২৬. ধৃতরাষ্ট্রের নিকট সনৎসুজাত মুনির আগমন

সভা হৈতে উঠি যবে সকলে চলিল।
বিদুর সহিত অন্ধ নৃপতি রহিল।।
পাণ্ডবের ভয়ে অন্ধ চিন্তানলে জ্বলে।
আসিল সনৎসুজাত মুনি হেনকালে।।
সম্ভ্রমে বিদুর তবে উঠি সেইক্ষণ।
দণ্ডবৎ করি দিল বসিতে আসন।।
অন্ধকে বিদুর জানাইল সেইক্ষণে।
আসিল সনৎসুজাত তব নিকেতনে।।
শুনি অন্ধ দণ্ডবত করিল প্রণতি।
পাদ্য অর্ঘ্য আনাইয়া দিল শীঘ্রগতি।।
তুষ্ট হয়ে আসনেতে বসে তপোধন।
কহিতে লাগিল তবে অম্বিকা নন্দন।।
পাপাত্মা কুবুদ্ধি দুর্য্যোধন মোর সুত।
কলহ বাঞ্ছয়ে সদা পাণ্ডব সহিত।।
পাণ্ডুপুত্রগণ কভু অহিত না করে।
যতেক দারুণ কষ্ট দিল বারে বারে।।
সকল ক্ষমিল তারা আমার কারণ।
তথাপিহ তারে নাহি দেয় রাজ্যধন।।
পাণ্ডবের দূত হয়ে বুঝাইল হরি।
তাঁর বাক্য না শুনিল মহাপাপকারী।।
বুঝাইল মুনিগণ না শুনিল কাণে।
ভীষ্ম দ্রোণ আদি আমি যত পুরজনে।।
কারো বাক্য না শুনিল দুষ্ট দুর্য্যোধন।
আপনি তাহারে কিছু বলে তপোধন।।
তত্ত্বজ্ঞান কহি তারে করাহ সুমতি।
পাণ্ডবেরে ছাড়ি যেন দেয় বসুমতী।।
শুনিয়া সনৎসুজাত কহেন তখন।
দিনমণি যদি উঠে পশ্চিম গগন।।
তথাপি পাণ্ডব সহ নাহি হবে প্রীতি।
পূর্ব্বের কাহিনী শুন, কহি শাস্ত্রনীতি।।
প্রবল অসুরে যবে পৃথিবী ব্যাপিল।
দান যজ্ঞ গো ব্রাহ্মণ সকল হিংসিল।।
হিংসাতে পূরিল ক্ষিতি, ধর্ম্ম হৈল ক্ষয়।
দেখিয়া পৃথিবী বড় মনে পেয়ে ভয়।।
ব্রহ্মার সাক্ষাতে গিয়া কহিল গোহারী।
হিংসকের ভার আর সহিতে না পারি।।
আমাতে জন্মিয়া জীব করে অহঙ্কার।
মোর ‍রাজ্য, মোর ধন, মোর পরিবার।।
মরিলে সম্বন্ধ দেখ নাহি কার সনে।
আমারে হিংসয়ে লোক আপনা না জানে।।
কার বাধ্য নহি আমি, কার আপ্ত নহি।
কীট পক্ষী নর বৃক্ষ সবাকারে বহি।।
আমাতে জন্মিয়া সুখে আমাতে বিহরে।
আমাতে জন্মিয়া জীব আমাতেই মরে।।
উৎপত্তি প্রলয় স্থিতি আমি সবাকার।
তবু অবিচারে হিংসা করে দুরাচার।।
তবু অবিচারে হিংসা করে দুরাচার।
অহিংসা পরম ধর্ম্ম, মনে নাহি জানে।।
আমার আমার নাহি করিলে আপনে।
প্রলয় অসুর ব্যাপ্ত হইল এক্ষণে।।
সহিতে না পারি আর অসুরের ভার।
পাতালেতে যাই আমি লভিতে নিস্তার।।
পৃথিবীর স্তবে তুষ্ট হয়ে পদ্মাসন।
হরির নিকটে গিয়া করেন স্তবন।।
নমঃ আদি অন্তহীন, নিত্য সনাতন।
তোমার আজ্ঞায় সৃষ্টি করিনু সৃজন।।
হেন সৃষ্টি নাশ করে অসুর প্রবল।
সহিতে না পারে ক্ষিতি, যায় রসাতল।।
উপায়ে উদ্ধার কর ব্রহ্মা-সনাতন।
এইরূপে নানা স্তুতি কৈল পদ্মাসন।।
স্তুতিবশে সুপ্রসন্ন হয়ে জগন্নাথ।
দিব্যরূপ হইলেন ব্রহ্মার সাক্ষাৎ।।
সাক্ষাতে দেখিল হরি কমল-আসন।
দণ্ডবৎ করি পুনঃ করিল স্তবন।।
গোবিন্দ কহেন, ভয় না করিহ আর।
তোমার বচনে আমি হব অবতার।।
চারি যুগে চারি অংমে হয়ে অবহার।
যতেক অসুরগণে করিব সংহার।।
এত বলি নিজস্থানে যান নারায়ণ।
শুনি ব্রহ্মা চলিলেন হয়ে হৃষ্টমন।।
সান্ত্বাইয়ে পৃথিবীরে বলিল বচন।
অচিরেতে তব দুঃখ হইবে মোচন।।
প্রত্যক্ষ হইয়া প্রভু কহিলা আমারে।
অবতার হয়ে সব মারিবে অসুরে।।
অচিরেতে তব ভার করিবে মোচন।
যুগে যুগে অবতার হয় নারায়ণ।।
শুনিয়া পৃথিবী হৈল আনন্দিতা মনে।
প্রণমি ব্রহ্মারে তবে গেল নিজ স্থানে।।
অঙ্গীকার পালিবারে দেব দামোদর।
প্রথমে ধরেন প্রভু মৎস্য কলেবর।।
বেদ উদ্ধারিয়া হয়গ্রীব বিনাশন।
অনন্তর কূর্ম্মরূপ হন নারায়ণ।।
মন্দর ধরিয়া করি সমুদ্র মন্থন।
নারীরূপে করিলেন অসুরে মোহন।।
বরাহাবতার হইলেন অতঃপরে।
ধরণী উদ্ধারি মারে হিরণ্যাক্ষ বীরে।।
তৎপরে নৃসিংহমূর্ত্তি ধরি নারায়ণ।
হিরণ্যকশিপু দৈত্য করেন নিধন।।
ধরিয়া বামনরূপ দেব তারপর।
বলির নাশেন দর্প দেব দামোদর।।
নাগপাশে বান্ধি তারে রাখে রসাতলে।
নিজ অধিকার দেন যত দিক্পালে।।
সত্যযুগে হইলেন এই অবতার।
অসুরের অহঙ্কার কৈল ছারখার।।
ত্রেতাযুগে ক্ষত্রে সব পৃথিবী পূরিল।
ভৃগুবংশে তাঁর অংশে অবতার হৈল।।
পৃথিবীর ক্ষত্রগণে করিল সংহার।
রামরূপে পুনরপি হৈল অবতার।।
দারুণ রাক্ষস মারিলেন দশাননে।
কৃষ্ণ অবতার প্রভু হৈলেন এক্ষণে।।
বকাসুর কংস আর পূতনা রাক্ষসী।
জরাসন্ধ রাজা আর শিশুপাল কেশী।।
অবহেলে বধিলেন এ সব অসুরে।
অবশেষ যত মারিবেন সবাকারে।।
বিশ্বের কারণ সেই সৃজন পালন।
সেই সৃজে, সেই পালে, করে সংহরণ।।
তার বশ দেখ রাজা এ তিন ভুবন।
ভেদবুদ্ধি করাবার তিনিই কারণ।।
তাঁহার বিষম মায়া কে বুঝিতে পারে।
একের বাড়ান ক্রোধ ‍অন্যেরে সংহারে।।
অদৃষ্টে যাহার যেই আছয়ে লিখন।
বিধাতার শক্তি নাহি করিতে খণ্ডন।।
পৃথিবীর ক্ষত্র নাশ হইবে অবশ্য।
চিত্তে ক্ষমা দেহ ‍রাজা, বুঝিয়া রহস্য।।
পৃথিবীতে দেখ যত যত ক্ষত্রগণ।
পরস্পর ভেদ করি হইবে নিধন।।
দ্বাপর যুগের রাজা হৈল অবশেষ।
ক্ষত্রক্ষয় হৈতে হবে জানিহ বিশেষ।।
যদুকুল নিরমূল হবে অবশেষে।
ভবিষ্যৎ অবতার হবে কলিশেষে।।
এ সব জানিয়া রাজা ধর্ম্মে দেহ মন।
পরলোক হেতু চিন্ত ঈশ্বর চরণ।।
নানা যজ্ঞ ধর্ম্ম কর্ম্ম কর অবিরত।
এ বিনা উপায় নাহি, কহিনু নিশ্চিত।।
এত বলি সনৎসুজাত সে তপোধন।
আপন আশ্রমে প্রতি করিল গমন।।
চিত্তেতে প্রবোধ পেয়ে অন্ধ নরপতি।
ক্ষমা দিয়া মৌনভাবে রহে মহামতি।।
বিদুর চলিয়া গেল আপন ভবন।
কহিলাম মহারাজ কথা পুরাতন।।
মহাভারতের কথা অমৃত লহরী।
কাশী কহে, শুনিলে তরয়ে ভববারি।।
শুনিলে অধর্ম্ম খণ্ডে, পরলোকে তরে।
অবহেলে শুনে যেন সকল সংসারে।।