১৬. নারায়ণী সেনা লইয়া দুর্য্যোধনের হস্তিনায় প্রত্যাগমন

নারায়ণী সেনা লয়ে গেল দুর্য্যোধন।
নানাবাদ্য কোলাহলে মহা হৃষ্টমন।।
পথে শল্যরাজা সহ হৈল দরশন।
তাঁহার সহিত গিয়া করিল মিলন।।
শল্যেরে সম্ভাষ করি কহে দুর্য্যোধন।
যুদ্ধ হেতু তোমা আমি করিনু বরণ।।
শল্য বলে, যেই আজ্ঞা তব মহাশয়।
তোমার স্বপক্ষ আমি হইব নিশ্চয়।।
কিন্তু পাণ্ডুপুত্রগণ ভাগিনা আমার।
যাই আমি, তাহা সহ দেখা করিবার।।
দিবস অতীত বহু নাহিক মিলন।
দেকিয়া আসিব আমি পাণ্ডুপুত্রগণ।।
দুর্য্যোধন বলে, তথা কি কাজ তোমার।
নিকটে দেখিবে হেথা পাণ্ডুর কুমার।।
আমার স্বপক্ষ হৈলে কেন যাবে তথা।
দেখিলে ‍না ছাড়ি দিবে ভীম মহারথা।।
সত্যবাদীগণ মধ্যে গণি যে তোমায়।
সত্যভ্রষ্ট হৈতে চাহ, বুঝি অভিপ্রায়।।
ইহা শুনি শল্য স্থির করিলেন মন।
সসৈন্যে সাজিয়া গেল সহ দুর্য্যোধন।।
আর যত রাজগণ মধ্যদেশে ছিল।
যুদ্ধ হেতু দুর্য্যোধন সবারে বলিল।।
একাদশ অক্ষৌহিণী করি সমাবেশ।
আপনার উপায় না গণিল বিশেষ।।
মদগর্ব্বে দুর্য্যোধন আশা করে হেন।
পাণ্ডবে জিনিয়া ত্বরা লবে রাজ্যধন।।
ক্ষত্রধর্ম্ম শাস্ত্রনীতি করি কুরুপতি।
মাত্র মিত্র ভৃত্যগণ অমাত্য সংহতি।।
ভীষ্ম দ্রোণ কৃপ শল্য রাধার তনয়।
সোমদত্ত বীর ভূরিশ্রবা মহাশয়।।
দুঃশাসন দুর্ম্মুখ শকুনি সৌবল।
নৃপতি সুশর্ম্মা ভগদত্ত মহাবল।।
ধৃতরাষ্ট্র নরপতি বিদুর সুমতি।
সভা করি বসি আছে কৌরবের পতি।।
সবারে চাহিয়া বলে রাজা দুর্য্যোধন।
মম মনস্কাম পূর্ণ হইল এখন।।
একাদশ অক্ষৌহিণী হইল সঙ্গতি।
সত কোটী মহারথী আমার সংহতি।।
আমারে জিনিতে পারে, কে আছে সংসারে।
অবহেলে পরাজিব পাণ্ডুর কুমারে।।
কর্ণের প্রতাপ সহে আছে কোন জনে।
একশ্বর পরাজিবে পাণ্ডুর নন্দনে।।
যত যত বীর আছে আমার অধীনে।
পাণ্ডবে জিনিতে পারে এক এক জনে।।
পাণ্ডবেরে ভয় কিবা আছয়ে আমার।
একাদশ অক্ষৌহিণী মম পরিবার।।
শুন পিতামহ ভীষ্ম মাতুল আচার্য্য ।
প্রাণপণে কর সবে আমার সাহায্য।।
ক্ষত্রধর্ম্ম শাস্ত্রমত জানহ আপনে।
পাণ্ডবের উপোধ না করিহ মনে।।
উপরোধে পাণ্ডবেরা কভু না ক্ষমিবে।
কদাচিৎ উপরোধ তারে না করিবে।।
রাজার বচন শুনি কহে কুরুগণ।
না বুঝিয়া হেন বাক্য কহ দুর্য্যোধন।।
কখন তোমার শত্রু না হয় পাণ্ডব।
কি কারণে দুর্য্যোধন কহ এত সব।।
মো সবার শক্তি যত করিব সর্ব্বদা।
না পারিব জিনিতে পাণ্ডব মহারথা।।
দেবের অবধ্য বীর পাণ্ডুর নন্দন।
মহাযুদ্ধে বিশারদ, প্রতাপে তপন।।
তাহারে জিনিবে হেন আছে কোন্ বীর।
বিশেষতঃ ধর্ম্ম-আত্মা রাজা ‍যুধিষ্ঠির।।
ধর্ম্ম-অনুগত পার্থ ভীম মহাশয়।
দুই ভাই ধর্ম্মপ্রিয় মাদ্রীর তনয়।।
ধর্ম্মবলে বাহুবলে কেহ নহে ন্যূন।
কত বা তোমারে বুঝাইব পুনঃ পুনঃ।।
তাহার পৈতৃক রাজ্য যে হয় উচিত।
তাহা দিয়া সবা সহ করহ পীরিত।।
ভাই ভাই বিরোধিয়া কিবা প্রয়োজন।
ইথে ক্ষত্রধর্ম্ম রাজা না করি গণন।।
হারিলে অখ্যাতি, নাহি জিনিলে পৌরুষ।
কুলক্ষয় হবে আর অধর্ম্ম অযশ।।
ধার্ম্মিক পুরুষ তুমি, এ কর্ম্ম না কর।
কদাচিৎ ভাই ভাই না কর সমর।।
ভাই সহ প্রীতিভাবে বঞ্চ নানা সুখ।
বিরোধ করিলে মনে পাবে বড় দুখ।।
বিপদ হইলে তব নাহি পরিত্রাণ।
পূর্ব্বের কাহিনী কহি, কর অবধান।।
আছিল রাবণ রাজা ব্রহ্মবংশে জন্ম।
জ্ঞাতি বন্ধু ভাই সহ করিল অধর্ম্ম।।
কত দিনান্তরে রাম রঘুর নন্দন।
পিতৃসত্য পালিবারে প্রবেশেন বন।।
অনুজ লক্ষ্মণ আর জানকী সহিতে।
বহু দিন রঘুনাথ থাকেন বনেতে।।
কালেতে কুবুদ্ধি হৈল রাবণ রাজার।
সীতারে হরিয়া নিল দুষ্ট দুরাচার।।
সেইকালে রঘুনাথ বীর-অবতরি।
সুগ্রীবে সহায় করি বেড়ে লঙ্কাপুরী।।
রাবণের ছোট ভাই সুবুদ্ধি সুমতি।
মহাধর্ম্ম আত্মা বিভীষণ মহামতি।।
ধর্ম্ম-উপদেশ বহু বুঝাইল বাণী।
রাবণ না শুনে কথা অহঙ্কার মানি।।
অহঙ্কার কার কথা মনে না ধরিল।
ভ্রাতাকে নিন্দিয়া কতশত গালি দিল।।
কুবাক্য বলিয়া করে চরণ-প্রহার।
সেই হেতু চিত্তে দুঃখ হইল অপার।।
শ্রীরামের সহ আসি করিল মিলন।
শ্রীরাম অভয় তারে দিলেন তখন।।
রাবণে সবংশে মারি বীর রঘুমণি।
করিলেন উদ্ধার সে জনক-নন্দিনী।।
বিভীষণে রাজা করি আসিলেন দেশে।
পূর্ব্বের কাহিনী এই কহিনু বিশেষে।।
সে কারণে ভাই ভাই দ্বন্দ্বে নাহি কাজ।
সমুচিত ভাগ তারে দেহ মহারাজ।।
এইরূপ কহি তারে সব পরিবার।
মৌনভাবে রহে মন বুঝিবারে তার।।
দুর্য্যোধন বলে, করিয়াছে আমি সত্য।
অকারণে কেন এত বল নিত্য নিত্য।।
জীয়ন্তে পান্ডব সহ নাহি মম প্রীত।
বিধান করহ সবে ইহার বিহিত।।
এতেক বলিল যদি রাজ দুর্য্যোধন।
কেহ আর উত্তর না দিল মন্ত্রিগণ।।
অদৃষ্ট মানিয়া সবে গেল নিজ স্থান।
অনুচরগণে রাজা করে আজ্ঞা দান।।
যুদ্ধ হেতু আয়োজন কর বহুতর।
রাজার আজ্ঞায় চর ধাইল বিস্তর।।
নানা অস্ত্রে পূর্ণ করে সকল ভাণ্ডার।
গদা খড়গ ধনুর্গুণ দিব্য অস্ত্র আর।।
মহাভারতের কথা অমৃত সমান।
কাশীরাম দাস কহে শুনে পূণ্যবান।।