১৬. জয়দ্রথ-বধের বৃত্তান্ত

মুনি বলে, শুন পরীক্ষিতের নন্দন।
জয়দ্রথ বধ কথা অপূর্ব্ব কথন।।
অর্দ্ধগত নিশা নিদ্রাগত বীরগণ।
অতি চিন্তান্বিত কৃষ্ণ অর্জ্জুন কারণ।।
অর্জ্জুনে কহেন কৃষ্ণ কমললোচন।
না বুঝিয়া প্রতিজ্ঞা করিলা ক্রোধমন।।
জয়দ্রথ হেতু সবে করি প্রাণপণ।
করিবে দারুণ যুদ্ধ না যায় খণ্ডন।।
জয়দ্রথ বীরে তবে মারিবা কেমনে।
এই যে ভাবনা মম হয় অনুক্ষণে।।

অর্জ্জুন বলেন কৃষ্ণ কর অবগতি।
কারে ভয়, তুমি যার থাকিবে সারথি।।
উৎপত্তি প্রলয় যার কটাক্ষেতে হয়।
হেন জন সহায়ে তাহার কারে ভয়।।
অর্জ্জুন বিনয় শুনি দেব জগন্নাথ।
উঠিলেন কৃষ্ণ ধরি অর্জ্জুনের হাত।।
কপিধ্বজ রথে দোঁহে করি আরোহণ।
সঙ্গোপনে যান যথা হরের ভবন।।
পার্ব্বতীর সনে একাসনে ভূতনাথ।
দেখি কৃষ্ণার্জ্জুন করিলেন প্রণিপাত।।
যোড়হাতে শ্রীনাথ কহেন স্তুতি বাণী।
দেবদেব মহাদেব দেব শূলপাণি।।
সমুদ্রমথনে ঘোর উঠিল গরল।
সে সর্ব্ব সংসার দহে হইয়া অনল।।
সৃষ্টিনাশ দেখি দেবগণ স্তুতি করে।
সদয় হইয়া দেবদেব দয়া করে।।
গণ্ডুষে করিয়া পান রাখিলে জগৎ।
ঘুষিতে রহিল যশ জগতে মহৎ।।
সৃষ্টি স্থিতি প্রলয়ের তুমি আদ্য মূল।
নিবেদন করি নাথ হও অনুকূল।।

গোবিন্দের স্তুতি শুনি দেব গঙ্গাধর।
ঈষৎ হাসিয়া তবে করেন উত্তর।।
আমার বিধাতা তুমি বিশ্বের পালক।
যে না জানে সেই বলে নন্দের বালক।।
ভূভার নাশিতে তুমি অবতার হয়ে।
করিছ বিহার কত ধনঞ্জয়ে লয়ে।।
যে হয় তোমার আজ্ঞা করিব পালন।
করহ বিধান আজ্ঞা দেব নারায়ণ।।

গোবিন্দ বলেন, দেব কর অবধান।
কৌরব পাণ্ডব যুদ্ধ নহে সমাধান।।
অন্যায় সমর করি অভিমন্যু বীরে।
বেড়িয়া কৌরবগণ বধে বালকেরে।।
প্রতিজ্ঞা করিল পার্থ বিপক্ষ নাশিতে।
না পারিলে নিজদেহ ত্যজিবে অগ্নিতে।।
এই হেতু নিবেদি যে শুন গঙ্গাধর।
জয়দ্রথে জিনি পার্থ জিনিবে সমর।।

হর বলিলেন হরি শুন অবধানে।
অর্জ্জুন বিজয়ী হবে জিনি শত্রুগণে।।
অর্জ্জুনের সহায় হইব আমি রণে।
রণে গিয়া নিধন করিব কুরুগণে।।

অনন্তর প্রণমিয়া দেবীর চরণ।
করেন অর্জ্জুন কৃষ্ণ অনেক স্তবন।।
শঙ্করী বলেন শুন কৃষ্ণ ধনঞ্জয়।
মম বরে কর গিয়া সব শত্রু ক্ষয়।।
পাইয়া হরের বর কৃষ্ণ ধনঞ্জয়।
ধনলাভে দরিদ্র যেমন তুষ্ট হয়।।
সেই মত মহানন্দে প্রফুল্ল অন্তরে।
প্রণাম করেন দোঁহে শঙ্করী শঙ্করে।।
বিদায় হইয়া, গিয়া আপন শিবিরে।
করিলে শয়ন সবার অগোচরে।।

প্রভাতে উঠিয়া সবে করি স্নানদান।
সুসজ্জা হইয়া যুদ্ধে করিল প্রয়াণ।।
তবে দ্রোণ মহাবীর সর্ব্বসৈন্য লয়ে।
রচিল অদ্ভূত ব্যূহ রণস্থলে গিয়ে।।
বার ক্রোশ পর্য্যন্ত রাখিল সেনাগণ।
তার মধ্যে জয়দ্রথ রাজা দুর্য্যোধন।।
এরূপ করিয়া সবে রহিলেক রণে।
বেড়িয়া রহিল সবে সিন্ধুর নন্দনে।।
হেথা সর্ব্বসৈন্য লয়ে রাজা যুধিষ্ঠির।
গোবিন্দেরে অগ্রে করি হলেন বাহির।।
তবে ধনঞ্জয় ডাকিছেন যোদ্ধাগণে।
ধৃষ্টদ্যুন্ন সাত্যকীরে আর ভীমসেনে।।
যুধিষ্ঠিরে সবা প্রতি করি সমর্পণ।
কহেন তোমারা সবে কর গিয়া রণ।।
জয়দ্রথ বধ হেতু আমি যাই রণে।
যথায় পাইব আজি সিন্ধুর নন্দনে।।

ভীম বলে, তুমি যাও জয়দ্রথ যথা।
যুধিষ্ঠির হেতু তব নাহি মনোব্যথা।।
শুনি কৃষ্ণ বলিলেন শুন ধনঞ্জয়।
এতেক প্রতিজ্ঞা তব উচিত না হয়।।
যদি জয়দ্রথ আজি নাহি হয় বধ।
তবে কি করিবে মোরে কহ তার পথ।।
অর্জ্জুন বলেন প্রভু তোমার প্রসাদে।
আজি জয়দ্রথেরে মারিব অপ্রমাদে।।
বহু সঙ্কটেতে তুমি করিলা তারণ।
যত বল বুদ্ধি মম তুমি নারায়ণ।।

শুনিয়া কহেন কৃষ্ণ হরিষ অন্তর।
বড় বিচক্ষণ তুমি মহাধনুর্দ্ধর।।
অচিরে হইবে তব প্রতিজ্ঞা ‍পূরণ।
আজি সে হইবে তব প্রতিজ্ঞা পূরণ।।
আজি সে হইবে তব শত্রুর নিধন।
এত বলি শ্রীকৃষ্ণ ছাড়েন সিংহনাদ।।
শুনিয়া কৌরবগণ গণিল প্রমাদ।
তবে কৃষ্ণ দারুকেরে কহেন তখন।।
মম রথখানি আন করিয়া সাজন।
শাঙ্গ ধনুকাদি সব তুলহ রথেতে।।
জয়দ্রথ হেতু রণ করিব নিশ্চিতে।।
কদাচিত ধনঞ্জয় ন্যূন যদি হয়।
একেলা করিব আজি কৌরবের ক্ষয়।।
যেইক্ষণে আমার হইবে শঙ্খধ্বনি।
শব্দ শুনি রথ লয়ে যাইবে আপনি।।

এতেক বলিয়া কৃষ্ণ কমললোচন।
বায়ুবেগে চালাইয়া দেন অশ্বগণ।।
ব্যূহমুখে দ্রোণাচার্য্য আছেন আপনে।
তাহার পশ্চাতে যত কুরুসেনাগণে।।
হেনকালে দ্রোণাচার্য্য ব্যূহের দ্বারেতে।
আগুলিল পার্থে আসি ধনুঃশর হাতে।।
দ্রোণে দেখি ধনঞ্জয় করি নমস্কার।
করযোড়ে কহিছেন কুন্তীর কুমার।।
কি হেতু যুদ্ধের সজ্জা দেখি মহাশয়।
অশ্বথমাধিক আমি তোমার তনয়।।
জয়দ্রথ বধ হেতু প্রতিজ্ঞা আমার।
তোমারে জানাই তাই কারণ তাহার।।
দ্রোণ কহে এই কথা না হয় উচিত।
কুরুসৈন্যগণ দেখ আমার রক্ষিত।।
আমার অগ্রেতে তারে করিবে ঘাতন।
কেমনে দেখিব আমি শুনহ অর্জ্জুন।।

এতেক শুনিয়া কৃষ্ণ কহেন পার্থেরে।
উপরোধ কেন তুমি করহ দ্রোণেরে।।
সপ্তরথী বেড়ি মারে এক ছাওয়ালে।
অতি শিশু অভিমন্যু রণে মারে ছলে।।
কোন উপরোধ গুরু করিল তোমারে।
তুমি কেন উপরোধ করহ উহারে।।
সন্ধান পূরিয়া মার দিব্য অস্ত্রগণ।
যেইমতে দ্রোণাচার্য্য হয় অচেতন।।
এতেক শুনিয়া পার্থ অতি ক্রুদ্ধমন।
দ্রোণে চাহি লাগিলেন বলিতে তখন।।
তবে আর বিলম্বে নাহিক প্রয়োজন।
শীঘ্র কর উপায় রাখিতে কুরুগণ।।
আজি যুদ্ধে কৌরবেরে করিব সংহার।
দেখিব কেমনে রাখ করিয়া প্রকার।।

এতেক শুনিয়া গুরু অতি ক্রূদ্ধমন।
করিল অর্জ্জুনোপরি বাণ বরিষণ।।
দশ বাণ এড়ে বীর পূরিয়া সন্ধান।
বাণ ব্যর্থ দেখি দ্রোণ ক্রোধে কম্পবান।।
গগন ছাইয়া বীর বরিষয়ে বাণ।
শীঘ্রহস্তে ধনঞ্জয় পূরিয়া সন্ধান।।
কাটিয়া পাড়েন যত আচার্য্যের বাণ।
ক্রোধে দ্রোণ করিলেন বরিষণ বাণ।।
তবে কৃষ্ণ কহিলেন ধনঞ্জয় প্রতি।
আমি যাহা কহি তাহা কর অবগতি।।
জয়দ্রথ বধ হেতু আছে বড় ভার।
দ্রোণ সহ যুদ্ধ কর না বুঝি বিচার।।

এত শুনি ধনঞ্জয় কহেন কৃষ্ণেরে।
কিমতে যাইব, দ্রোণ পথ রুদ্ধ করে।।
কৃষ্ণ বলিলেন শুন আমার বচন।
দ্রোণের দক্ষিণ দিকে আছে সেনাগণ।।
সেই সেনাগণ বাণে কাটি পাড় তুমি।
সেইখান দিয়া রথ চালাইব আমি।।
এত শুনি ধনঞ্জয় পূরেন সন্ধান।
নিমিষে করেন বহু সৈন্য খান খান।।
তবে শ্রীকৃষ্ণের রথ বেগেতে চলিল।
দ্রোণেরে পশ্চাৎ করি সৈন্যে প্রবেশিল।।

দ্রোণ বলে ধনঞ্জয় এ কোন বিচার।
পলাইয়া যাও তুমি অগ্রেতে আমার।।
অর্জ্জুন বলেন, গুরু করি নমস্কার।
তোমারে জিনিবে হেন শক্তি আছে কার।।
জয়দ্রথ বধ হেতু যাইব এখন।
তোমার চরণে করি এই নিবেদন।।
এত শুনি দ্রোণাচার্য্য হাসিতে লাগিল।
এক ভিতে রথ রাখি পথ ছাড়ি দিল।।
তবে ধনঞ্জয় বীর অতিশয় ক্রোধে।
যারে পায় তারে মারে নাহি উপরোধে।।
আকর্ণ পূরিয়া বীর বরিষয়ে বাণ।
রথ অশ্ব পদাতিক করে খান খান।।
পলায় সকল সৈন্য রণে নাহি রয়।
মহাক্রোধে আগু হৈল দ্রোণের তনয়।।
ধনঞ্জয় অশ্বথামা দোঁহে মহারণ।
বিস্ময় মানিয়া চাহে যত সেনাগণ।।
মহাবীর অশ্বথামা দ্রোণের নন্দন।
অর্জ্জুন উপরে করে বাণ বরিষণ।।
তবে ক্রোধে মহাবীর ইন্দ্রের নন্দন।
কাটিলেন দ্রৌণীর হাতের শরাসন।।
আর ধনু লয়ে বীর দ্রোণের তনয়।
বাণ বৃষ্টি করে অতি নির্ভয় হৃদয়।।
তবে ধনঞ্জয় বীর অগ্নি হেন জ্বলে।
সারথির মাথা কাটি ফেলিল ভূতলে।।
এড়েন যুগল অস্ত্র ইন্দ্রের নন্দন।
বাণাঘাতে অশ্বথামা হৈল অচেতন।।
সেইক্ষণে সারথী আইল এক আর।
অচেতন রথে বীর দ্রোণের কুমার।।
কতক্ষণে অশ্বথামা পাইল চেতন।
ধনু ধরি পুনরপি করে মহারণ।।
মহাপরাক্রম দোঁহে সমান সোসর।
হইল তুমুল যুদ্ধ নাহি অবসর।।
তবে ধনঞ্জয় ক্রোধে হইল অস্থির।
সন্ধান পূরিয়া বিন্ধে দ্রৌণীর শরীর।।
কবচ কাটিয়া বাণ অঙ্গে প্রবেশিল।
অচেতন হয়ে বীর রথেতে পড়িল।।
রথেতে পড়িল বীর হয়ে অচেতন।
হাহাকার করি ধায় যত যোদ্ধাগণ।।
হেনকালে অগ্রে হৈল মিহির নন্দন।
ধনুক ধরিয়া আসে করিবারে রণ।।
অর্জ্জুন করিয়া বলে অর্জ্জুনেরে আঁটি।
লেগেছে তোমারে মৃত্যু তেঁই ছটফটি।।
দ্রোণ সেনাপতি বলে মম বধ্য নহে।
সে কারণে ভালে ভালে দিন কত রহে।।
নিশ্চয় আমার হস্তে তোমার মরণ।
কহিলাম সত্য এই বিধির ঘটন।।

অর্জ্জুন বলেন হাসি, হতজ্ঞান তুমি।
পশুজ্ঞান করিয়া বধিব তোমা আমি।।
কুপিয়া বলিছে কর্ণ বুঝিব এখন।
কেমনে সারিয়া আজি যাহ মোর রণ।।
এত বলি সূর্য্যসুত সর্পবাণ এড়ে।
সহস্র সহস্র নাগ পার্থে গিয়া বেড়ে।।
এড়েন গরুড় বাণ ইন্দ্রের নন্দন।
ধরিয়া সকল সর্প করিল ভক্ষণ।।
সর্পেরে গিলিয়া কর্ণে গিলিবারে আসে।
অগ্নিবাণ কর্ণ তবে এড়িল তরাসে।।
অগ্নিতে পক্ষীর পাখা পুড়িল সকল।
হইল প্রলয় অগ্নি সেই রণস্থল।।
এড়েন বরুণ বাণ ইন্দ্রের নন্দন।
জলেতে নিবৃত্ত হৈল যত হুতাশন।।
হইল প্রলয় নীর সেই রণস্থলে।
হয় হস্তী পদাতিক ভাসি যায় জলে।।
শোষক নামেতে বাণ কর্ণ এড়ে রোষে।
শুষিল সকল নীর চক্ষুর নিমিষে।।
কর্ণ ধনঞ্জয় যুদ্ধ নাহি পাঠান্তর।
বিস্ময় মানিয়া চাহে যতেক অমর।।
তবে পার্থ মহাবীর পূরিয়া সন্ধান।
একেবারে মারিলেন দশ গোটা বাণ।।
কবচ কাটিয়া বাণ অঙ্গে প্রবেশিল।
মূর্চ্ছিত দেখিয়া রথ ফিরায় সারথি।।
রণে ভঙ্গ দিয়া গেল কর্ণ যোদ্ধাপতি।
তবে ধনঞ্জয় বীর মহাক্রোধ মনে।।
লক্ষ লক্ষ যোদ্ধাগণে বিনাশিল রণে।
হেনমতে ছয় ক্রোশ পথ চলি গেলা।।
গগনমণ্ডলে হৈল দ্বিপ্রহর বেলা।

হেনকালে কৃষ্ণ কন শুন ধনঞ্জয়।।
শ্রমযুক্ত হইল রথের চারি হয়।
শরে বিদ্ধ হইয়াছে চলিতে না পারে।।
কিমতে যাইব তবে সংগ্রাম ভিতরে।
দিবা হৈল বহু, তৃণ জল নাহি পায়।।
হের দেখ ঘন ঘন মম মুখ চায়।
সংগ্রাম করহ যদি নামি ভূমিতল।।
তবে আমি খাওয়াই অশ্বে তৃণ জল।

এত শুনি কৃষ্ণেরে কহেন গুড়াকেশ।।
কেন অসম্ভব কথা কহ হৃষীকেশ।
সংগ্রামের স্থল ইথে না হয় সংশয়।।
তৃণশূন্য এই স্থল ধূলা উড়ে যায়।
গোবিন্দ বলেন ক্ষণ রহ হেথা তুমি।।
যেথা পাই আনি জল খাইয়াব আমি।
অর্জ্জুন বলেন বড় হইল বিস্ময়।।
যে কহিলা নারায়ণ শুনি হয় ভয়।
ছল করি ছাড়িয়া যাইতে চাহ হরি।।
সিন্ধু মাঝে ডুবাইয়া আমারে সংহারি।
বুঝিলাম অপরাধ হইয়াছে পায়।।
তুমি যদি ছাড় তবে নাহিক উপায়।
তুমি বল, তুমি বুদ্ধি, পাণ্ডবের প্রাণ।।
যার অনুগ্রহে সঙ্কটেতে পাই ত্রাণ।
অনুক্ষণ হৃদয়ে উদয় তাহেদেখি।।
হেন অনাথের নাথ মোরে কর দুঃখী।
আমার প্রতিজ্ঞা যত সে হইল মিছা।।
তবে আর এ ছার জীবনে কিবা ইচ্ছা।
কেমনে সমর সিন্ধু তরিবারে পারি।
তরণী ফেলিয়া হরি চলিলে কাণ্ডারী।।

কমল-নয়ন কৃষ্ণ কহেন হাসিয়া।
করহ আক্ষেপ সখা কিসের লাগিয়া।।
পঞ্চভাই তোমরা পাণ্ডব যাজ্ঞসেনী।
রাখিয়াছ ভক্তিতে আমাকে সদা কিনি।।
পলাইতে পারি কি যে পলাইতে চাই।
হৃদয় নিগড়ে বন্দী এড়াইতে নাই।।
কে জানে কহি যে সত্য তোমা ছয় জনে।
নাহি পারি এক দণ্ড পাসরিতে মনে।।
ভূমিতলে নামি যদি করহ সংগ্রাম।
তবেত অশ্বেরে আমি করাই বিশ্রাম।।

এত শুনি ধনঞ্জয় নামিয়া ভূমিতে।
সংগ্রাম করেন বীর ধনুঃশর হাতে।।
তবে কৃষ্ণ রথ হৈতে ভূমিতলে উলি।
ক্রমে ক্রমে যুচাইল যত কড়িয়ালি।।
তৃষিত হইল অশ্ব ক্ষত গাত্র বাণে।
জানি নারায়ণ তবে বলেন অর্জ্জুনে।।
শ্রীকৃষ্ণ বলেন পার্থ দেখ অশ্বগণে।
তৃষ্ণার কারণ চাহে মম মুখ পানে।।
বিনা জলপানে অশ্ব না পারে চলিতে।
তাহার বিধান আমি করি যে ত্বরিতে।।
তবেত করহ যুদ্ধ কুরুসৈন্য সনে।
হউক ক্ষণেক যুদ্ধ মল্ল মল্লগণে।।
এতেক কহিয়া কৃষ্ণ কমললোচন।
এক সরোবর কৈল অপূর্ব্ব রচন।।
নানা জাতি পক্ষীগণ ক্রীড়া করে তাহে।
নানা পুষ্প ফুটে তার গন্ধে মন মোহে।।
হংসগণ ক্রীড়া করে হংসীর সহিত।
সারস সারসী ক্রীড়া করে আনন্দিত।।
পদ্মের সৌরভে গন্ধ চতুর্দ্দিকে যায়।
লাখে লাখে মত্ত অলি মধুলোভে ধায়।।
অমৃত সমান হৈল সরোবর নীর।
অশ্ব লয়ে তাহাতে নামেন যদুবীর।।
জলেতে ধোয়ান কৃষ্ণ অশ্বের শোণিত।
অদ্ভূত দেখিয়া সবে হইল বিস্মিত।।

অর্জ্জুনেরে ভূমে দেখি যত যোদ্ধাগণ।
সন্ধান পূরিয়া করে অস্ত্র বরিষণ।।
দেখিয়া অর্জ্জুন তবে পূরেন সন্ধান।
আকর্ণ পূরিয়া বিন্ধিলেন দিব্য বাণ।।
শূণ্যেতে দোঁহার বাণ একত্র হইল।
গ্রহের সদৃশ হয়ে শূন্যেতে রহিল।।
আনন্দে গোবিন্দ তবে লয়ে অশ্বগণে।
জলপান করালেন হরিষত মনে।।
জলপানে অশ্বগণ হৈল বলবান।
পূর্ব্বের সদৃশ হৈল করি জলপান।।
তবে কৃষ্ণ অশ্বগণে লইয়া সংহতি।
রথেতে উঠেন গিয়া অতি শীঘ্রগতি।।
অশ্বগণে রথে যুড়ি বলেন অর্জ্জুনে।
বলবান হৈল অশ্ব দেখ জলপানে।।
অতঃপর রথে আসি চড় মহামতি।
রথ চালাইয়া আমি দিব শীঘ্রগতি।।

এত শুনি ধনঞ্জয় ধনুঃশর হাতে।
এক লাফ দিয়া বীর চড়িলেন রথে।।
কৃতাঞ্জলি অর্জ্জুন কহেন সবিনয়।
এক নিবেদন করি শুন মহাশয়।।
তোমার চরিত্র আমি বুঝিতে না পারি।
আপন বৃত্তান্ত মোরে কহ কৃপা করি।।
নিরবধি অপরাধ করি তব স্থান।
চিনিতে না পারি আমি বড়ই অজ্ঞান।।
শ্রীকৃষ্ণ বলেন পার্থ না কর বিস্ময়।
মম পরিচয় তোমা দিব ধনঞ্জয়।।
এত বলি দেন কৃষ্ণ চালাইয়া হয়।
ধনু ধরি করেন সমর ধনঞ্জয়।।
দ্রোণপর্ব্ব সুধারস জয়দ্রথ বধে।
কাশীরাম দাস কহে গোবিন্দের পদে।।