০৩. রাজ্যলাভার্থ পাণ্ডবগণের পরামর্শ ও ধৌম্য-দ্বিজকে হস্তিনায় প্রেরণ

বৈশম্পায়ন বলেন, শুন জন্মেজয়।
বিরাট-নগরে পঞ্চ পাণ্ডুর তনয়।।
অজ্ঞাতে হইয়া মুক্ত মনে আনন্দিত।
সুহৃদ বান্ধব সহ হইল মিলিত।।
অভিমন্যু-বিবাহ-উৎসব দিনান্তরে।
রজনী বঞ্চিয়া সুখে মহাসমাদরে।
প্রাতঃকালে বসিলেন বিরাট-সভায়।।
শত সূর্য্য, শত চন্দ্র, যেন শোভা পায়।।
দিব্য সিংহাসনে বসিলেন যুধিষ্ঠির।
বামেতে নকুল ভীম পার্থ মহাবীর।।
দক্ষিনেতে সহদেব দুরুপদ রাজন।
ধৃষ্টদ্যুন্ন বীর ‍আদি আর যত জন।।
সম্মূখে বসিয়া কৃষ্ণ কমললোচন।
প্রসঙ্গ করিল তবে দ্রুপদ রাজন।।
যেই সত্য করেছিল পাণ্ডুর তনয়।
ধর্ম্ম-অনুবলে তাহা হইল উদয়।।
আপন পৈতৃক ভাগ যে হয় উচিত।
লইতে উপায় তার করহ বিহিত।।
মোর চিত্তে লয়, দুষ্ট ‍পাপিষ্ঠ কৌরব।
সম্প্রীতে কভু না ছাড়িবে রাজ্য বৈভব।।
উত্তর গোগৃহে যত পায় অপমান।
একেশ্বর ধনঞ্জয় করে সমাধান।।
সেই অপমানে রাজা কৌরবের পতি।
না করিবে প্রীতি, হেন লয় মম মতি।।
তথাপি আছয়ে হেন শাস্ত্রের বিধান।
দূত পাঠাইয়া দেহ ধৃতরাষ্ট্র-স্থান।।
প্রিয়ম্বদ দূত যেই নীতিশাস্ত্র জানে।
বিধিমতে বুঝাইবে অম্বিকা-নন্দনে।।
ভীষ্ম দ্রোণে বুঝাইবে রাজা দুর্য্যোধনে।
তবে যদি রাজ্য নাহি দেয় কদাচনে।।
তবে যা বিধান হয়, করিব উচিত।
আমা সবা মিলি শাস্তি দিব সমুচিত।।
এতেক বলিল যদি দ্রুপদ ভূপতি।
ভাল ভাল বলি সায় দিলেন নৃপতি।।
ভাল ভাল, বলি ইহা লয় মম মন।
সম্প্রীতে হইলে দ্বন্দ্বে কোন্ প্রয়োজন।।
প্রিয়ম্বদ দূত যাক হস্তিনা-নগরে।
জ্যেষ্ঠতাত আদি করি বুঝাবে সবারে।।
দুর্য্যোধনে বুঝাউক, রাগার নন্দনে।
তবে যদি সম্প্রীতি না করে কদাচনে।।
তবে যা বিধান হয় করিব উচিত।
এত শুনি ধৃষ্টদ্যুন্ন কহে সুবিহিত।।
অকারণে দূত পাঠাইবে তথাকারে।
সম্প্রীতে না দিবে রাজ্য কৌরব পামরে।।
মহা খল পাপাচার দুষ্ট দুর্য্যোধন।
ততোধিক কর্ণ সেই রাধার নন্দন।।
কপটে যতেক কষ্ট দিল দুষ্টগণ।
বিনা যুদ্ধে শান্ত নাহি হবে কদাচন।।
মুহূর্ত্তেক ক্ষমা করা উচিত না হয়।
ইন্দ্রপ্রস্থে চল যাই লয়ে সৈন্যচয়।।
লইবে আপন রাজ্য বলে মহারাজ।
না নিলে বাড়িবে দর্প, নাহি দিলে লাজ।।
সে কারণে মাগিবার নাহি প্রয়োজন।
আপন ইচ্ছায় লহ আপন শাসন।।
তবে যদি দ্বন্দ্ব করে কৌরব-কুমার।
আমা সবা মিলি তারে করিব-সংহার।।
সবংশে করিব ক্ষয় দুষ্ট কুরুগণে।
এই যুক্তি নরপতি লয় মম মনে।।
ভীমসেন বলে, ভাল কৈলে নরপতি।
আপনি যেমত বিজ্ঞ কহিলে তেমতি।।
সম্প্রীতে না দিবে রাজ্য কুরু পাপাশয়।
মুহূর্ত্তেক তারে ক্ষমা যুক্তিযুক্ত নয়।।
যত দুঃখ দিল দুষ্ট পাপী দুর্য্যোধন।
সে সব স্মরণে মম হেন লয় মন।।
রজনীর মধ্যে সব হস্তিনা বেড়িয়ে।
সকল কৌরবগণে মারহ পোড়ায়ে।।
তবে সে আমার খণ্ডে হৃদয়ের তাপ।
এরূপে নিঃশ্বাস ছাড়ে যেন কালসাপ।।
ক্রোধেতে কম্পিত অঙ্গ অরুণ লোচন।
রাজারে চাহিয়া বলে করিয়া গর্জ্জন।।
তোমার কারণে এত দুঃখ সবাকার।
তোমার কারণে জীয়ে কৌরব-কুমার।।
কি বুঝি সম্প্রীতি বল করি তার সনে।
বিনা দ্বন্দ্বে বাধ্য নহে রাজা দুর্য্যোধনে।।
আজ্ঞা কর, নরপতি বিলম্ব না সয়।
সসৈন্যে সাজিয়া আজি চল হস্তিনায়।।
সবংশে মারিব আজি রাজা দুর্য্যোধনে।
এই যুক্তি নরপতি লয় মম মনে।।
অর্জ্জুন বলেন, ভাল কৈলে মহাশয়।
আজ্ঞা কর কুরুগণে করি পরাজয়।।
ক্ষমিবার যোগ্য নহে, কি হেতু ক্ষমিব।
রজনীর মধ্যে আজি কৌরবে মারিব।।
পার্থ- বাক্যে মাদ্রী-সুত জানায় সম্মতি।
হাসিয়া কহেন তবে দেব জগৎপতি।।
সে কহিল ভীমসেন আর ধনঞ্জয়।
সেই মত করিবারে সমুচিত নয়।।
তথাপি আছয়ে হেন শাস্ত্রের বিধান।
সম্প্রীতে রিপুর সঙ্গে করিবে সন্ধান।।
সম্প্রীতে না দিলে, বল করিবে পশ্চাতে।
পূর্ব্বাপর হেন রাজা আছয়ে শাস্ত্রেতে।।
প্রিয়ম্বদ দূত হবে, সর্ব্বশাস্ত্র জানে।
পাঠাইয়া দেহ আগে হস্তিনা ভবনে।।
দুর্য্যোধন আদি করি যত সভাজনে।
ধর্ম্মনীতি বুঝাউক শাস্ত্রের বিধানে।।
তবে যদি ‍রাজ্য নাহি দেয় দুর্য্যোধন।
মনে যাহা লয়, তাহা করিও তখন।।
হেন চিত্তে লয় মম, রাজা দুর্য্যোধন।
মনে যাহা লয়, তাহা করিও তখন।।
হেন চিত্তে লয় মম, রাজা দুর্য্যোধন।
সম্প্রীতে না দিবে রাজ্য, করিবেক রণ।।
ভূপতি বলেন, ভাল কথা নারায়ণ।
দূত পাঠাইয়া দেহ হস্তিনা ভবন।।
ধর্ম্মনীতি বুঝাইবে অম্বিকা-নন্দনে।
তবু রাজ্য ছাড়িবে না, লয় মম মনে।।
পশ্চাতে করিব তবে যেই মনে লয়।
শুনিয়া উত্তর করিছেন ধনঞ্জয়।।
বিরাট দ্রুপদ আদি সুহৃদ সুজন।
রাজারে চাহিয়া তবে বলিল বচন।।
সম্প্রীতে না দিলে রাজ্য কুরু কুলাঙ্গার।
মোরা সবে মিলি তারে করিব সংহার।।
এই মত যুক্তি করে যত রাজগণ।
তবে ধৌম্যে বলিলেন ধর্ম্মের নন্দন।।
হস্তিনা-নগরে দেব যাহ শীঘ্রগতি।
প্রীতিবাক্যে বুঝাইয়ে কুরুগণ প্রতি।।
ভীষ্ম দ্রোণ বিদুরাদি অম্বিকা-কুমারে।
প্রীতিবাক্যে সমাচার দিবে সবাকারে।।
গান্ধারী প্রভৃতি আর জননী কুন্তীরে।
সমভাবে নমস্কার জানাবে সবারে।।
জ্যেষ্ঠতাত ধৃতরাষ্ট্রে কহিবে বচন।
তোমার প্রসাদে জীয়ে ভাই পঞ্চ জন।।
সম্প্রীতে বিনয় ভাবে অগ্রেতে কহিবে।
না শুনিলে উপযুক্ত বচন বলিবে।।
দম্ভ করি কহিবে, না কর তাহে ভয়।
পাণ্ডবের হাতে তোর হবে কুলক্ষয়।।
কপটে যতেক দুঃখ দিলে সবাকারে।
সেই তাপ-হুতাশনে দহে কলেবরে।।
তাহার উচিত শাস্তি অবিলম্বে দিবে।
স্বংশেতে দুর্য্যোধনে অবশ্য মারিবে।।
এরূপে ধৌম্যেরে কহি ভাই পঞ্চ জন।
পাঠাইয়া দিল তাঁরে হস্তিনা ভবন।।
তবে কৃষ্ণ প্রদ্যুন্নাদি যত পদুগণ।
যুধিষ্ঠিরে সম্বোধিয়া করে নিবেদন।।
আজ্ঞা কর দ্বারাবতী করি আগুসার।
আসিব সংবাদ পেলে হেথা পুনর্ব্বার।।
যুধিষ্ঠির বলে, শুন কহি নারায়ণ।
সম্প্রীতে না দিবে রাজ্য দুষ্ট দুর্য্যোধন।।
অবশ্য হইবে রণ, না হবে খণ্ডন।
কৌরব সহায় মহা মহা বীরগণ।।
তুমি অনুবলমাত্র কেবল আমার।
তোমা বিনা গতি আর নাহি মো সবার।।
তোমা বিনা আমরা যে ভাই পঞ্চ জন।
যেমন সলিল-হীন মীনের জীবন।।
চন্দ্র বিনা রাত্রি যেন শোভা নাহি পায়।
তেন তোমা বিনা পঞ্চ পাণ্ডুর তনয়।।
আপনি আমারে কৃষ্ণ হও অনুকূল।
তবে সে জিনিতে পারি কৌরবে সমূল।।
এত শুনি হাসি হাসি বলে নারায়ণ।
যে আজ্ঞা করিবে, তাহা করিব পালন।।
মহারণ হব আমি র্পার্থের সারথি।
স্বংশে করিব ক্ষয় কুরু-বংশপতি।।
পার্থের বিক্রম রাজ্য খ্যাত ত্রিভুবনে।
একেশ্বর জিনিবেক যত কুরুগণে।।
ইন্দ্র আদি দেবগণ স্থির নহে রণে।
কি করিবে শত ভাই কৌরব আপনে।।
এত বলি আলিঙ্গন করি সেইক্ষণে।
সবান্ধবে যান কৃষ্ণ দ্বারকা ভবনে।।
উদ্যোগপর্ব্বের কথা অপূর্ব্ব আখ্যান।
ব্যাস বিরচিত দিব্য ভারত পুরাণ।।
পড়ে যেবা, শুনে যেবা, কহে যেই জন।
সর্ব্ব দুঃখ খণ্ডে তার আপদ মোচন।।
সেই কথা কহি আমি রচিয়া পয়ার।
অবহেলে শুনে যেন সকল সংসার।।
কাশীরাম দাস কহে, পয়ার প্রবন্ধে।
পিয়ে সাধুজন নিঙরিয়া ভাষা ছন্দে।।