২৪. জয়দ্রথ বধ

জন্মেজয় কহে, মুনি কহ অতঃপরে।
কেমনে অর্জ্জুন জয়দ্রথেরে সংহারে।।
মুনি কন, শুন পরীক্ষিতের নন্দন।
ভীমের লাঞ্ছনা হেন করি নিরীক্ষণ।।
পার্থ প্রতি চাহি কৃষ্ণ কহেন তখন।
হের সখা ভীম সহ কর্ণ করে রণ।।
মহাদম্ভে কর্ণ কৈল ভীমে পরাজয়।
বাণ বিন্ধি করিলেক ভীমের সংশয়।।
আজি বৃকোদর যত পায় অপমান।
উপহাস করে কর্ণ দেখ বিদ্যমান।।
দেখি ধনঞ্জয় হৈল বিষন্ন বদন।
ভীম গিয়া নিজ রথে চড়িল তখন।।
মহাক্রোধে ধনঞ্জয় পূরিয়া সন্ধান।
হয় রথ পদাতিরে করে খান খান।।
হেনমতে একাদশ ক্রোশ গেল রথ।
আর এক ক্রোশ মধ্যে আছে জয়দ্রথ।।
চারি দণ্ড বেলামাত্র আছয়ে গগনে।
দেখিয়া হইল চিন্তা প্রভু নারায়ণে।।
শ্রীকৃষ্ণ বলেন, পার্থ চল শীঘ্রগতি।
চারি দণ্ড আছে মাত্র দিনকর স্থিতি।।
এক ক্রোশ পথ যেতে হইবেক আর।
হেথায় সংগ্রাম কর না বুঝি বিচার।।

অর্জ্জুন বলেন, কৃষ্ণ করি নিবেদন।
সৈন্যমধ্যে নাহি দেখি সিন্ধুর নন্দন।।
ইহার উপায় কৃষ্ণ কহ মম স্থানে।
কিমতে করিব বধ সিন্ধুর নন্দনে।।
শ্রীকৃষ্ণ বলেন, চিন্তা নাহিক তোমার।
আজি জয়দ্রথ হবে অবশ্য সংহার।।
এত বলি শ্রীকৃষ্ণ চালান অশ্বগণ।
সিংহনাদ করি যান ইন্দ্রের নন্দন।।
নিকটেতে দেখি তবে অর্জ্জুনের রথ।
মহাভয়ে লুকাইল রাজা জয়দ্রথ।।
জয়দ্রথে না দেখিয়া কৃষ্ণ মহাশয়।
অতিশয় হইলেন চিন্তিত হৃদয়।।
জয়দ্রথ লুকাইল জানি নারায়ণ।
ভাবেন, কেমনে তার পাই দরশন।।
ভাবিয়া ভুবনপতি কন অর্জ্জুনেরে।
বিপত্তি হইল বড় লইয়া তোমারে।।
পলায়িত জনে লভিবারে বড় দায়।
ভাবিয়া না পাই কিছু ইহার উপায়।।
না ভাবি প্রতিজ্ঞা পার্থ অগেরে কৈলে দড়।
পড়িল সংশয় তোমা লয়ে দেখি বড়।।
দিবা আছে চারিদণ্ড, অবহেলে যাবে।
ইহার উপায় তবে কেমনে হইবে।।

অর্জ্জুন অঞ্জলি করি কন কৃষ্ণ আগে।
একান্ত তোমারে পাণ্ডবের ভার লাগে।।
যে কর সে কর কৃষ্ণ তোমা বিনা নাই।
পাণ্ডবের প্রভু বলি সংসারে বড়াই।।
সেবক পালক তুমি সংসারের সার।
সেবকে রক্ষিতে প্রভু তুমি অবতার।।
তুমি বর্ত্তমানে হয় পাণ্ডবের ক্ষতি।
জগতে তোমার নিন্দা হইবে সম্প্রতি।।
পাণ্ডবের রথে কৃষ্ণ সারথি আছিল।
তথাপি পাণ্ডবগণ সমরে হারিল।।
এই নিন্দা অবনীতে হইবে তোমার।
এ কারণে চিন্তা কিছু নাহিক আমার।।
যাহা জান, তাহা কর, এ ভার তোমার।
অভিমন্যু-শোকে মন পুড়িছে আমার।।
তাহাতে নিধন ভাল, নিভায় অনল।
রহিয়াছে তব ভাষা শুনিয়া কেবল।।

পার্থের আক্ষেপ-বাক্য নারায়ণ শুনি।
সন্তুষ্ট হইয়া কহে দেব চক্রপাণি।।
কি ভয় আছয়ে ইথে, উপায় করিব।
জয়দ্রথের আজি সত্য নিধন সৃজিব।।
এত বলি সদুপায় চিন্তি নারায়ণ।
সুদর্শনে করিলেন সূর্য্য আচ্ছাদন।।
আচম্বিতে দেখে সবে হইল রজনী।
কুরুসেনাগণে হৈল জয় জয় ধ্বনি।।
অর্জ্জুন দেখিয়া চিত্তে মানিয়া বিস্ময়।
ত্রাস পেয়ে কৃষ্ণ প্রতি বলে সবিনয়।।
পার্থ বলিলেন, কহ কি করি বিধান।
কিরূপে হইবে আজি মম পরিত্রাণ।।
জয়দ্রথ-বধ হেতু প্রতিজ্ঞা হইল।
প্রতিজ্ঞা নহিল পূর্ণ, রজনী আসিল।।
প্রতিজ্ঞা লঙ্ঘন কৈলে যত পাপ হয়।
আপনি জানহ প্রভু অগোচর নয়।।

শ্রীকৃষ্ণ বলেন সখে নাহি কিছু ভয়।
প্রতিজ্ঞা পূরণ তব হইবে নিশ্চয়।।
এতেক কহিতে তথা করুবীরগণে।
অস্ত্র ধনু ত্যাগ করি আইল সেখানে।।
এখনি মরিবে পার্থ হেন করি মনে।
আনন্দিত দুর্য্যোধন সহাস্য বদনে।।

তবে জয়দ্রথ দেখি সন্ধ্যার সময়।
শীঘ্রগতি আসিয়া অর্জ্জুন প্রতি কয়।।
জয়দ্রথ বলে শুন বীর ধনঞ্জয়।
কি দেখ, হইল আসি সন্ধ্যার সময়।।
আপন প্রতিজ্ঞা পূর্ণ করহ এখন।
তব যশ ঘুষিবেক এ তিন ভুবন।।
অস্ত্র ধনু ত্যাগ করি যাহ ধনুর্দ্ধর।
শীঘ্রগতি প্রবেশহ অগ্নির ভিতর।।
মিছা মায়া মিছা কায়া জলবিম্ববত।
এ মহীমণ্ডল যাবে পড়িবে পর্ব্বত।।
যদি রিপু জিনি রাজ্য কর মহাশয়।
চিন্তিয়া দেখহ তাহা চিরকাল নয়।।
অধর্ম্ম করিয়া কর্ম্ম যে করে সাধন।
অতি শীঘ্র হয় তার সবংশে পতন।।
ধার্ম্মিক বলিয়া তোমা বলে সর্ব্বজনে।
করিলে প্রতিজ্ঞা তাহা লঙ্ঘিবে কেমনে।।

অর্জ্জুন উত্তর দেন শুন জয়দ্রথ।
তুমি যে কহিলে কথা রাখি ধর্ম্মপথ।।
ধর্ম্মেতে বিচার করি ধার্ম্মিকের সনে।
অধর্ম্মে জিনিতে দোষ নাহি দুষ্টজনে।।
অন্যায় সমর করি শিশু কৈলে হত।
কহ দেখি সে কর্ম্ম কেমন ধর্ম্মমত।।
এখনি বধিয়া তোমা আমিও মরিব।
পাইয়া পরম শত্রু ছাড়িয়া না দিব।।

শুনিয়া শুকায় মুখ জয়দ্রথ বীরে।
ভয় নাই আশ্বাসি কহেন পার্থ তারে।।
বিশ্বাসঘাতক তব রাজা সম নাহি।
কি করিব নিজ কর্ম্ম লব ধর্ম্ম বহি।।
শরীর ছাড়িব সত্য করিয়াছি পণ।
এত বলি আনিয়া জ্বালিল হুতাশন।।
কৃষ্ণ সাজায়েন কাষ্ঠ দিয়া গন্ধসারে।
সৌরভ সহিত গন্ধ উঠিল সত্বরে।।
শ্রীকৃষ্ণ বলেন শুন বীর ধনঞ্জয়।
বীরকর্ম্ম করিয়া বধিলা ক্ষত্রচয়।।
এখন নিরস্ত্র হয়ে মরিবে কেমনে।
অস্ত্র সহ প্রবেশহ জ্বলন্ত দহনে।।
কৃষ্ণবাক্য অভিপ্রায় বুঝিয়া অর্জ্জুন।
নিলেন গাণ্ডীব ধনু করিয়া সগুণ।।
সাতবার প্রদক্ষিণ করি হুতাশন।
প্রসন্ন কৃষ্ণের মুখ চান ঘনে ঘন।।
দুর্য্যোধন রাজার হৃদয়ে বড় সুখ।
মরিল প্রধান রিপু নাহি আর দুঃখ।।
মরিল প্রধান রিপু নাহি আর ‍দুঃখ।
হাস্যমুখে কহে আগে চাহিয়া অর্জ্জুনে।।
বিলম্বে বাড়িবে মায়া পুড়িতে আগুণে।
টান দিয়া ফেলাহ করের শরচাপ।।
চক্ষু বুব্জি দেহ শীঘ্র হুতাশনে ঝাঁপ।

অর্জ্জুন বলেন, এই ঝাঁপ দিয়া পড়ি।।
জয়দ্রথ লয়ে তুমি সুখে যাহ বাড়ী।
জয়দ্রথে দেখি কৃষ্ণ আনন্দিত মন।।
সেইক্ষণে ছাড়িলেন সূর্য্য আচ্ছাদন।
চারিদণ্ড বেলা আছে গগনমণ্ডলে।।
দেখিয়া হইল ত্রাস কৌরবের দলে।
কৌরব জানিল তবে নিতান্ত কপট।।
বিষম কৃষ্ণের মায়া বুঝিতে সঙ্কট।
শ্রীকৃষ্ণ বলেন সখে শুন সাবধানে।।
জয়দ্রথ বধিতে বিলম্ব আর কেনে।
কাটহ উহার মুণ্ড ভূমে না পাড়িবা।।
পশ্চাৎ সে সব কথা জানিতে পারিবা।
উহার জনক তপ কাম্যবনে করে।।
ফেলাইবা মুণ্ড তার হাতের উপরে।

বাণে বাণে মুণ্ড লয়ে ফেল তার হাতে।।
তবে সে হইবে রক্ষা জানিও ইহাতে।

এত শুনি ধনঞ্জয় পূরিয়া সন্ধান।।
জয়দ্রথ ললাটে মারেন এক বাণ।
শীঘ্রগতি মুণ্ড কাটি আর এক বাণে।।
বাণে বাণে লয় তার জনকের স্থানে।
সন্ধ্যা করে সিন্ধুরাজ দুই হাত কোলে।।
হেনকালে মুণ্ড তার হস্তে লয়ে ফেলে।
ত্রাস পেয়ে মুণ্ড গোটা ভূমিতে ফেলিল।।
সেইক্ষণে তার মুণ্ড খণ্ড খণ্ড হৈল।
হেনমতে সিন্ধুরাজ হইল নিধন।।
জয়দ্রথ সহ গেল যমের সদন।

অর্জ্জুন বলেন কৃষ্ণ কহিলা বিধান।।
কৃপা করি কহ জয়দ্রথ উপাখ্যান।
ভূমে মুণ্ড ফেলিলে সে মরে সেইক্ষণে।।
হেন বর কেবা দিল সিন্ধুর নন্দনে।
শ্রীকৃষ্ণ বলেন শুন বীর ধনঞ্জয়।।
জয়দ্রথ হয় সিন্ধুরাজের তনয়।
বহুকাল জয়দ্রথ সেবিল শঙ্করে।।
অনাহারে তপ করে অরণ্য ভিতরে।
নানা উপহার দিয়া সেবিল মহেশ।।
তৃষ্ট হয়ে বর তারে যাচেন বিশেষ।
বর মাগ জয়দ্রথ যেই মনোনীত।।
এত শুনি জয়দ্রথ হৈল আনন্দিত।
জয়দ্রথ বলে যদি মোরে দিবা বর।।
এক দিবেদন করি তোমার গোচর।
মম শির কাটি যেই ফেলিবে ধরণী।।
তার মুণ্ড খণ্ড খণ্ড হইবে তখনি।
শঙ্কর বলেন এই বর লহ তুমি।।
সে মরিবে তব মুণ্ড যে ফেলিবে ভূমি।
স্থির প্রণমিয়া বীর আনন্দিত মন।।
আপনার দেশে গেল সিন্ধুর নন্দন।
সে কারণে ধনঞ্জয় তোমা কহিলাম।।
তব রক্ষা হেতু এইরূপ করিলাম।
ভূমে মুণ্ড ফেলি তার জনক মরিল।।
নিশ্চয় জানিহ ইহা যেরূপ হইল।

এত শুনি ধনঞ্জয়ে লাগে চমৎকার।।
কৃষ্ণের চরণে করিলেন নমস্কার।
স্তুতি করিলেন পার্থ যোড় করি কর।।
এত নিবেদন করি শুন গদাধর।
তোমা বিনা গতি মম নাহি নারায়ণ।।
এমত বিপদে মোরে করিলে তারণ।
তোমার কারণে হয় প্রতিজ্ঞা পূরণ।।
তোমার প্রসাদে আমি দেখি বন্ধুজন।
তোমার কৃপায় জয় হইল সকল।।
তোমার ভরসা আমি করি হে কেবল।
শুন কৃষ্ণ তুমি মম হও বুদ্ধি বল।।
তোমার কারণে আমি পাইব সকল।
তোমার কারণে আমি কত দিন রব ক্ষিতি।।
তোমার কৃপায় করি ভোগ বসুমতী।
তোমার দয়ায় কৃষ্ণ করিব সমর।।
তোমার কৃপায় তরি সঙ্কট সাগর।
কাণ্ডারী করুণাময় তরাইতে সিন্ধু।।
অখিলের নাথ কৃষ্ণ অনাথের বন্ধু।
অগতির গতি তুমি দেব নারায়ণ।।
তোমার রাজীব পদে লইনু শরণ।
দীননাথ দয়াময় চাহ দীনজনে।।
সদা মন রহে যেন তোমার চরণে।

শ্রীকৃষ্ণ বলেন সখে তুমি বিচক্ষণ।।
চিনিলে আমারে তুমি ইন্দ্রের নন্দন।
তোমা হৈতে প্রিয় মম নাহিক সংসারে।।
নিশ্চয় জানিহ যে কহিলাম তোমারে।
তোমা পঞ্চজনে মম প্রীতি অতিশয়।।
অতএব তব কার্য্য করি ধনঞ্জয়।
কায়মনোবাক্যে যেই চিন্তয়ে আমারে।।
অনুক্ষণ তারে রাখি বিপদ সাগরে।
অনুক্ষণ নাম মোর লয় যেই জন।।
তাহার নাহিক ভয় যমের সদন।
জল ভেদি পদ্ম যেন উঠে ক্রমে ক্রমে।।
সেই মত মুক্ত আমি করি ভক্তগণে।
তুমি প্রিয়বন্ধু মম ইন্দ্রের নন্দন।।
অতএব তব কার্য্যে করি প্রাণপণ।
এত শুনি ধনঞ্জয় হয়ে পূর্ণকাম।।
গোবিন্দের পদে বীর করেন প্রণাম।
জয়দ্রথ বধ কথা অমৃত সমান।।
কাশীরাম দাস কহে শুনে পুণ্যবান।