০০৯. শ্রীকৃষ্ণ কর্ত্তৃক শাল্ব বধ

তব যজ্ঞ সাঙ্গ যবে হল নরপতি।
হেথা হতে আমি ত গেলাম দ্বারাবতী।।
দেখিলাম দ্বারকা যে লণ্ডভণ্ড প্রায়।
বেদধ্বনি উচ্চারে অতি করুণাতায়।।
পুষ্পোদ্যানে তরুগণ লণ্ডভণ্ড দেখি।
জিজ্ঞাসা করিলাম যে সাত্যকিরে ডাকি।।
সকল কহিল তবে হৃদিকা নন্দন।
আদ্যোপান্ত যতেক শাল্বে বিবরণ।।
শুনিয়া হৃদয়ে তাপ হইল অপার।
ঘরে প্রবেশিতে চিত্ত নহিল আমার।।
কামপাল কামদেব বাহুক প্রভৃতি।
সবারে কহিনু যেন রাখে দ্বারাবতী।।
হইলাম কিছু সৈন্য লইয়া বাহির।
শাল্ব সহ যুদ্ধে যাই সিন্ধুনদ-তীর।।
তথা শুনিলাম, শাল্ব আছে সিন্ধুমাঝে।
সিন্ধুমাঝে প্রবিষ্ট হইলাম সেই সাজে।।
পাঞ্চজন্য শঙ্খনাদ শুনিয়া আমার।
হাসিয়া ডাকিয়া বলে শাল্ব দুরাচার।।
তোমারে চাহিয়া গেনু দ্বারকা নগরে।
না দেখি তোমারে ফিরি আসিলাম ঘরে।।
ভাগ্য মোর, তুমিত আসিলে হেথাকারে।
এখনি তোমারে পাঠাইব যমদ্বারে।।
এতবলি এড়িলেক লক্ষ লক্ষ বাণ।
গদা চক্র শেল শূল অস্ত্র খরশান।।
সব কাটিলাম আমি চেক-চোক শরে।
মায়ায় উঠিল শাল্ব আকাশ উপরে।।
আকাশে উঠিয়া শাল্ব বহু মায়া কৈল।
দিবারাত্রি নাহি জানি, অন্ধকার হৈল।।
কোটি কোটি বাণ যে এড়িল দুষ্টমতি।
না দেখি রথের ঘোড়া, রথের সারথি।।
শৈব সুগ্রীবাদি অশ্ব হইল অচল।
ডাকিল দারুক মোরে হইল বিহ্বল।।
দারুকের অঙ্গ দেখি শরেতে জর্জ্জর।
তিলমাত্র অক্ষত নাহিক কলেবর।।
শক্তিহীন সর্ব্বাঙ্গে বহিছে রক্তধার।
চিন্তিত হইনু দুঃখ দেখিয়া তাহার।।
হেনকালে দ্বারকানিবাসী একজন।
সম্মূখে আসিয়া কহে করিয়া ক্রন্দন।।
কি করহ বাসুদেব, চল শীঘ্রগতি।
ক্ষণমাত্র রহিলে মজিবে দ্বারাবতী।।
শাল্বরাজ আসি আজি দ্বারকা নগরে।
যুদ্ধ করি মারিলেক তোমার পিতারে।।
শীঘ্র করি উগ্রসেন দিল পাঠাইয়া।
মজিল দ্বারকাপুর, রক্ষা কর গিয়া।।
এত শুনি চিত্তে বড় হইল বিস্ময়।
পিতৃশোকে তাপ বড় জন্মিল হৃদয়।।
বলভদ্র প্রদ্যুন্ন সাত্যকি আদি করি।
মহাবীরগণ সবে রক্ষা করে পুরী।।
এ সব থাকিতে বসুদেবেরে মারিল।
সবাই মরিল, হেন বিশ্বাস জন্মিল।।
এ তিন থাকিতে যদি দেবরাজ আসে।
নাহিক তাঁহার শক্তি দ্বারাকা প্রবেশে।।
মায়াতে সকলি হেন জানিলাম মনে।
পুনঃ যুদ্ধ আসিয়া করিনু শাল্ব সনে।।
আচম্বিতে দেখি শাল্ব সৌভপুরী হতে।
কেশপাশ মুক্ত পিতা পড়েন ভূমিতে।।
চতুর্দ্দিকে দৈত্যগণ করিছে প্রহার।
দেখিয়া আমরা সবে করি হাহাকার।।
দেখিয়া এ সব কাণ্ড ব্যাকুল হইয়া।
জ্ঞানচক্ষে চাহিলাম বিস্ময় মানিয়া।।
দেখিলাম সব মিথ্যা স্বপ্নেতে যেমন।
মায়াবী শাল্বের যত মায়ার সৃজন।।
চিত্ত হৈল স্থির বুঝি অসুরের মায়া।
না জানি কোথায় শাল্ব আছে লুকাইয়া।।
তবে কতক্ষণে শব্দ শুনি আচন্বিতে।
মার মার বলিয়া ডাকয়ে পূর্ব্বভিতে।।
শব্দ অনুসারে এড়িলাম শব্দভেদী।
যতেক মায়াবী দৈত্যে ফেলিলাম ছেদি।।
খণ্ড খণ্ড হইয়া পড়িল সিন্ধু জলে।
কুম্ভীর মকর মৎস্য ধরি সব গিলে।।
নিঃশব্দ হইয়া সব পড়িল দানব।
আর কতক্ষণে শুনি দশদিকে রব।।
করিলাম গান্ধর্ব্ব অস্ত্রের নিক্ষেপণ।
মায়া দূর হৈল, শাল্ব দিল দরশন।।
সৈন্য হত দেখিয়া দৈত্যের অধিপতি।
সে প্রাগজ্যোতিষপুরে গেল শীঘ্রগতি।।
তথা হৈতে বহু সৈন্য লইয়া আইল।
অন্ধকার করি দৈত্য গিরি বরষিল।।
অনেক প্রকারে তাহা নারি নিবারিতে।
দেখিয়া বিস্ময় হৈল আমার মনেতে।।
ভাঙ্গিল আমার রথ পর্ব্বত চাপনে।
হাহাকার করয়ে আকাশে দেবগণ।।
মোরে না দেখিয়া ব্যাকুলিত দেবগণ।
আর মিত্রগণ যত করেন রোদন।।
বজ্রের প্রসাদে পুনঃ পাই পরিত্রাণ।
সেই অস্ত্রে খণ্ড খণ্ড হইল পাষাণ।।
পর্ব্বত কাটিয়া আমি হৈলাম বাহির।
জলদ পটল হৈতে যেমন মিহির।।
পুনঃ শাল্ব নানা অস্ত্র করে বরিষণ।
যোড়হাতে দারুক করিল নিবেদন।।
মায়ার পুত্তলি এই অসুর দুরন্ত।
সুদর্শন এড় প্রভু, দৈত্য হবে অন্ত।।
সৌভপুরী দানবের রবে যতক্ষণ।
ততক্ষণ নহিবেক শাল্বের নিধন।।
সুদর্শন এড়ি শীঘ্র কাট সৌভ-পুর।
তবে ত নিধন হবে মায়াবী অসুর।।
এ কথা শুনিয়া ত্যাগ করিলাম চক্র।
দেখি দৈত্য হয় ব্যস্ত, সচকিত শক্র।।
আকাশে উঠিল চক্র সূর্য্যের সমান।
সৌভ পুরী কাটিয়া করিল খান খান।।
পুনরপি সুদর্শন বাহুড়ি আইল।
শাল্বেরে কাটিতে পুনঃ অনুজ্ঞা লইল।।
গর্জ্জিয়া উঠিল চক্র গগন মণ্ডলে।
প্রলয়ের কালে যেন শত সূর্য্য জ্বলে।।
দেখি সুরাসুর সব হইল অজ্ঞান।
শাল্ব দৈত্যে কাটি চক্র করে খান খান।।
আর যত ছিল দৈত্য গেল পলাইয়া।
দ্বারকা আসিনু তবে দৈত্যেরে বধিয়া।।
এই হেতু আসিতে না পারিনু রাজন।
আপনার মৃত্যুপথ কৈল দুর্য্যোধন।।
তুমি সত্যবাদী, সত্য করিবে পালন।
সেই বলে দুর্য্যোধন ত্যজিবে জীবন।।
এয়োদশ বৎসরান্তে হইবে সংহার।
ইন্দ্র আদি সখা হলে রক্ষা নাহি তার।।
শুন ধর্ম্ম মহীপাল আমার বচন।
গ্রহদোষ হতে দুঃখ পায় সাধু জন।।
অবনীতে ছিল পূর্ব্বে শ্রীবৎস নৃপতি।
শনি কোপে তিনি দুঃখ পাইলেন অতি।।
চিন্তাদেবী তাঁর ভার্য্যা লক্ষ্মী অংশে জন্ম।
পৃথিবীতে খ্যাত আছে তাঁহাদের কর্ম্ম।।
দ্রৌপদীর কিবা দুঃখ, শুন নৃপবর।
ইহা হতে চিন্তা দুঃখ পাইল বিস্তর।।
দৈবেতে এ সব হয়, শুন মহীপাল।
আপন অর্জ্জিত কর্ম্ম ভূঞ্জে চিরকাল।।
এবে দুঃখ পাও রাজা দৈবের বিপাকে।
ঈশ্বরের নিন্দ নাই, নিন্দ আপনাকে।।
মূল কর্ম্ম ফলাফল ভোগায় তাহাতে।
কর্ম্ম অনুসারে জীব ব্যস্ত হয় যাতে।।
শুনিয়া কৃষ্ণের কথা অতি মনোহর।
কহিছেন যুধিষ্ঠির যোড় করি কর।।
কহ প্রভু শ্রীবৎস নৃপতি কোন্ জন।
কোথায় নিবাস তাঁর, কাহার নন্দন।।
চিন্তাদেবী কার কন্যা, কহ নারায়ণ।
কিরূপে পাইল দুঃখ, কহ বিবরণ।।
রাজপুত্র হয়ে দুঃখী আমার সমান।
আর কেবা ছিল পৃথিবীতে বিদ্যমান।।
কহ কহ জগন্নাথ শুনিতে আনন্দ।
মুখ পদ্ম হতে ক্ষরে বাক্য মকরন্দ।।
বনপর্ব্ব ব্যাস ঋষি করিল প্রকাশ।
পয়ারে রচিল তাহা কাশীরাম দাস।।