শনির ভোগান্ত গত, শুভেতে প্রবেশ।।
হেনকালে একদিন শ্রীবৎস রাজন।
ভদ্রা পতি কহে রায় মধুর বচন।।
তব বাপে কহি কিছু কর্ম্ম দেহ মোরে।
ক্ষীরোদ নদীর তটে দান সাধিবারে।।
শুনিয়া ইঙ্গিতে ভদ্রা মায়েরে কহিল।
রাণীর ইঙ্গিতে রাজা সেইক্ষণে দিল।।
পাইয়া নৃপের আজ্ঞা শ্রীবৎস নৃপতি।
নদীকূলে বসে রাজা হইয়া জগাতি।।
শত শত মহাজন নৌকা বাহি যায়।
তল্লাসী লইয়া তারে পুনঃ ছাড়ি দেয়।।
দেখ যুধিষ্ঠির রাজা দৈবের ঘটনে।
কত দিনে সেই সাধু আইসে ঐ স্থানে।।
দেখিয়া তরণী তার শ্রীবৎস চিনিল।
আটক করিয়া তরী ঘাটেতে রাখিল।।
নিজ জনে আজ্ঞা দিল শ্রীবৎস রাজন।
নৌকা হতে কূলে তোল আছে যত ধন।।
আজ্ঞামাত্র স্বর্ণপাট যতেক আছিল।
তরী হৈতে নামাইয়া কূলে উঠাইল।।
দেখি সদাগর গিয়া নৃপে জানাইল।
তোমার জামাতা মোর সর্ব্বস্ব লুটিল।।
শুনি রাজা ক্রোধচিত্তে জামাতারে বলে।
কে হেতু সাধুর সব স্বর্ণপাট নিলে।।
শ্রীবৎস বলেন, রাজা করহ শ্রবণ।
সাধু নহে, এই বেটা দুষ্ট মহাজন।।
এই স্বর্ণপাট যদি করে দুইখান।
তবেত উহার স্বর্ণ সকলি প্রমাণ।।
শুনি সদাগরে ডাকি কহেন নৃপতি।
স্বর্ণপাট দুইখণ্ড কর শীঘ্রগতি।।
একখানি পাট যদি দুইখানি হয়।
তবেত তোমার স্বর্ণ হইবে নিশ্চয়।।
এ কথা শুনিয়া সাধু কুঠার আনিয়া।
খুলিতে করিল যত্ন স্বর্ণপাট নিয়া।।
খুলিতে নারিল সাধু, মহালজ্জা পায়।
তবেত শ্রীবৎস রাজা কহিছে সভায়।।
খুলিতে নারিল সাধু, পাইলে প্রমাণ।
আমি খুলি স্বর্ণপাট করি দুইখান।।
স্বর্ণপাট হাতে করি শ্রীবৎস রাজন।
তাল বেতালেরে তবে করেন স্মরণ।।
স্মরণ করিবামাত্র দুইখান হয়।
দেখিয়া সভার লোক মানিল বিস্ময়।।
সম্ভ্রমে উঠিয়া রাজা যোড়করে কয়।
কহ বাপু কেবা তুমি হও মায়াময়।।
দেবতা গন্ধর্ব্ব যক্ষ কিবা নাগ নর।
মায়া করি ভদ্রা নিতে এলে গুণাকর।।
বুঝি মোর ভদ্রার ভাগ্যের নাহি সীমা।
সত্য করি কহ বাপু, না ভাণ্ডিহ আমা।।
শ্বশুরের বাক্য শুনি শ্রীবৎস নৃপতি।
কহিতে লাগিল তবে মধুর ভারতী।।
শুন শুন মহারাজ মম নিবেদন।
নীচে কি উত্তম বিধি করান মিলন।।
সমানে সমানে ধাতা করান সংযোগ।
সুখ দুঃখ হয় রাজা শরীরের ভোগ।।
মৃত্যু সম বনে দুঃখ দ্বাদশ বৎসর।
শনির পীড়নে আইনু তোমার নগর।।
ধাতার নির্ব্বন্ধে করি ভদ্রারে গ্রহণ।
ভয় নাহি মহারাজ, নহি নীচ জন।।
শুন নরপতি তুমি মোর বিবরণ।
প্রাগদেশ পতি আমি শ্রীবৎস রাজন।।
চিরদিন ধর্ম্ম ন্যায়ে রাজ্য পালি আমি।
দৈব্যের বিপাক রাজা, জ্ঞাত হও তুমি।।
একদিন শনি সহ জলধি কুমারী।
দোঁহে দ্বন্দ্ব করি আসে মম বরাবরি।।
লক্ষ্মী কহে, আমি পূজ্যা সকল সংসারে।
শনি বলে, আমি শ্রেষ্ঠ যত চরাচরে।।
এইমত দ্বন্দ্ব করি আসিদুই জন।
আমারে কহিল, কহ শ্রেষ্ঠ কোন্ জন।।
শুনিয়া হৃদয়ে মোর হৈল বড় ভয়।
কাহারে কহিব শ্রেষ্ঠ, কি হবে উপায়।।
উভয়ে বলিনু, কল্য আসিহ প্রভাতে।
ইহার প্রমাণ কালি বুঝিব মনেতে।।
বিদায় হইয়া দোঁহা করিল গমন।
আমার ভাবনা হৈল, কি করি এখন।।
কেবা ছোট, কেবা বড় কহিতে না পারি।
অনেক ভাবিয়া চিত্তে অনুমান করি।।
স্বর্ণ রৌপ্য সিংহাসন করি দুইখানি।
দুইভিতে সিংহাসন, মধ্যে থাকি আমি।।
সভা করি উপবিষ্ট রহিনু তথায়।
দুই জন আইলেন প্রভাত সময়।।
দোঁহে দে সম্ভ্রমেতে বসাই ঝটিতি।
কাতর অন্তরে আমি করি বহু স্তুতি।।
তুষ্ট হয়ে দুই জন বসে সিংহাসনে।
শনি বসে বামে আর কমলা দক্ষিণে।।
আমারে জিজ্ঞাসে দোঁহে সহাস্য বদন।
শুনিয়া উত্তর আমি করিনু তখন।।
আপনা আপনি দোঁহে ভাবি দেখ মনে।
দক্ষিণেতে শ্রেষ্ঠ বলি, বামে সাধারণে।।
এত শুনি ক্রোধী হয়ে শনি মহাশয়।
অল্পদোষে গুরুদণ্ড করিল আমায়।।
রাজ্যনাশ বনবাস স্ত্রী বিচ্ছেদ হৈল।
মরণ অধিক দুঃখ মোরে ডুবাইল।।
শ্রীবৎস মুখেতে শুনি এ সব ভারতী।
এস্ত হয়ে বাহুরাজ উঠে শীঘ্রগতি।।
যোড়হাত করি রাজা করেন স্তবন।
ক্ষমহ আমার দোষ, অজ্ঞাত কারণ।।
শুভক্ষণে ভদ্রাকন্যা কুলে উপজিল।
তাহার কারণে তোমা দরশন হৈল।।
সার্থক সেবিল গৌরী আমার নন্দিনী।
এতদিনে আপনাকে ধন্য বলে মানি।।
ধন্য মোর কুলে ভদ্রা তনয়া হইল।
ঘরে বসি তোমা হেন রত্ন মিলাইল।।
এত দিন আছিলাম হইয়া অস্থির।
অমৃতাভিষিক্ত আজি হইল শরীর।।
পূর্ব্বজন্মার্জ্জিত পুণ্য কতেক আছিল।
সেই ফলে ভদ্রা কন্যা তোমারে পাইল।।
কাতর হইয়া রাজা পড়িল ধরণী।
শ্রীবৎস কহিছে, তব শুন মম বাণী।।
লঘুজনে এতাদৃশ নহে ত উচিত।
শীঘ্র করি মহারাজ চিন্ত মম হিত।।
নৌকাপরে চিন্তা মম আছেন বন্ধন।
শীঘ্র করি তারে রাজা করহ মোচন।।
শুনি বাহু নরপতি উঠে শীঘ্রগতি।
পাত্র মিত্রগণ সবে চলিল সংহতি।।
নদীতীরে গিয়া দেখে নৌকার উপরে।
চিন্তাদেবী আছে তথা কাতর অন্তরে।।
কহিতে লাগিল রাজা চিন্তাদেবী প্রতি।
দুঃখকাল গেল মাতা, উঠ শীঘ্রগতি।।
তোমার বিচ্ছেদ দুঃখী শ্রীবৎস রাজন।
উঠ মাতা, দোঁহে গিয়া কর গো মিলন।।
জরাযুত চিন্তা অঙ্গ দেখিয়া রাজন।
জিজ্ঞাসিল চিন্তা প্রতি তার বিবরণ।।
পলিত গলিত কেন পতিব্রতা দেহ।
জয়াযুত অঙ্গ কেন বিস্তারিয়া কহ।।
শুনি চিন্তা ধীরে ধীরে কহে মৃদুভাষে।
জরাযুত অঙ্গ কথা শুন ইতিহাসে।।
এই সদাগর যায় বাণিজ্য করিতে।
আটক হইল তরী দৈবের দোষেতে।।
হেনকালে দৈবজ্ঞ এক আসিল তথা।
সদাগর পুছে দৈবজ্ঞ তরীর কথা।।
দৈবজ্ঞ কহে, সতী হইবে যে রমণী।
সে স্পর্শিলে তরী তবে উঠিবে এখনি।।
কাঠুরে রমণীগণ যতেক আছিল।
ক্রমে ক্রমে সদাগর সবে আনাইল।।
সকলে ছুঁইল তরী, না হৈল উদ্ধার।
পশ্চাতে আমারে গিয়া ডাকে বারবার।।
বিস্তর বিনয় করি আমারে কহিল।
কাতর দেখিয়া মোর দয়া উপজিল।।
দয়া করি উদ্ধারিয়া দিনু যদি তরী।
দুষ্ট দুরাচার চিত্তে দুষ্টবুদ্ধি করি।।
আমাকে তুলিয়া নিল নৌকার উপর।
ভয় পেয়ে মম অঙ্গ কাঁপে থর থর।।
অতি ভয়ে সূর্য্যদেবে করিলাম স্তুতি।
স্তবে তুষ্ট হইলেন সূর্য্য মম প্রতি।।
আমি কহিলাম, দেব মোর রূপ লহ।
জরাযুত অঙ্গে এবে মোরে দান দেহ।।
স্তবে তুষ্ট হয়েবর দিল সেইক্ষণ।
মায়া অঙ্গ দিয়া মোরে কহিল তখন।।
স্মরণ করিবামাত্র নিজরূপ পাবে।
চিন্তা না করিহ চিন্তা মাহরাণী হবে।।
দৈবগ্রহ ঘুচিলে পাইবে নৃপবর।
কিছুদিন শুদ্ধচিত্তে ভাবহ ঈশ্বর।।
শুন মহারাজ মম জরার ভারতী।
দুঃখ শুনি কান্দে তবে বাহু নরপতি।।
তুমি সতী পতিব্রতা, পতি অনুরতা।
ত্রিভুবন তব গুণ স্মরিবেক মাতা।।
সূর্য্যের চিন্তায় চিন্তা নিজরূপ পাইল।
যেমন পূর্ব্বের রূপ তেমতি হইল।।
রাজা কহে, চতুর্দ্দোল আন শীঘ্রগতি।
চিন্তা কহে, চল যাই প্রভুর বসতি।।
এত বলি পদব্রজে চলিলেন সতী।
যথায় উদ্বেগ চিত্ত শ্রীবৎস নৃপতি।।
নিকটেতে গিয়া চিন্তা প্রদক্ষিণ করে।
প্রণিপাত করি কহে স্বামী বরাবরে।।
দেখি তবে আস্তে ব্যাস্তে উঠিয়া রাজনে।
বামপার্শ্বে বসাইল নিজ সিংহাসনে।।
চিরদিন বিচ্ছেদেতে ছিল দুই জন।
দোঁহার মিলনে দোঁহে আনন্দিত মন।।
প্রেমাবেশে অবসন্ন হৈল দুই জন।
পুনঃ পুনঃ আলিঙ্গন বদন চুম্বন।।
বিনোদ শয্যায় রাজা করিল শয়ন।
চিন্তা ভদ্রা পদ সেবা করে দুই জন।।
নানা হাস্যে নানা রসে শ্রীবৎস রাজন।
অতি আনন্দেতে করে নিশা সমাপন।।
প্রভাত সময়ে বার দিয়া বাহু রাজা।
শ্রীবৎস চিন্তারে তবে করে বহু পূজা।।
আনন্দেতে সভাতলে বসে সর্ব্বজন।
নানা শাস্ত্র আলাপন করে জনে জন।।
পুণ্যশ্লোক শ্রীবৎস চিন্তা মিলন-কথা।
শ্রীব্যাসদেব বিরচিত অপূর্ব্ব গাথা।।
কাশীরাম দাস রচে পয়ার প্রবন্ধে।
ভক্তিতে শুনিলে দিব্যচক্ষু লভে অন্ধে।।