১৫. জয়দ্রথ বধে অর্জ্জুনের প্রতিজ্ঞা

তার পরে বাসুদেব কমললোচন।
যুধিষ্ঠির রাজা চাহি বলেন বচন।।
কহ শুনি অভিমন্যু যুদ্ধের কথন।
কিরূপে কৌরব সহ করিলেক রণ।।
যুধিষ্ঠির বলিলেন শুন বিবরণ।
চক্রব্যূহ করি দ্রোণ করে মহারণ।।
ব্যুহ ভেদি যুদ্ধ করে নাহি হেন জন।
অভিমন্যু প্রতি কহিলাম সে কারণ।।
এতেক শুনিয়া পুত্র কহিল তখন।
ব্যূহে প্রবেশিতে জানি, না জানি নির্গম।।
তথাপি পাঠানু তারে করিয়া বিচার।
ব্যূহে প্রবেশিল শিশু করি মহামার।।
তার পাছে যাই সবে হেন করি মনে।
ব্যুহদ্বার রুদ্ধ করে সিন্ধুর নন্দনে।।
জয়দ্রথে জিনিতে নারিল কোন জন।
সে কারণে মরিলেন অর্জ্জুন নন্দন।।
কুরুবল বিনাশিল অভিমন্যু রথী।
তবে তারে বেড়িলেন সপ্ত সেনাপতি।।
এমত অন্যায় করে দুষ্ট দুর্য্যোধন।
সমরেতে বিনাশিল আমার নন্দন।।

এত শুনি নারায়ণ ক্রোধে হুতাশন।
এমত অন্যায় যুদ্ধ করে দুষ্টগণ।।
জয়দ্রথ হেতু মরে অভিমন্যু বীর।
শুনি ধনঞ্জয় ক্রোধে হইল অস্থির।।
মহাক্রোধে বলিলেন ইন্দ্রের নন্দন।
আমি যাহা কহি তাহা শুন সর্ব্বজন ।।
জয়দ্রথ হেতু মরে অভিমন্যু বীর।
এক বাণে নিপাতিব তাহার শরীর।।
কালি যদি জয়দ্রথে নাহি মারি রণে।
পিতা পিতামহ গতি না পায় কথনে।।
বিনা জয়দ্রথ বধে সূর্য্য অস্ত হয়।
করিব শরীর ত্যাগ জানিহ নিশ্চয়।।
জয়দ্রথে না মারিয়া না আসিব ঘর।
আমার প্রতিজ্ঞা এই সভার ভিতর।।

এত শুনি যোদ্ধাগণ হরিষ অন্তর।
মহানাদে গর্জ্জিয়া উঠিল বৃকোদর।।
পাঞ্চজন্য আপনি বাজান নারায়ণ।
মহানাদে বাজিতে লাগিল বাদ্যগণ।।
বড় বড় শঙ্খ বাজে নাহি লেখাজোখা।
দামামা দগড় বাজে নাহি তার সংখ্যা।।
কোটি কোটি ডম্ফ বাজে মৃদঙ্গ বিশাল।
ভেউরি ঝাঝরি বাজে মুহুরী কাহাল।।
নানাজাতি বাদ্য বাজে কত কব নাম।
সুমধুর বীণা বাজে অতি অনুপম।।
মহাকোলাহল শব্দ হইল গর্জ্জন।
শুনিয়া হইল এস্ত কুরুসৈন্যগণ।।

দূতমুখে শুনি তবে সিন্ধুর নন্দন।
শরীর হইল কম্প নহে নিবারণ।।
শ্রীঘ্রগতি গিয়া কহে যথা দুয্যোধন।
প্রতিজ্ঞা করিল পার্থ আমার কারণ।।
কালি রণে মোরে পার্থ করিবেক ক্ষয়।
প্রতিজ্ঞা করিল এই শুন মহাশয়।।
যদি পার্থ কালি মোরে বধিবারে নারে।
আপনি মরিবে সেই পুড়ি বৈশ্বানরে।।
এইমত প্রতিজ্ঞা করিল পুনঃ পুনঃ।
কালি সত্য যুদ্ধে মোরে মারিবে অর্জ্জুন।।
ইহার উপায় কিছু না দেখি যে আমি।
নিজদেশে যাই আমি আজ্ঞা কর তুমি।।

এত শুনি হরষিত হৈল দুর্য্যোধন।
জয়দ্রথে বলে শুন আমার বচন।।
কি শক্তি অর্জ্জুন তোমা করিবে সংহার।
তোমারে রাখিবে যোদ্ধা যতেক আমার।।
এত বল দুর্য্যোধন জয়দ্রথে লয়ে।
যথা দ্রোণগ্রুরু গৃহ উত্তরিল গিয়ে।।
প্রণাম করিয়া তবে বলে দুর্য্যোধন।
অবধান কর গুরু এক নিবেদন।।
প্রতিজ্ঞা করিল পার্থ কুন্তীর নন্দন।
কালি যুদ্ধে জয়দ্রথে করিবে নিধন।।
জয়দ্রথ বধ বিনা সূর্য্য অস্ত হয়।
অগ্নিতে শরীর ত্যাগ করিবে নিশ্চয়।।
এত শুনি জয়দ্রথ মহাভয় পেয়ে।
আমারে কহিল, আমি যাই পলাইয়ে।।
সাক্ষাতে দেখহ ভয়ে কাঁপিছে শরীর।
তুমি ভয় ভাঙ্গিলে সে হয়ত সুস্থির।।
কালি যদি ধনঞ্জয় মারিতে না পারে।
অবশ্য মরিবে পার্থ কহি যে তোমারে।।

এত শুনি দ্রোণ জয়দ্রথে আশ্বাসিল।
নাহিক তোমার ভয় বলিতে লাগিল।।
কর্ণি আদি করিয়া যতেক যোদ্ধাগণ।
তোমারে রাখিবে সবে করিয়া যতন।।
কালি আমি এক ব্যূহ করিব রচন।
যাহা লঙ্ঘিবারে নাহি পারে দেবগণ।।
ব্যূহ মধ্যে তোমাকে রাখিব লুকাইয়া।
দুর্য্যোধন আগুহয়ে থাকিবে বেড়িয়া।।

কর্ণ বলে জ,য়দ্রথ না করিহ ভয়।
অবশ্য মরিবে কালি বীর ধনঞ্জয়।।
হেন বুঝি অনুকূল হইবেক ধাতা।
সে কারণে অর্জ্জুন কহিল হেন কথা।।
এত শুনি জয়দ্রথ ত্যজিলেক ভয়।
অব্শ্য হইবে কালি অর্জ্জুনের ক্ষয়।।
হরষিত দুর্য্যোধন জয়দ্রথে নিয়া।
আপনার গৃহে গেল আনন্দিত হৈয়া।।
কৃপাচার্য্য বলে তবে দ্রোণাচার্য্য প্রতি।
এক কথা কহি আমি কর অবগতি।।
নিশ্চয় জানিল এই রাজা দুর্য্যোধন।
অবশ্য হইবে কালি পার্থের নিধন।।
ত্রিদশের নাথ কৃষ্ণ সহায় যাহার।
হেনজন নাহি ‍পায় কদাচ অপার।।
অবশ্য হইবে জয়দ্রথের নিধন।
কহিলাম জান মম স্বরূপ বচন।।
এত শুনি দ্রোণাচার্য্য হরষিত মন।
যতেক কহিলা তুমি বেদের বচন।।
দ্রোণপর্ব্ব সুধারস অপূর্ব্ব কথন।
আয়ুর্যশ পুণ্য বাড়ে শুনে যেই জন।।
ব্যাস বিরচিত হয় অপূর্ব্ব ভারত।
কাশীরাম দাস কহে পাঁচালীর মত।।