৩৩. বৈষ্ণবাস্ত্রের উপাখ্যান ও ভগদত্ত বধ

অর্জ্জুন বলেন, কৃষ্ণ কর অবধান।
হের দেখ ভগদত্ত অনল সমান।।
সৈন্যগণ ক্ষয় মম করিল বিস্তর।
অতএব রথ তুমি চালাও সত্বর।।
আজি আমি রণে তারে করিব নিধন।
নিশ্চয় প্রতিজ্ঞা মম শুন নারায়ণ।।
এত শুনি শ্রীগোবিন্দ হয়ে আনন্দিত।
ভগদত্ত বধে রথ চালান ত্বরিত।।
বায়ুবেগে চলে রথ পবন সমান।
ভগদত্ত সম্মূখে আইল সেইক্ষণ।।
অর্জ্জুনে দেখিয়া ধায় ভগদত্তবীর।
বাণবৃষ্টি করে যেন মেঘে ফেলে নীর।।
তর্জ্জন করিয়া বলে অর্জ্জুনের প্রতি।
আজি যুদ্ধ কর পার্থ আমার সংহতি।।
অবশ্য করিব আজি তোমাকে সংহার।
নিতান্ত প্রতিজ্ঞা এই জানিবে আমার।।

এত শুনি কোপবন্ত ‍পার্থ ধনুর্দ্ধর।
ডাকিয়া বলেন গর্ব্ব ত্যজহ বর্ব্বর।।
কোন কর্ম্ম করি তোর এত অহঙ্কার।
আমার অগ্রেতে হেন প্রতিজ্ঞা তোমার।।
এইক্ষণে সাক্ষাতে দেখিবে যোদ্ধাগণ।
অবশ্য পাঠাব তোরে যমের সদন।।
অর্জ্জুনের কটুবাক্য শুনি ভগদত্ত।
মহাকোপে চালাইয়া দিল গজমত্ত।।
বায়ুবেগে হস্তী পড়ে রথের উপর।
দেখিয়া চিন্তিত হইলেন দামোদর।।
তথা হৈতে রথ রাখিলেন একভিত।
রাজা যুধিষ্ঠির হইলেন আনন্দিত।।
পুনরপি দুইজনে হইল সমর।
তীক্ষ্ম অস্ত্র এড়ে দোঁহে দোঁহার উপর।।
কোপে ভগদত্ত বীর পূরিল সন্ধান।
অর্জ্জুনের প্রহারিল চোখ চোখ বাণ।।
তবে ধনঞ্জয় বীর পূরিয়া সন্ধান।
ভগদত্ত বাণ করিলেন খান খান।।
কাটেন সকল অস্ত্র পার্থ কুতূহলে।
নারাচ মারিল বীর করি কুম্ভস্থলে।।
দারুণ প্রহারে করী বিকল হইল।
বজ্রাঘাতে যেন গিরিশৃঙ্গ বিদারিল।।
হস্তী যদি পড়িল দেখিল ভগদত্ত।
হেনকালে সারথি যোগায় এক রথ।।
ষাটি ষাটি হস্তী সেই রথখান বহে।
বিস্ময় মানিয়া সর্ব্ব যোদ্ধাগণ চাহে।।
হেন রথে ভগদত্ত চড়ি সেইক্ষণ।
অতি কোপে করিলেন বাণ বরিষণ।।
যত বাণ এড়ে বীর পূরিয়া সন্ধান।
নিমিষে করেন পার্থ তাহা খান খান।।
বাণ ব্যর্থ দেখি তবে ভগদত্ত বীর।
অর্জ্জুন উপরে মারে চৌষট্টি তোমর।।
অন্ধকার করি পড়ে অর্জ্জুন উপর।
নিবারিতে না পারেন পার্থ ধনুর্দ্ধর।।
বাণাঘাতে হইলেন অর্জ্জুন অস্থির।
ধরতর স্রোতে বহে অঙ্গের রুধির।।
অচেতন হইলেন রথের উপর।
ক্রোধ করি তখন কহিল দামোদর।।
কি হেতু অশক্ত তোমা দেখি আজি রণে।
অন্য মন কর তুমি কিসের কারণে।।
প্রতিজ্ঞা করিলে ভগদত্ত মারিবারে।
তবে কেন অচেতন হৈলা একেবারে।।
তগদত্তে ক্ষয় কর এড়ি দিব্য বাণ।
আকর্ণ পূরিয়া তুমি করহ সন্ধান।।
আশা পেয়ে হাসে দেখ দুষ্ট দুর্য্যোধন।
দেখ কুরুকুল সব প্রফুল্ল বদন।।

কৃষ্ণের বচনে ‍পার্থ লজ্জিত হইয়া।
দিব্য অস্ত্র যুড়িলেন ধনু টঙ্কারিয়া।।
গগন ছাইয়া বান এড়েন তখন।
মুষল ধারাতে যেন বর্ষে নবঘন।।
অস্ত্র বিনা সৈন্যমধ্যে নাহি দেখি আর।
দিবসে হইল যেন ঘোর অন্ধকার।।
শীঘ্রগতি ভগদত্ত পূরিয়া সন্ধান।
নিমিষেকে নিবারিল অর্জ্জুনের বাণ।।
তবে কোপে ভগদত্ত কহে অর্জ্জুনেরে।
এই অস্ত্রে ধনঞ্জয় বিনাশিব তোরে।।
দেখিব কেমনে অস্ত্র কর নিবারণ।
এত বলি ভগদত্ত করয়ে তর্জ্জন।।
বৈষ্ণব নামেতে বাণ বসাইল চাপে।
অস্ত্র দেখি দেবগণ ইন্দ্র আদি কাঁপে।।
সন্ধান পূরিয়া বীর এড়িলেক বাণ।
চলিল বৈষ্ণব অস্ত্র অনল সমান।।
দেখিয়া বৈষ্ণব বাণ দেব নারায়ণ।
চিন্তান্বিত হইলেন অর্জ্জুন কারণ।।
অর্জ্জুনের পশ্চাৎ করি দেব নারায়ণ।
বুক পাতি আপনি দিলেন সেইক্ষণ।।
কৃষ্ণের শরীরে আসি লিপ্ত হৈল বাণ।
দেখি যত যোদ্ধাগণ হৈল কম্পমান।।

এতেক দেখিয়া পার্থ লজ্জিত বদন।
কৃতাঞ্জলি করিয়া করেন নিবেদন।।
অর্জ্জুন বলেন দেব কর অবধান।
কি কারণে হৃদয়ে ধরিলা তুমি বাণ।।
কোন্ কাজে ন্যূন তুমি দেখিলা কখন।
এবে অস্ত্র ধর তুমি কিসের কারণ।।
শ্রীকৃষ্ণ বলেন সখে কহিলা প্রমাণ।
তোমা হৈতে নিবারণ নহে এই বাণ।।
বৈষ্ণব অস্ত্রের তুমি না জান মহিমা।
মহাতেজোময় অস্ত্র নাহি তার সীমা।।
অর্জ্জুন বলেন কৃষ্ণ কহিবা আমারে।
হেনমতে অস্ত্র কেবা দিলেক উহারে।।
নিবারণ নহে অস্ত্র কিসের কারণ।
ইহার বৃত্তান্ত মোরে কহ নারায়ণ।।

শ্রীকৃষ্ণ বলেন, পার্থ কহি তব স্থান।
চারি মূর্ত্তি মম তুমি জানহ প্রমাণ।।
এক মূর্ত্তি তপস্যা করেন অনুক্ষণ।
আর মূর্ত্তি ত্রিভুবন করয়ে পালন।।
আর মূর্ত্তি ধরি সৃষ্টি করি যে সৃজন।
অন্তরূপে এক মূর্ত্তি সংসার কারণ।।
নরক পাইল অস্ত্র আমার সদনে।
তাহা হতে পায় পৃথ্বী, সে দিল নন্দনে।।
পৃথিবীর পুত্র ভগদত্ত মহারাজা।
অস্ত্রে শস্ত্রে বিচক্ষণ বলে মহাতেজা।।
এই অস্ত্র প্রতাপে জিনিল ভূমণ্ডল।
ভগদত্ত সহ সখ্য কৈল আখণ্ডল।।
কদাচিৎ ব্যর্থ যদি যম চক্র হয়।
অব্যর্থ বৈষ্ণব বাণ কভু ব্যর্থ নয়।।

এতেক শুনিয়া পার্থ লর্জ্জিত অন্তর।
পুনরপি পার্থকে কহিল গদাধর।।
এড়িল বৈষ্ণব অস্ত্র ভগদত্ত বীর।
এইকালে ঝটিতি কাটহ তার শির।।
তব ভাগ্যে রাজা বাণ করিল ক্ষেপণ।
বিনা ক্লেশে বধ তারে করহ এখন।।
আছিল বাণের তেজে বিষ্ণুর সমান।
সমরে হইত, কার শক্তি আগুয়ান।।
এবে কিন্তু চিন্তা নাহি কর ধনঞ্জয়।
এক্ষণে হইবে জয় জানিহ নিশ্চয়।।

এত শুনি ধনঞ্জয় হরষিত মন।
সন্ধান পূরিয়া এড়িলেন অস্ত্রগণ।।
কোপে ধনঞ্জয় বীর এড়ি পঞ্চবাণ।
ভগদত্ত ধনুক করেন খান খান।।
আর ধনু ধরি ভগদত্ত করে রণ।
সেই ধনু ধনঞ্জয় কাটেন তখন।।
পুনঃ পুনঃ ভগদত্ত যত ধনু লয়।
ক্রমে সব কাটিলেন বীর ধনঞ্জয়।।
কোপে ভগদত্ত বীর শক্তি নিল হাতে।
ফেলিয়া মারিল শক্তি অর্জ্জুনের মাথে।।
ধনু টঙ্কারিয়া পার্থ মারিলেন বাণ।
কাটিলেন তার শক্তি হেন শক্তিমান।।
অর্দ্ধচন্দ্র এড়ি বীর পূরিয়া সন্ধান।
ভগদত্তে মারিলেন কুলিশ সমান।।
দুইখান হয়ে পড়ে রথের উপর।
এক ঘায় ভগদত্ত গেল যমঘর।।
রণেতে পড়িল ভগদত্ত মহাবীর।
দেখি দুর্য্যোধন রাজা হইল অস্থির।।
ভগদত্ত রথ লয়ে সারথি সত্বর।
ভ্রমণ করিয়া বুলে সংগ্রাম ভিতর।।
শত শত সেনা পড়ে রথের চাপনে।
হেন বীর নাহি নিবারয়ে রথখানে।।
দেখি কোপে ধায় বীর পবননন্দন।
সাবধানে সাপুটিয়া ধরে রথখান।।
বায়ুবেগে বৃকোদর ফেলে রথখান।
দেখিয়া কৌরব দল হৈল কম্পমান।।
দ্রোণপর্ব্ব পুণ্যকথা ভগদত্ত বধে।
কাশীরাম দাস কহে গোবিন্দের পদে।।