২২. ভীম কর্ত্তৃক দুর্য্যোধনের পঞ্চাশ ভ্রাতার নিধন

মুনি বলে, শুন পরীক্ষিতের নন্দন।
অনন্তর ভীমসেন করে ঘোর রণ।।
ভীমের সংগ্রাম দেখি ভীত কুরুদল।
হাহাকার মহাশব্দ হয় গণ্ডগোল।।
পুনরপি ভীম উঠি রথের উপর।
রথ চালাইয়া দিল বিশোক সত্বর।।
বিশোক চালায় রথ বায়ুসম গতি।
যুঝিতে যুঝিতে যায় ভীম মহামতি।।

কতদূর গিয়া ভীম সাত্যকি দেখিল।
আনন্দিত হয়ে তারে বার্ত্তা জিজ্ঞাসিল।।
ভীম বলে কহ অর্জ্জুনের সমাচার।
কি কারণে রথধ্বজ নাহি দেখি তার।।
সাত্যকি কহিল এই দেখি বৃকোদর।
দ্রোণসহ ধনঞ্জয় করেন সমর।।
পুনরপি বলে ভীমে কহ বিবরণ।
যুধিষ্ঠিরে ছাড়িয়া আইলা কি কারণ।।
ভীম বলে যুধিষ্ঠির পাঠান আমারে।
অর্জ্জুনের সমাচার জানিবার তরে।।
ধৃষ্টদ্যুন্ন স্থানে তারে করি সমর্পণ।
আসিয়াছি সমাচার জানিতে এখন।।
শুনিয়া সাত্যকি তবে আনন্দিত হৈল।
ভামে দেখি কর্ণবীর পুনশ্চ আইল।।

কর্ণেরে দেখিয়া ভীম বলে ডাক দিয়া।
পুনঃ পুনঃ আসিয়া যাইস্ পলাইয়া।।
কণেক থাকিয়া যুঝ তবে জানি কথা।
একেবারে আজি তোর কাটি পাড়ি মাথা।।
এত বলি বৃকোদর ধরি ধনুখান।
কর্ণের উপরে মারে তীক্ষ্ম দশ বাণ।।
বাণেতে ব্যথিত হইলেন অঙ্গপতি।
পলাইল যুদ্ধ ছাড়ি কর্ণ শীঘ্রগতি।।
তবে ক্রোধে বৃকোদর ‍অনল সমান।
আকর্ণ পূরিয়া বীর বরিষয়ে বাণ।।
লক্ষ লক্ষ সেনা পড়ে নাহি তার অন্ত।
গিরি সম হস্তী পড়ে ঈষা সম দন্ত।।
ধ্বজপত্র পতাকা পড়য়ে সারি সারি।
যতেক পড়িল সৈন্য লিখিতে না পারি।।
আট অক্ষ্মৌহিণী সেনা পড়ে সেই দিনে।
এতেক করিল ক্ষয় বীর তিন জনে।।
অর্জ্জুন সাত্যকি দোঁহে চারি অক্ষৌহিণী।
চারি অক্ষৌহিণী ভীম জিনিল আপনি।।
ধৃতরাষ্ট্র পুত্র সব এতেক দেখিয়া।
আইল নব্বই জন রথেতে চড়িয়া।।
সৈন্যসজ্জা কোলাহল হয় হস্তী রথ।
চারিদিকে ঘেরি বেড়ে আবরিল পথ।।
দেখিয়া ধাইল তবে বীর বৃকোদর।
পুনরপি গদা লয়ে সংগ্রাম ভিতর।।
সথ সব চূর্ণ করি যায় বৃকোদর।
একে একে মারিল নব্বই সহোদর।।
নবতি সোদর পড়ে দেখি দুর্য্যোধন।
ভ্রাতৃগণ শোকে রাজা করয়ে ক্রন্দন।।

সঞ্জয় বলিল, শুন অন্ধ নৃপবর।
সহোদর নবতি মারিল বৃকোদর।।
কি বল কি বল অন্ধ নরপতি।
মূর্চ্ছিতা হইয়া তবে পড়ি গেল ক্ষিতি।।
শুনিয়া গান্ধারী দেবী হৈল অচেতন।
বংশনাশ করে মম পাণ্ডুর নন্দন।।
অন্তঃপুরে উঠিল ক্রন্দন কোলাহল।
হাহাকার করে সবে, না বান্ধে কুন্তল।।
টানিয়া ফেলিল নিজ রত্ন আভরণ।
শত শত বধূগণ করয়ে ক্রন্দন।।
চুল ছিঁড়ে বস্ত্র ছিঁড়ে শিরে মারে ঘাত।
আমা সবা এড়ি কোথা গেলে প্রাণনাথ।।
ইন্দ্র বিদ্যাধরী জিনি রূপ সবাকার।
দিব্য বস্ত্র পরিধান রত্ন অলঙ্কার।।
কোমল শরীর সবে পরমাসুন্দরী।
ভূমে গড়াগড়ি যায় হাহাকার করি।।
বধূগণ ক্রন্দন শুনিয়া নরবর।
বিলাপ করয়ে অন্ধ হইয়া কাতর।।
ক্ষণে ক্ষণে মূর্চ্ছা হয় ক্ষণেক চেতন।
কোথাপুত্র বলি রাজা করয়ে রোদন।।
সোণার আগার মম শূণ্যময় হৈল।
ভীমের সমরে পুত্র সকলি মরিল।।
বড়ই নিষ্ঠুর ভীম নাহি দয়া লেশ।
ভীম হৈতে হইল মোর বংশের শেষ।।

সঞ্জয় বলিল, শুন অন্ধ নরবর।
এখন কি হবে রাজা হইলে কাতর।।
এই হেতু পূর্ব্বে কত বলিনু তোমারে।
কার বাক্য না শুনিলা তুমি অহঙ্কারে।।
ভীষ্ম দ্রোণ কৃপ আর বিদুর সুমতি।
বিবিধ প্রকারে বুঝাইল তোমা প্রতি।।
বিদুর বলিল কেন কান্দ নরবর।
তব হিত হেতু পূর্ব্বে কহিনু বিস্তর।।
ধনলোভে রাজ্যলোভে কৈলা অপকর্ম্ম ।
আপনি করিলা রাজা আপন অধর্ম্ম ।।
তাহার অসাধ্য রাজা ছিল কোন কর্ম্ম।
তথাপি না কৈল যুধিষ্ঠির যে অধর্ম্ম।।
মুহূর্ত্তেকে ভূমণ্ডল পারে জিনিবারে।
তথাপিও যুধিষ্ঠির ক্ষমিল তোমারে।।
পঞ্চগ্রাম মাগিলেন ধর্ম্মের নন্দন।
একখানি নাহি দিল দুষ্ট দুর্য্যোধন।।
এখন সে সব কথা হইল বিদিত।
অধর্ম্ম করিলে ভাল নহে কদাচিত।।

বিদুরে চাহিয়া তবে কহিল রাজন্ ।
পুনঃ পুনঃ কটুবাক্য কহ কি কারণ।।
পুত্রগণ শোকে মোরে পুড়িতেছে প্রাণ।
পুনঃ পুনঃ কেন আর হান বাক্যবাণ।
নিঃশব্দে রহিল ইহা বলি নরপতি।
পুত্রগণ-শোকে রাজা কান্দে দুঃখমতি।।

জন্মেজয় বলে, কহ শুনি তপোধন।
কিমতে হইল বধ আর দশজন।।
পিতামহ-চরিত অপূর্ব্ব উপাখ্যান।
অমৃত হইতে রস শুনি তব স্থান।।
মহাভারতের কথা অমৃত-সমান।
কাশীরাম দাস কহে, শুনে পূণ্যবান।।