০৯. অভিমন্যুর যুদ্ধারম্ভ

ব্যূহে প্রবেশিল যবে অভিমন্যু বীর।
ভীম আদি যোদ্ধাগণ হইল অস্থির।।
নাহি দিল জয়দ্রথ প্রবেশিতে পথ।
চিন্তাকূল হল বড় পড়িল বিপদ।।
ব্যূহ ভেদি গেল পুত্র নিজ বীরপণে।
তাহাতে কহিল শুনি নির্গম না জানে।।
জানিয়া সমূহ সৈন্যমাঝে গেল রণে।
সঙ্কটে পড়িলে রক্ষাপাইবে কেমনে।।
হেথা না দেখিয়া বীর সৈন্য নিজ পাশ।
জানিল নিশ্চয় বিধি করিল নিরাশ।।
উপায় কি আছে আর অপারের সিন্ধু।
পড়িয়াছি পার নাহি বিধি মাত্র বন্ধু।।
এত বলি সাহস করিল মহাবীর।
বাণবৃষ্টি করি সৈন্য করিল অস্থির।।
এক রথে অভিমন্যু করে মারমার।
দেখিয়া কৌরবগণ করে হাহাকার ।।
চৌদিকে বেষ্টিত যত কুরুসৈন্যগণ।
পিঞ্জর মধ্যেতে যেন পোষা পক্ষী রন।।
না জানে বালক সেই নির্গমের সন্ধি।
মীন যেন পড়িল হইয়া জালে বন্দী।।
তথাপি অভয় ধনু লইলেক হাতে।
শাসিত করিয়া সৈন্য ভ্রমে এক রথে।।
জলদ বরিষে যেন কালে বরিষায়।
ঝাঁকে ঝাঁকে অস্ত্র পড়ে ক্ষমা নাহি তায়।।
মাহুত মাতঙ্গ পড়ে তুরঙ্গ বহুত।
কোটি কোটি সৈন্য মারে সংগ্রামে অদ্ভূত।।
অলস না হয় তনু সাহসী বালক।
সৈন্যরণ্য দহে যেন হইয়া পাবক।।
প্রকাশেন পরাক্রম নাহি তার সীমা।
বাখানয়ে বালকের বিবিধ মহিমা।।
একমাত্র ধনুকের গুণে পঞ্চ বাণ।
না পারে সম্মূখে কেহ করিতে সন্ধান।।
কুমারের প্রতাপ দেখিয়া কুরুগণ।
চিন্তাকূল দুর্য্যোধন বিষণ্ণ বদন।।
হেনকালে উলূক দুঃশাসনের নন্দন।
অভিমন্যু সহ গেল করিবারে রণ।।
আইল সমর হেতু অভিমন্যু সঙ্গ।
ইচ্ছিল পড়িতে যেন পাবকে পতঙ্গ।।
দেখিয়া আর্জ্জুনি কোপে অনল সমান।
গাল দিয়া বলে তুই বড়ই অজ্ঞান।।
কে দিল কুবুদ্ধি তোরে হৈল ব্রহ্মশাপ।
এই দণ্ডে দেখাইব আমার প্রতাপ।।
ত্যজ আশা, কর বাসা শমনের ঘরে।
বিলম্ব না হবে এই পাঠাই তোমারে।।

এত বলি ইঙ্গিত করিয়া এড়ে বাণ।
তাহার বিক্রমে উলূকের উড়ে প্রাণ।।
এক বাণে ধ্বজ কাটি করে খণ্ড খণ্ড।
আর ‍‍দুই বাণে পাড়ে সারথির মুণ্ড।।
চারি বাণে কাটিলেক রথের চারি হয়।
দুই বাণে উলূকেরে দিল যমালয়।।
উলূক পড়িল যদি লাগে চমৎকার।
কৌরবের যোদ্ধাগণ করে হাহাকার।।
করি বহু বিলাপ কান্দেন দুঃশাসন।
এক যোদ্ধাপতি মম উলূক নন্দন।।
সর্ব্বশূন্য দেখি আমি তোমার বিহনে।
গৃহে না যাইব আমি যাইব কাননে।।

তবে বৃষসেন বীর কর্ণের নন্দন।
আর্জ্জুনি সহিত গেল করিবারে রণ।।
করিয়া অনেক দর্প বৃষসেন বীর।
এক রথে যায় তবে নির্ভয় শরীর।।
অভিমন্যু সহ তবে করে মহারণ।
দেখি কোপে জ্বলে বীর কর্ণের নন্দন।।
কাটিল রথের ধ্বজ মারি দুই বাণ।
চারি বাণে চারি অশ্ব করে খান খান।।
আর দুই বাণ বীর এড়ে আচম্বিতে।
সারথির মাথা কাটি পাড়িল ভূমিতে।।
অর্দ্ধচন্দ্র বাণ এড়ে অর্জ্জুন তনয়।
এক ঘায়ে বৃষসেন হৈল মৃতপ্রায়।।

পুত্র ভঙ্গ দেখি তব কর্ণ মহাবীর।
ক্রোধেতে পূর্ণিত অঙ্গ হইল অস্থির।।
বহু বিলাপয়ে কর্ণ সূর্য্যের নন্দন।
মহাকোপে গেল তবে করিবারে রণ।।
বাছিয়া বাছিয়া কর্ণ এড়ে অস্ত্রগণ।
অস্ত্র ব্যর্থ করে বীর অর্জ্জুন-নন্দন।।
তবে কোপে অভিমন্যু এড়ে দশ বাণ।
কর্ণের কবচ কাটিকরে খান খান।।
কবচ কাটিয়া বাণ অঙ্গে প্রবেশিল।
মূর্চ্ছিত হইয়া কর্ণ রথেতে পড়িল।।
মূর্চ্ছিত দেখিয়া রথ ফিরায় সারথি।
পলাইয়া গেল তবে কর্ণ যোদ্ধাপতি।।

তবেত লক্ষ্মণ দুর্য্যোধনের নন্দন।
অভিমন্যু সহ গেল করিবারে রণ।।
যেইক্ষণে আগু হৈল ভানুমতী-সুত।
অভিমন্যু বীর তারে বলে ক্রোধযূত।।
হিতবাক্য বলি তোরে ভাইরে লক্ষণ।
এমত কুমতি তোরে দিল কোন্ জন।।
বাপের দুলাল তুই বড় প্রিয়তর।
না কর সমর ভাই মম বাক্য ধর।।
অনেক যতনে লোক রক্ষা করে দেহ।
আপনি মরিলে সঙ্গে না যাইবে কেহ।।
এ সুখ সম্পদ আশা ছাড় কি কারণ।
আমার বচন ধর না করিও রণ।।
ইষ্ট বন্ধু জনক জননী খুড়া ভাই।
মরিলে সম্বন্ধ আর কার সঙ্গে নাই।।
ভালরূপে দেখ ভাই সবার বদন।
মম সঙ্গে রণে তোর অবশ্য নিধন।।
ক্ষমা চাহে আমারে যে হইয়া কাতর।
হইলে পরম শত্রু ডর নাহি তার।।
অভয় দিলাম ভাই বলিলাম তোরে।
সম্বরিয়া সমর চলিয়া যাহ ঘরে।।
তোমারে বধিলে সিদ্ধ হবে কোন কার্য।
বরঞ্চ হবেন রুষ্ট শুনি ধর্ম্মরাজ।।
সাক্ষাতে দেখিলে যত কর্ণের বড়াই।
পড়িলে আমার ঠাঁই আজি রক্ষা ‍নাই।।
পলাইয়া গেল নারি সহিতে সমর।
বাখানে কৌরবগণ যারে নিরন্তর।।
আমি তোরে বলি আজি অখণ্ডিত কথা।
কাটিয়া ফেলিব কর্ণ শকুনির মাথা।।
বান্ধিয়া লইয়া যাব ধর্ম্মরাজ আগে।
এত বলি রক্তবর্ণ চক্ষু হৈল রাগে।।

লক্ষ্মণ বলিল আর না কর বড়াই।
বুঝিব কেমনে এড়ইবা মোর ঠাঁই।।
শুনিয়া কহিল তবে অর্জ্জুন নন্দন।
ধনুকের গুণে বাণ যুড়ি সেইক্ষণ।।
দুই বাণে রথধ্বজ হৈল খণ্ড খণ্ড।
আর দুই বাণে কাটে সারথির মুণ্ড।।
আর দুই বাণ এড়ে কি কহিব কথা।
শ্রীকুণ্ডল কাটি পাড়ে লক্ষণের মাথা।।
দেখি দুর্য্যোধন শোকে হৈল অচেতন।
ভূমে গড়াগড়ি দিয়া করয়ে রোদন।।
প্রাণের নন্দন মোর অতি প্রিয়তর।
হাহাকার করে রাজা হইয়া কাতর।।
ভ্রাতার মরণ দেখি পদ্মবীর বেগে।
হাতে ধনু করি গেল অভিমন্যু আগে।।
সেই বেগে আগু হৈল পদ্মবীরবর।
দুই বাণে কাটিলেক অর্জ্জুন কোঙর।।

দুর্য্যোধন দেখি পুত্র হইল সংহার।
ভূমিতে পড়িয়া রাজা করে হাহাকার।।
পুত্রশোকে দুর্য্যোধন হইল কাতর।
বৈশনাশ কৈল মোর অর্জ্জুন কোঙর।।
দুই পুত্র শোকে রাজা শোকাকুল মন।
হাতে গদা করি ধায় করিবারে রণ।।
অর্জ্জুনি বলিল আর কারে নাহি চাই।
পাণ্ডবংশ শত্রু দুষ্ট তোরে যদি পাই।।
ভূমি দুঃখ দিলে পিতা আদি পঞ্চজনে।
কপট পাশায় জিনি পাঠাইলে বনে।।
মোরা বনবাসী, তব সব অধিকার।
এত অবিচার বিধি কত সবে আর।।
আছে নাহি পলাইও প্রাণে পেয়ে ভয়।
রহিয়া করহ যুদ্ধ কুরু মহাশয়।।
না করিহ অবজ্ঞা বলিয়া শিশু মোরে।
ফিরিয়া যাইতে সাধ না কর অন্তরে।।

এত বলি বাণ এড়ে পূরিয়া সন্ধান।
গদা লক্ষ্যে মারিলেক তীক্ষ্ম দশ বাণ।।
দশ বাণে গদা কাটি সত্বর ফেলিল।
তীক্ষ্ম ভল্ল দশ গোটা অঙ্গে প্রহারিল।।
বাণাঘাতে দুর্য্যোধন ব্যথিত অন্তর।
বেগে পলাইয়া যায় ত্যজিয়া সমর।।
অভিমন্যু বলে রাজা না চাহি তোমায়।
পলাইয়া যাও কোন শৃগালের প্রায়।।
ক্ষণেক থাকিয়া যুদ্ধ কর মহাশয়।
আজি তোমা পাঠাইব শমন আলয়।।
এতেক বলিয়া গর্জ্জে অর্জ্জুন তনয়।
পলাইল দুর্য্যোধন ব্যথিত হৃদয়।।
এক রথে ভ্রমে বীর অর্জ্জুন কোঙর।
নাহিক সম্ভ্রম কিছু নির্ভয় অন্তর।।
গগন ছাইয়া বীর করে অস্ত্র বৃষ্টি।
বাণে অন্ধকার হয় নাহি চলে দৃষ্টি।।
অমর্থ সমর্থ বাণ, বাণ ব্রহ্মজাল।
কোশিক কপালী বাণ আর রুদ্রকাল।
অর্দ্ধচন্দ্র ক্ষুরপা তোমর ভল্ল শর।।
বারুণ হুতাশ বাণ সমরে দুষ্কর।
কোন স্থানে অগ্নিবাণে পুড়ে সেনাগণ।।
কোন স্থানে মহাঝড় বহিছে পবন।
কোন স্থানে মেঘগণে আবরিল ভানু।।
মুষলধারায় বৃষ্টি শীতে কাপে তনু।
ঢাকিল রবির তেজ হৈল অন্ধকার।।
চারিদিকে অস্ত্র পড়ে না দেখি নিস্তার।
কুঞ্জর সারথি অশ্ব ফেলে কাটি কার।
ধনু সহ বামহন্ত কাটে আলোয়ার।।
কাহার কাটিল মুণ্ড কুণ্ডল সহিত।
নাসা শ্রুতি কাটিল দেখিতে বিপরীত।।
বাণবৃষ্টি করিলেন পড়িয়া সন্ধান।
কাহার কাটিল পাড়ে পদ দুইখান।।
অস্ত্রাঘাত কোন বীর করে ছটফটি।
কাটিয়া পাড়িল কার দন্ত দুই পাটি।।
দেখিয়া কৌরবগণ করে হাহাকার।
অভিমন্যু একাকী করিল মহামার।।
এক শত সহোদর রাজা দুর্য্যোধন।
তাহা সবাকার যত আছিল নন্দন।।
একে একে অভিমন্যু করিল সংহার।
দেখি দুর্য্যোধন রাজা করে হাহাকার।।

মুনি বলে শুন পরীক্ষিতের তনয়।
ধৃতরাষ্ট্রে সব কথা শুনায় সঞ্জয়।।
শুনহ নৃপতি তুমি অনর্থের কথা।
হইল দৈবেতে বাম দারুণ বিধাতা।।
অর্জ্জুন তনয় ষোল বৎসরের শিশু।
সৈন্যমধ্যে সিংহ যেন পায় বন্যপশু।।
অন্ত করে সামন্ত অর্দ্ধেক একা আসি।
দ্রোণ কর্ণ রহিলেন সেই ভয় বাসি।।
অধোমুখ দুর্য্যোধন মানিয়া বিস্ময়।
চিন্তিয়া আকুল বড় চমকিয়া রয়।।
ঊনশত ভাই তারা হারাইল বোধ।
সমরে অসক্ত বড় যেমন অবোধ।।
নদী হৈল শোনিতে বহিয়া স্রোত যায়।
প্রলয়কালেতে সৃষ্টি নাশ হৈল প্রায়।।

ধৃতরাষ্ট্র কহে শুন সঞ্জয় সুমতি।
যতেক শুনি যে পড়ে মোর সেনাপতি।।
একা অভিমন্যু করে মোর সেনাক্ষয়।
বড় বড় সেনাপতি পায় পরাজয়।।
ষোড়শ বৎসর শিশু পূর্ণ নাহি হয়।
কেহ না পারিল তারে করিতে বিজয়।।
অদ্ভূত শুনিয়া মম কাঁপিছে হৃদয়।
ধন্য ধন্য মহাবীর অর্জ্জুন তনয়।।

সঞ্জয় বলিল, রাজা শুনহ কারণ।
অভিমন্যু সহ যুঝে নাহি হেন জন।।
পর্ব্বত কাটিয়া পাড়ে অভিমন্যু বাণ।
মহাধনুর্দ্ধর বীর বাপের সমান।।
ধৃতরাষ্ট্র বলে মোর হেন লয় মন।
সবারে মারিয়া যাবে অর্জ্জুন-নন্দন।।
দ্রোণপর্ব্ব পুণ্যকথা অভিমন্যু বধে।
কাশীরাম দাস কহে গোবিন্দের পদে।।