০২. ইন্দ্রের জন্ম, তৎকর্ত্তৃক গুরুপত্নী হরণ ও গৌতমের শাপ

দক্ষকন্যা অদিতি যে কশ্যপ গৃহিনী।
পুত্রবাঞ্ছা করিয়া ভজিল শূলপাণি।।
প্রত্যক্ষ হইয়া বর যাচেন শঙ্কর।
মাগিল অদিতি বর করি যোড়কর।।
মম গর্ভে হবে যেই সন্তান উৎপত্তি।
ত্রিভুবন মধ্যে যেন হয় মহামতি।।
নাগ নর সুর আদি প্রজাপতিগণ।
সবে পূজা করিবেন তাহার চরণ।।
স্বস্তি বলি বর তারে দেন শূলপাণি।
স্বামীরে কহিল তবে দক্ষের নন্দিনী।।
আমারে দিলেন বর দেব পঞ্চানন।
ত্রিভুবনে রাজা হবে তোমার নন্দন।।
কশ্যপ বলিলা শিববাক্য মিথ্যা নয়।
মহাবলবন্ত হবে তোমার তনয়।।
ত্রিভুবন মধ্যে সেই হইবেক রাজা।
এ তিন ভুবনে লোক করিবেক পূজা।।
স্বামীর নিকটে কন্যা পাইল সম্মান।
কতদিনে অদিতি করিল ঋতুস্নান।।
স্বামী সহ বতি কেলি কুতূহলে করে।
বিষ্ণু অংশে পুত্র আসি জন্মিল উদরে।।
পরম সুন্দর পুত্র ভূমিষ্ঠ হইল।
ইন্দ্র বলি নাম তার মুনিবর দিল।।
দ্বাদশ আদিত্য তবে জন্মিল বিশেষে।
যাহার উদয়ে দিন আপনি প্রকাশে।।
কত দিনান্তরে তবে দক্ষের নন্দিনী।
ঋতুস্নান করিয়া স্বামীরে বলে বাণী।।
রতি করিলেন মুনি দক্ষের কন্যায়।
গর্ভেতে পবন আসি জন্মিল তাহায়।।
কহিলেন ভার্য্যারে কশ্যপ তপোধন।
ত্রিভুবন ব্যাপিবেক তব এ নন্দন।।
ছোট বড় জীব জন্তু আছয়ে যতেক।
সর্ব্বভূতে হইবেক নন্দন প্রত্যেক।।
ইহা সম বলবন্ত কেহ না হইবে।
সকল সংসার এই ব্যাপিত করিবে।।
শুনি আনন্দিত হৈল দক্ষের নন্দিনী।
স্বর্গলোকে চলিলা কশ্যপ মহামুনি।।

কত দিনে নারদ আইল সুরপুরে।
সঙ্কেতে ডাকিয়া মুনি বলিল ইন্দ্রেরে।।
তোমায় মায়ের গর্ভে হবে যেই জন।
জন্মমাত্রে করিবেক জগৎ ব্যাপন।।
ইহা বলি যথাস্থানে যান তপোধন।
বিস্ময় মানিয়া ইন্দ্র ভাবিল তখন।।
এইক্ষণে না করিলে সংহার ইহারে।
জন্মিলে অনেক মন্দ করিবে আমারে।।
এতেক বিচার চিত্তে বাসব করিল।
সূক্ষারূপে জননীর গর্ভে প্রবেশিল।।
যেইকালে নিদ্রাগত দক্ষের নন্দিনী।
সেই গর্ভ কাটিয়া করিল সাতখানি।।
কাটিলেন পুনঃ একখানি সাতবার।
তাহাতে হইল উনপঞ্চাশ প্রকার।।
চিত্তেতে সানন্দ ইন্দ্র হইল নির্ভয়।
কতদিনে প্রসবিল সকল তনয়।।
ক্রমে উনপঞ্চাশ জন্মিল প্রভঞ্জন।
দেখিয়া হইল ইন্দ্র সবিস্ময় মন।।
অহিংসকে হিংসিয়া পাইলা বড় তাপ।
জন্মিল পবনদেব অতুল প্রতাপ।।

তবে কতদিনে ইন্দ্র কশ্যপ নন্দন।
গৌতমের স্থানেতে করিল অধ্যয়ন।।
চারিবেদ ষটশাস্ত্র অধ্যয়ন কৈল।
তথাপিও কিছু তার জ্ঞান ‍না জন্মিল।।
পরমা সুন্দরী দেখি গুরুর রমণী।
তারে হরিবারে ইচ্ছা করে সুরমণি।।
একদিন যান মুনি স্নান করিবার।
দেখে ইন্দ্র গুরুপত্না একা আছে ঘরে।।
মদনে পীড়িত হয়ে অদিতি নন্দন।
মায়া কার গুরুরূপী হইল তখন।।
গুরুরূপে গুরুপত্নী হরিল দেবেন্দ্র।
ক্ষণকাল পরে ঘরে আইল মুনন্দ্র।।
স্বামীরে কহিল পরে বিনয় বচন।
স্নান করিবারে গেলে করিয়া রমণ।।
কিরূপে করিয়া স্নান এলে মুহূর্ত্তেকে।
ইহার বৃত্তান্ত প্রভু বলিবা আমাকে।।

এত শুনি মুনিবর ভাবি মনে মন।
করিল অধর্ম্ম বুঝি কশ্যপ নন্দন।।
গুরুপত্নী হরে এত করে অহঙ্কার।
অতএব করিব ইহার প্রতিকার।।
নিস্ফল করিলি যত শাস্ত্র অধ্যয়ন।
তোর সম অজ্ঞান না দেখি কোনজন।।
কপট করিয়া গুরুপত্নীরে হরিলি।
পাইবি উচিত ফল যে কর্ম্ম করিলি।।
হউক সহস্রযোনি শক্রের শরীরে।
অলঙ্ঘ্য গৌতম বাক্য কে অন্যথা করে।।
হইল সহস্রযোনি শক্রের শরীরে।
স্বদেহ দর্শনে ইন্দ্র বিষণ্ন অন্তরে।।
কোন্ লাজে দেবমাঝে দেখাব বদন।
তপস্যা করিয়া আত্মা করিব নিধন।।
সকল শরীরে আচ্ছাদিলেক বসন।
চিন্তিত হইয়া যান কশ্যপ নন্দন।।
ক্ষীরোদের কূলে গিয়া কশ্যপকুমার।
করিল সহস্র বর্ষ তপ অনাহার।।
সুরপুর নষ্ট হেথা হয় ইন্দ্র বিনে।
পাপিষ্ঠ রাক্ষস নাশ করে রাত্রি দিনে।।
দুরন্ত অসুর সব দেশেত ব্যাপিল।
দান যজ্ঞ তপ জপ সকলি নাশিল।।
জানিয়া কশ্যপ মুনি সচিন্তিত মনে।
এ সকল তত্ত্ব পরে জানিলেন ধ্যানে।।
ব্রহ্মাকে করেন স্তুতি বিবিধ প্রকারে।
তোমার নির্ম্মিত সৃষ্টি অসুরে সংহারে।।
কুকর্ম্ম করিল ইন্দ্র আমার নন্দন।
কামবশে গুরুপত্নী করিয়া হরণ।।
গৌতম দারুণ শাপ দিলেক তাহারে।
হইল সহস্র ভগ তাহার শরীরে।।
ক্রোধ করি দেবরাজ মজে অপমানে।
ক্ষীরোদের কূলে তপ করে একাসনে।।
ইন্দ্র বিনা অসুরেতে জগৎ ব্যাপিল।
তব বিরচিত সৃষ্টি সব নষ্ট হৈল।।
অতএব বাসবেরে করহ উদ্ধার।
নিস্তার করহ প্রভু শাপান্ত তাহার।।

এইরূপ কশ্যপ কহিল বহুতর।
শুনিয়া সদয় হইলেন সৃষ্টিধর।।
গৌতমেরে আনিয়া কনেহ বহুতর।
মম বাক্য রক্ষা তুমি কর মুনিবর।।
পাইল উচিত শাস্তি ক্ষমা দেহ মনে।
কৃপায় শাপান্ত কর অদিতি নন্দনে।।

গৌতম বলিল মুনি কর অবধান।
কহিলাম যে কথা সে না হইবে আন।।
তোমার কারণে বর দিলাম তাহারে।
সহস্রেক চক্ষু যেন দেবরাজ ধরে।।
শুনিয়া কশ্যপ মুনি আনন্দিত মন।
যথাস্থানে গেলা করি দেব সম্ভাষণ।।
সত্যলোকে গেলেন গৌতম তপোধন।
কশ্যপ আইল যথা আপন নন্দন।।
অব্যর্থ মুনির বাক্য না হয় খণ্ডণ।
ভগচিহ্ন অঙ্গে লুপ্ত হইল তখন।।
সহস্রেক চক্ষু হৈল ইন্দ্রের শরীরে।
আপনাকে দেখি ইন্দ্র হরিষ অন্তরে।।
কশ্যপ বলিল পুত্র কর অবধান।
অনুচিত কর্ম্ম না করিও, সাবধান।।
কাম ক্রোধ লোভ মোহ নিতান্ত বর্জ্জিহ।
কদাচিত কোনজনে হিংসা না করিহ।।
জ্ঞাতি বন্ধু আদি করি যত পরিবার।
কদাচিত হিংসা নাহি করিবে কাহার।।

এত বলি ইন্দ্রকে প্রেরিল যথাস্থান।
এই শুন কহিলাম পূর্ব্ব উপাখ্যান।।
ভীষ্ম যাহা কহিলেন না হয় অন্যথা।
সম্প্রতি পাণ্ডবগণে আন রাজা হেথা।।
সমুচিত রাজ্য দেহ ছাড়িয়া তাহারে।
সমভাবে বাস কর সম ব্যবহারে।।
ভাই ভাই বিরোধ নাহিক প্রয়োজন।
কুলক্ষয় হবে আর কুযশ ঘোষণ।।
এইমত দ্রোণ কৃপ বিদ্যুর সহিত।
বিধিমতে দুর্য্যোধনে বুঝাইল নীত।।
কার বাক্য না শুনিল কুরুকুলপতি।
অদৃষ্ট মানিয়া গেল যে যার বসতি।।
মহাভারতের কথা অমৃত সমান।
কাশীরাম দাস কহে শুনে পুণ্যবান।।