৩১. কর্ণের নিকট হইতে ছলে ইন্দ্রের কবচ গ্রহণ বৃত্তান্ত

মুনি বলে শুন পরীক্ষিতের নন্দন।
হেনমতে ঘটোৎকচ হইল নিধন।।
পুত্রহত দেখি ভীম করয়ে রোদন।
হাতে গদা করি ধায় মহারুষ্ট মন।।
সৃষ্টি নাশ হেতু যেন দীপ্তিমান চণ্ড।
সেইমত করে বীর সৈন্য লণ্ড ভণ্ড।।
শত শত হস্তী পড়ে গদার প্রহারে।
নিমিষেকে পদাতিক দিল যমঘরে।।
ভীমকে দেখিয়া কাল শমন সমান।
ভয়েতে পলায় সবে লইয়া পরাণ।।
সমস্ত রজনী যুদ্ধ করি সৈন্যগণ।
গদাঘাতে খণ্ড খণ্ড হৈল সর্ব্বজন।।
ক্ষুধায় তৃষ্ণায় অবসন্ন কলেবর।
রথীগণ সেনাগণ নিদ্রায় কাতর।।
দুর্য্যোধন ভয়ে কেহ না পারে যাইতে।
হাতে অস্ত্র করি রথী পড়ি যায় রথে।।

এতেক দেখিয়া তবে বীর ধনঞ্জয়।
সৈন্যের দুর্গতি দেখি তাপিত হৃদয়।।
ডাকিয়া বলেন পার্থ শুনহ বচন।
আজিকার মত যুদ্ধ কর নিবারণ।।
ক্ষুধায় তৃষ্ণায় সবে হইল পীড়িত।
এত শুনি সর্ব্বজন হৈল আনন্দিত।।
ধন্য ধন্য বলি পার্থে বলেন বচন।
মহাধর্ম্মশীল তুমি ইন্দ্রের নন্দন।।
দয়াশীল ধর্ম্মশীল তুমি মহাশয়।
অচিরে হইবে ‍পার্থ তোমার বিজয়।।

এত বলি আনন্দিত হৈল সেনাগণ।
নিদ্রাযুক্ত হয়ে সবে পড়ে সেইক্ষণ।।
রণস্থলে পড়িলেন হইয়া কাতর।
রথিগণ পড়ে গেল রথের উপর।।
গজেতে মাহুত পড়ে অশ্বে আসোয়ার।
ভূমিতলে পড়ে সৈন্য শবের আকার।।
রাজগণ পথে পড়ে মৃতপ্রায় হৈয়া।
রতন মুকুট সব পড়িল খসিয়া।।
কন্দর্প সমান রূপ কোমল শরীর।
রূপবন্ত বলবন্ত সবে মহাবীর।।
বিনা খাট পালঙ্ক সুনিন্দ্রা নাহি হয়।
রাজচক্রবর্ত্তী সবে রাজার তনয়।।
সুবর্ণ প্রদীপ জ্বলে রত্নগৃহ মাঝে।
কুসুম শয্যায় নিদ্রা যায় মহারাজে।।
মনোহর নারীগণ করয়ে সেবন।
এমন করিলে নিদ্রা যায় কদাচন।।
হেন সব ‍রাজপুত্র নবীন যৌবন।
রণস্থলে নিদ্রা যায় হয়ে অচেন।।
সৈন্যের শোণিত সব হইল কর্দ্দম।
হেনমতে রণস্থল দেখি হয় ভ্রম।।
শিবাগণ চতুর্দ্দিকে বিপরীত ডাকে।
প্রেত ভূত পিশাচ আইল ঝাঁকে ঝাঁকে।।
দুর্গন্ধ কারণে লোক পথ নাহি চলে।
দেবগণ ভয় করে সেই রণস্থলে।।
নিদ্রা যায় রাজগণ হয়ে অচেতন।
শবের উপরে সবে করিল শয়ন।।

এতেক দেখিয়া পার্থ কুন্তীর নন্দন।
দুর্য্যোধন নিন্দা করি বলিছে বচন।।
ধিক্ ধিক্ দুর্য্যোধন তোমার জীবনে।
এতেক দুর্গতি দুষ্ট কৈল জ্ঞাতিগণে।।
এতেক বলিয়া তবে ইন্দ্রের নন্দন।
শিবিরেতে চলিলেন লয়ে নারায়ণ।।
ঘটোৎকচ শোকে কান্দে বীর বৃকোদর।
বিলাপ করেন পার্থ অতি দুঃখকর।।
অভিমন্যু শোকে মম বিকল শরীর।
মহাশোক দিয়া গেল ঘটোৎকচ বীর।।
বলেন কৃষ্ণেরে চাহি বীর ধনঞ্জয়।
কি করিব আজ্ঞা কর যদুবীর।।

এমত শুনিয়া কহিছেন ভগবান।
বড় কর্ম্ম কৈল তবে ভীমের সন্তান।।
তাহার কারণে মৃত্যু নহিল তোমার।
শুনহ কহি যে তার পূর্ব্ব সমাচার।।

শ্রীকৃষ্ণ বলেন শুন অর্জ্জুন বৃত্তান্ত।
তোমার লাগিয়া সেই আসে শচীকান্ত।।
অক্ষয় কবচ ধরে কর্ণ মহাবীর।
শ্রবণে কুণ্ডল যুগ্ম সমান মিহির।।
কর্ণের সমান দাতা নাহি ত্রিভুবনে।
যে যাহা মাগয়ে তাহা দেয় সেইক্ষণে।।
তব হিত হেতু আসে সহস্রলোচন।
উত্তরিল ইন্দ্র যথা রবির নন্দন।।
দ্বিজরূপে যান ইন্দ্র কর্ণের নিকটে।
দ্বিজ দেখি কর্ণ প্রণমিল করপুটে।।
প্রণাম করিয়া কহে রবির তনয়।
কোন্ দেশে ঘরতব কহ মহাশয়।।
কিসের কারণে হেথা গমন তোমার।
বিবরিয়া কহ মোরে সব সমাচার।।

আশীর্ব্বাদ করি কহে সহস্রলোচন।
এক দান দেহ মোরে সূর্য্যের নন্দন।।
এত শুনি কর্ণ বলে কহ দ্বিজবর।
কোন্ দ্রব্যে অভিলাষ মাগহ সত্বর।।
ইন্দ্র বলে সত্য আগে কর অনুর্দ্ধর।
তবে সে মাগিব আমি তোমার গোচর।।
এতেক শুনিয়া কর্ণ ভাবে মনে মন।
নাহি জানি দ্বিজরূপে আসে কোন্জন।।
যে হোক সে হোক মম সত্য অঙ্গীকার।
যেই যাহা মাগে দিব প্রতিজ্ঞা আমার।।
এত চিন্তি কহে কর্ণ শুন দ্বিজবর।
দিব ত সর্ব্বথা আমি কহিনু সত্বর।।
জানহ আমার এই সত্য অঙ্গীকার।
যদি প্রাণ চাহ দিব না করি বিচার।।
এত শুনি কহিলেন কর্ণের গোচর।
কবচ কুণ্ডল দান করহ সত্বর।।
বিস্মিত হইয়া কর্ণ ভাবে মনে মন।
হেনকালে সূর্য্যবাক্য হইল স্মরণ।।
যোড়হাতে কর্ণ বলে করি নিবেদন।
জানিনু আপনি তুমি সহস্রলোচন।।
অর্জ্জুনের হেতু তুমি আসিয়াছ হেথা।
কুণ্ডল কবচ দিব কত বড় কথা।।
প্রাণ যদি চাহ তবু না করিব আন।
এত বলি কর্ণবীর করিল প্রণাম।।
পুনরপি কর্ণ বলে শুন মহাশয়।
অর্জ্জুনের হেতু ‍তুমি কেন কর ভয়।।
অর্জ্জুনের সখা কৃষ্ণ কমললোচন।
তাহারে মারিবে হেন আছে কোনজন।।
আমারে মারিবে পার্থ না যায় খণ্ডন।
কুরুক্ষেত্রে যখন হইবে মহারণ।।
এত বলি কর্ণ বীর হাতে খড়গ লৈয়া।
অঙ্গ কাটিয়া কবচ দিল সে খুলিয়া।।

কর্ণের সাহস দেখি দেব পুরন্দর।
তুষ্ট হয়ে বলিলেন মাগি লহ বর।।
কর্ণ বলে বর যদি দিবে মেঘবান।
একঘাতী অস্ত্র দেব মোরে কর দান।।
কর্ণেরে একাঘ্নী অস্ত্র দিয়া পুরন্দর।
কবচ কুণ্ডল লয়ে গেল নিজ ঘর।।
বজ্র সম বাণ সেই নহে নিবারণ।
যাহারে প্রহারে তার অবশ্য মরণ।।
তোমারে মারিতে কর্ণ রাখিল যতনে।
বহুদিন গুপ্ত রাখে কেহ নাহি জানে।।
ঘটোৎকচ হস্তে দেখি সকল সংহার।
অতএব কর্ণ তারে করিল প্রহার।।
ঘটোৎকচ হেতু মৃত্যু নহিল তোমার।
নিশ্চয় জানহ এই কুন্তীর কুমার।।
অতএব শোক না করিহ ধনঞ্জয়।
আপনার বীর্য্য জানি শত্রু কর ক্ষয়।।

কৃষ্ণের বচনে সবে হরষিত মন।
শিবিরেতে গিয়া সবে করিল শয়ন।।
মহাভারতের কথা অপূর্ব্ব কাহিনী।
সংসার সাগর ঘোর তরিতে তরণী।।
অবহেলে যেই জন শুনে মন দিয়া।
অন্তকালে স্বর্গে যায় চতুর্ভুজ হৈয়া।।
কাশীরাম দাস প্রণামে সাধুজনে।
দৃঢ় করি ভজ ভাই গোবিন্দ চরণে।।