৩৪. দ্রোণাচার্য্যের মৃত্যু

মুনি বলে মহাশয়,           শুন ওহে জন্মেজয়,
হেন মতে পড়ে ভগদত্ত।
দেখি রাজা দুর্য্যোধন,           শোকেতে আকুলম
আরোহণ কৈল গজমত্ত।।
অশ্বথামা নামে হস্তী,           তার তুল্য অন্য নাহি
এমন উত্তম গজবর।
বর্ণে যিনি জলধর,           ঈষাদন্ত সম শয্যা
দেখিতে বড়ই ভয়ঙ্কর।।
তাহে আরোহণ করি,           আসে কুরু অধিকারী
যথা আছে বীর বৃকোদর।
হাতে গদা ঘোরতর,           দুর্য্যোধন ‍নৃপবর
ভীমসেন করিতে সমর।।
দেখি রায় বৃকোদর,           হাতে গদা ভয়ঙ্কর
শমন সমান মহাবীর।
মহাকোপে অঙ্গ কাঁপে,           দশনে অধর চাপে
বজ্র সম কঠিন শরীর।।
গদা যেন কাল দণ্ড,           সৈন্য করে লণ্ড ভণ্ড
এক ঘায়ে মারে শত শত।
হস্তী অশ্ব পড়ে যত,           লিখিতে না পারি তক্ত
শত শত চূর্ণ করে রথ।।
আনন্দিত বৃকোদর,           যুদ্ধ করে ঘোরত
বায়ুবেগে ধায় মহাবীর।
কোপে ভয়ঙ্কর তনু,           মূর্ত্তি যেন বৃহদান্ত
দেখি আনন্দিত যুধিষ্ঠির।।
হেনকালে দুর্য্যোধন, করিবরে আরোহন
গদা লয়ে ধায় মহাবীর।
দেখি যত যোদ্ধাগণ,           সবে সশঙ্কিত মন
সংগ্রাম হইল ঘোরতর।।
তবে কোপে বায়ুসুত,           হয়ে যেন যমদূত
গদাতে ভাঙ্গিল তার মুণ্ড।
বজ্রাঘাতে যেন গিরি,           সেইমত পড়ে কবে
মস্তক হইল খণ্ড খণ্ড।।
ভয়েতে কম্পিত মন,           একলাফে দুর্য্যোধন
হস্তী এড়ি পড়িল ধরণী।
গদা লয়ে দুই করে,           প্রহারিল বৃকোদরে,
বজ্রাঘাত যেন শব্দ শুনি।।
গদাঘাতে বৃকোদর,           ক্রোধে কম্পে থর থর,
ধরিলেন গদা দৃঢ়মুষ্টি।
ভানুবর্ণ জিনি মূর্ত্তি,           যুগান্তরে সমবর্ত্তী,
সংহার করিতে যেন সৃষ্টি।।
অতি কোপে বৃকোদর,           মারে গদা খরতর,
দুর্য্যোধন রাজার উপর।
গদাঘাতে দুর্য্যোধন,           অঙ্গ কাঁপে ঘনে ঘন,
পলাইল ত্যজিয়া সমর।।
দুর্য্যোধন ভঙ্গ দেখি,           ভীমসেন হয়ে সুখী,
সংহারিল বহু সৈন্যগণ।
সৈন্য কেহ নহে স্থির,           দেখি কাঁপে দ্রোণবীর,
দ্রুতগতি এলেন তখন।।
আকর্ণ পূরিয়া দ্রোণ,           এড়ি যত অস্ত্রগণ,
বিন্ধিলেন ভীমের হৃদয়।
মূর্চ্ছিত হইল বীর,           অঙ্গে বহিছে রুধির,
পলাইল পবন তনয়।।
পলাইল ভীমসেন,           দেখি আনন্দিত দ্রোণ,
বাণবৃষ্টি করে মহাবীর।
শত শত সৈন্য পড়ে,           কদলী যেমন ঝড়ে,
যোদ্ধাগণ হইল অস্থির।।
তবে কোপে ধনঞ্জয়,           দেখি সৈন্য অপচয়,
দ্রুত আসে দ্রোণের সম্মূখে।
ক্রোধে করে বাণবৃষ্টি,           যেন সংহারিতে সৃষ্টি,
দিব্য অস্ত্র ফেলে লাখে লাখে।।
অর্জ্জুনের দশ বাণ,           দ্রোণচার্য্য বলবান,
মরিলেক সমর ভিতরে।
দেখাইয়া দ্রোণের বাণ,           পার্থবীর হতজ্ঞান,
পড়িলেক রথের উপরে।।
অর্জ্জুনে বিমুখ করি,           দ্রোণাচার্য্য গেল ফিরি,
সেনাগণে করিতে বিনাশ।
দারুণ দ্রোণের বাণ,           স্থির নহে ‍কোন জন,
যুধিষ্ঠির গণেন হুতাশ।।
যেই বীর রণবেশে,           দ্রোণের সম্মূখে আসে,
তারে দ্রাণ করয়ে সংহার।
যেন যুগান্তের যম,           দেখি দ্রোণ নিরুপম,
পাণ্ডবের নাহিক নিস্তার।।
দেখি কৃষ্ণ সেনা নাশ,           কহেন মধুর ভাষ,
শুন দ্রোণ আমার বচন।
অশ্বথামা পুত্র তব,           আজি হয়ে পরাভব,
ভীম হস্তে হইল নিধন।।
শুনি দ্রোণাচার্য্য বীর,           হইলেন যে অস্থির,
মনেতে হইল বড় ত্রাস।
অশ্বথামা জন্ম যবে,           শূণ্যবাণী হৈল তবে,
চিরজীবী কহিলেন ব্যাস।।
সুমেরু ভাঙ্গিয়া পড়ে,           চন্দ্রসূর্য্য স্থান ছাড়ে,
তবু মিথ্যা নাহি কহেমুনি।
অসম্ভব কথা হেন,           কহিলেন নারায়ণ,
এ কথা বিস্ময় বড় মানি।।
এত ভাবি কহে দ্রোণ,           শুন প্রভু নারায়ণ,
তব মায়া বুঝিতে না পারি।
পূর্ব্বে ব্যাস দিল বর,           চারিযুগে সে অমর,
এবে কেন হেন কহ হরি।।
পুনঃ কন দামোদর,           বিনাশিল বৃকোদর,
হয় নয় বুঝ ভীমস্থানে।
মিথ্যা নাহি কহি আমি,           নিশ্চয়জানিহ তুমি.
অশ্বথামা পড়িয়াছে রণে।।
এত শুনি দ্রোণাচার্য্য,           পুত্রশোকে হীনধৈর্য্য,
পুনরপি কহিল তখন।
তবে আমি সত্য মানি,           যদি কহে নৃপমণি,
যুধিষ্ঠির ধর্ম্মের নন্দন।।
তবে প্রভু নারায়ণ,           কলিলেন সেইক্ষণ,
যুধিষ্ঠিরে ডাকি নিজ পাশ।
অশ্বথামা হত বাণী,           দ্রোণে কহ নৃপমণি,
দ্রোণ যেন জানে সত্যভাষ।।
শুনিয়া কৃষ্ণের বাণী,           কহিলেন পাণ্ডব মণি,
কিরূপে কহিব মিথ্যাবাণী।
আমাতে বিশ্বাস করি,           দ্রোণ জিজ্ঞাসিবে হরি,
মম বাক্য সত্য হেন জানি।।
কেমনে কহিব মিথ্যা,           যুক্তি নহে এই কথা,
যদি মম হয় সর্ব্বনাশ।
বিশ্বাসঘাতিতা করি,           কিমতে কহিব হরি,
মহাপাপ নাশিলে বিশ্বাস।।
পুনরপি নারায়ণ,           করিছেন বিজ্ঞাপন,
প্রকার করিয়া কহ দ্রোণে।
অশ্বথামা হতবাণী,           আমি তাহা সত্য জানি,
ইতি গজ পড়িয়াছে রণে।।
পুনঃ কন ‍যুধিষ্ঠির,           শুন শুন যদুবীর,
তথাপিও অধর্ম্ম বিস্তর।
মিথ্যা যদি কহি আমি,           হইব নরকগামী,
উদ্ধারের বলহ উত্তর।।
এত শুনি বৃকোদর,           ক্রোধে কম্পে কলেবর,
কহিতে লাগিল সেইক্ষণ।
হইয়া পাণ্ডব স্বামী,           সকল নাশিলে তুমি,
তব সত্য না জানি কেমন।।
অধর্ম্ম করিলে যদি,           হয় লোক অধোগতি,
কি করিল রাজা দুর্য্যোধন।
অভিমন্যু গেল রণে,           বেড়ি সপ্ত যোদ্ধাগণে
একা শিশু করিল নিধন।।
সত্যবাদী সদা ধর্ম্ম,           তুমি কি করিলা কর্ম্ম,
নাশিলা সকল রাজ্যধন।
আমার বচন শুনি,           কহ তুমি নৃপমণি,
এই কথা স্বরূপ বচন।।
মোরে যদি পুছে দ্রোণ,           কহি আমি পুনঃ পুনঃ,
কহি পুনঃ এক শত বার।
ইহা বলি বৃকোদর,           কহিলেন দৃঢ়তর,
অশ্বথামা হত সারোদ্ধার।।
শুন দ্রোণ কহি সার,           সমরেতে আজিকার,
মম হস্তে অশ্বথামা হত।
জানাই স্বরূপ আমি,           নিশ্চয় জানহ তুমি,
এই কথা নহে অন্য মত।।
এত শুনি কহে দ্রোণ,           প্রত্যয় না হয় মন,
তোমার বচনে বৃকোদর।
হত যদি মম সুত,           কহে ধর্ম্ম সুচরিত,
নিজমুখে ধর্ম্ম নৃপবর।।
শুনিয়া ত নারায়ণ,           কুপিত হইল মন,
কহিলেন রাজা যুধিষ্ঠিরে।
কহ তুমি নৃপমণি,           এই কথা সত্যবাণী,
তবে যদি বধিবে দ্রোণেরে।।
তাহা শুনি ধর্ম্মসুত,           হইয়া বিষাদযুত,
কহিলেন দ্রোণের গোচর।
অশ্বথামা হৈল নাশ,           ইতি গজ সত্যভাষ,
জানহ স্বরূপ ও উত্তর।
পুনরপি কহে দ্রোণ,           সত্য কহ হে রাজন,
অশ্বথামা হইল বিনাশ।
কহেন ধর্ম্মের সুত,           অশ্বথামা হৈল হত,
ইতি গজ সত্য এই ভাষ।।
দ্রোণ পুছে যতবার,           কহিছেন ততবার,
যুধিষ্ঠির সে মত উত্তর।
লঘুস্বরে নৃপমণি,           কহে ইতি গজবাণী,
পুনঃ পুনঃ দ্রোণের গোচর।।
যুধিষ্ঠির মুখে শুনি,           সত্য হেন দ্রোণ জানি,
পুত্রশোকে হইল আকুল।
ধনু ধরি বামকরে,           কান্দে দ্রোণ উচ্চৈঃস্বরে,
লোহে ভিজে অঙ্গের দুকূল।।
পুত্রের শোকেতে দ্রোণ,           হইলেন অচেতন,
চেতন হারান দ্বিজবর।
কণ্ঠতলে ধনু রাখি,           কান্দে দ্রোণ হয়ে দুঃখী
অশ্রু পড়ে গুণের উপর।।
হেনকালে রমাপতি,           বলিলেন পার্থ প্রতি,
দেখ দেখ বীর ধনঞ্জয়।
কালসর্পদংশে দ্রোণে,           ঝাটকাটি পাড় বাণে,
এইকালে কুন্তীর তনয়।।
তবে পার্থ বীরবর,           অস্ত্র মারি দৃঢ়তর,
সর্প বলি কাটে ধনুগুণ।
কণ্ঠতলে বিন্ধি ধনু,           অস্থির হইল তনু,
রথেতে পড়িয়া গেল দ্রোণ।
হেনকালে ধৃষ্টদ্যুন্ন,           রথে পড়ে দেখি দ্রোণ,
খড়গ লয়ে ধাইল সত্বর।
যেন ধায় মৃগপতি,           তেন ধায় দ্রুতগতি,
উঠে গিয়া রথের উপর।।
কাটিল দ্রোণের শির,           দেখে যত কুরুবীর,
হাহাকার করে সর্ব্বজন।
লইয়া দ্রোণের শীর,           ধৃষ্টদ্যুন্ন মহাবীর,
নিজ রথে আইল তখন।।
দ্রোণের নিধন দেখি,           দুর্য্যোধন হয়ে দুঃখী,
বিলাপ করয়ে বহুতর।
হাহাকার শব্দ করি,           কান্দে কুরু অধিকারী,
পড়িলেন ধরণী উপর।।
ব্যাস বিরচিত গাথা,           অপূর্ব্ব ভারত কথা,
শ্রবণেতে কলুষনাশন।
যজ্ঞ ব্রত হোম দান,           নহে ইহার সমান,
মুক্ত হয় শুনে যেই জন।।
গোবিন্দের গুণকর্ম্ম,           শ্রবণে বাড়য়ে ধর্ম্ম,
ইহা বিনা সুখ নাহি আর।
রক্তপদ কোকনদ,           ভক্তজন সিদ্ধপদ,
অখিলের আপদ সংহার।।
নানারূপে অবতরি,           দৈত্যগণে ক্ষয় করি,
পাতকির পরিত্রাণ হেতু।
এ ঘোর সাগরমাঝে,           উদ্ধারিতে দেবরাজে,
নিজ নামে বান্ধি দিলা সেতু।।
অভয় চরণে মম,           ভক্তি রহে ত্রিবিক্রম,
এই মাত্র করি নিবেদন।
সংসারসাগর ঘোরে,           উদ্ধার করিবে মোরে,
কাশীরাম দাস বিরচন।।