০০৯. সমুদ্র-মন্থন

সৌতি বলে, অবধান কর মুনিগণ।
যে হেতু হইল পূর্ব্বে সমুদ্র-মন্থন।।
ব্রহ্মারে কহিল পূর্ব্বে দেব গদাধর।
দেবাসুরগণ নিয়া মন্থহ সাগর।।
অমৃত উৎপত্তি হবে সাগর-মন্থনে।
দেবগণ অমর হইবে সুধা-পানে।।
যত মহৌষধি আছে পৃথিবী-ভিতরে।
মন্দর লইয়া মথ ফেলিয়া সাগরে।।

বিষ্ণুর পাইয়া আজ্ঞা যত দেবগণ।
মন্দর-পর্ব্বত যথা করিল গমন।।
অতি উচ্চ গিরিবর পরশে গগন।
ঊর্দ্ধে উচ্চ একাদশ-সহস্র যোজন।।
উপাড়িতে বহু শক্তি কৈলা দেবগণে।
না পারিয়া নিবেদিল বিষ্ণুর সদনে।।
বিষ্ণুর আজ্ঞাতে সে অনন্ত মহীধর।
উপাড়িয়া ভুজবলে আনিন মন্দর।।
দেবগণ সব গেল সমুদ্রের তীরে।
বরুণে বনিল, তুমি ধরহ মন্দরে।।
বরুণ বলিল, গিরি বড়ই বিস্তার।
মোর শক্তি নাহিক ধরিতে মহাভার।
মন্দর ধরিতে এক আছয়ে উপায়।
মোর জলে কূর্ম্ম আছে অতি মহাকায়।।
এত শুনি দেবগণ কূর্ম্মে আরাধিল।
মন্দর ধরিতে কূর্ম্ম অঙ্গীকার কৈল।।
কূর্ম্মপৃষ্ঠে গিরিবর করিয়া স্থাপন।
বাসুকি-নাগের দড়ি করিল যোজন।।
পুচ্ছেতে ধরি দেব, মুখে দৈত্যগণ
আরম্ভ করিল সিন্ধু করিতে মন্থন।।
গিরি-ঘরষণে নাগ ছাড়য়ে নিশ্বাস।
ধূম উপজিল তাহে ব্যাপিল আকাশ।।
সেই ধূমে হৈল যত মেঘের জনম।
বৃষ্টি করি সুরগণে খণ্ডাইল শ্রম।।
ত্রিভুবন বিকম্পিত সর্পের গর্জ্জনে।
অনেক মরিল দৈত্য বিষের জ্বলনে।।
মন্দরের আন্দোলে বরুণ কম্পমান।
জলচর জীব যত ত্যজিল পরাণ।।
অগ্নি উঠে গিরি-বৃক্ষ-মূল ঘরষণে।
পর্ব্বত-নিবাসী পোড়ে তাহার আগুনে।।
দেখিয়া করিল দয়া দেব পুরন্দর।
আজ্ঞায় বরিষে মেঘ পর্ব্বত উপর।।
নির্ব্বাণ হইল অগ্নি জল-বরিষণে।
ঔষধের বৃক্ষ যত হৈল ঘরষণে।।
তাহার যতেক রস সমুদ্রে পড়িল।
সেই রস পরশনে জলচর জীল।।

হেনমতে দেব দৈত্য সমুদ্র মথিল।
অনেক হইল শ্রম সুধা না মিলিল।।
ব্রহ্মারে কহিল তবে সব দেবগণ।
তোমার আজ্ঞায় হৈল সমুদ্র-মন্থন।।
অমৃত না মিলে হৈল পরিশ্রম সার।
পুনঃ মথিবারে শক্তি নাহি সবাকার।।

এত শুনি ব্রহ্মা নিবেদিল নারায়ণে।
অশক্ত হইল সবে সমুদ্র-মন্থনে।।
তোমা বিনা সিন্ধু মথে কাহার শকতি।
এত শুনি অঙ্গীকার করিল শ্রীপতি।।
সব দেবগণ তবে বিষ্ণুদেজ পাইয়া।
পুনরপি সিন্ধু মথে মন্দর ধরিয়া।।
হেনমতে দেবাসুর মথন করিতে।
দ্বিজরাজ-জন্ম তবে হৈল আচম্বিতে।।
সুধাংশ ষোড়শ-কলা নাম ধরে সোম।
দুই লক্ষ যোজনে করিল স্থিতি ব্যোম।।
দরশনে অখিল জনের হৈল তৃপ্তি।
যোজন পঞ্চাশ কোটি ব্রহ্মাণ্ডেতে দীপ্তি।।
দেখি হরষিত হৈল সুরাসুর-নর।
পুনরপি মথে সিন্ধু ধরিয়া মন্দর।।
তবেত জন্মিল হস্তী, নাম ঐরাবত।
শ্বেত-অঙ্গ চতুর্দ্দন্ত, আকারে পর্ব্বত।।
মদিরা জন্মিল, অশ্ব উঠে উচ্চৈঃশ্রবা।
পারিজাত-পুষ্পবৃক্ষ সুরপরী-শোভা।।
অমৃতের কমণ্ডলু লৈয়া বাম কাঁখে।
ধন্বন্তরি উঠিলেন, সুরাসুর দেখে।।
রত্নগণ উপজিল, দেখে দেবগণ।
আনন্দেতে পুনঃ সিন্ধু করয়ে মথন।।
মন্দরের আন্দোল ক্ষীরোদ-সিন্ধু-মাঝ।
না পারিল সহিতে বরুন জলারাজ।।
পাত্র-মিত্রগণ ল’য়ে করিল বিচার।
কিরূপে মথন হৈতে পাইব নিস্তার।।
মন্ত্রী বলে, উপায় শুনহ মোর বাণী।
শরণ লইবে চল যথা চক্রপাণি।।
জনমিল যেই কন্যা কমল-কাননে।
তাহা দিয়া পূজা কর দেব-নারায়ণে।।
পূর্ব্বে নাম ছিল তাঁর লক্ষ্মী হরিপ্রিয়া।
মুনি-শাপ-ভ্রষ্ট হৈয়া জন্মিল আসিয়া।।
তাহার কারণে সিন্ধু হইল মথন।
নিবারণ হবে, লক্ষ্মী পেলে নারায়ণ।।

শুনি তবে জলরাজ বিলম্ব না কৈল।
দিব্য-রত্নচয়ে চতুর্দ্দোল বানাইল।।
আপনি লইল স্কন্ধে পুত্রের সহিতে।
নারীগণ চামর ঢুলায় চারিভিতে।।
সহস্র-ফনায় ছত্র শিরে ধরে শেষ।
বাহির হইলা সিন্ধু হইলে জলেশ।।
রূপেতে করিল আলো এ তিন ভুবন।
মলিন হইল সূর্য্য-আদি জ্যোতির্গণ।।
কমল জিনিয়া অঙ্গ অতি কোমলতা।
কমল-বদন, চক্ষু কমলের পাতা।।
দ্বিভুজা কমল-দন্তা চড়ি চতুর্দ্দোলে।
কর-কমলেতে ধৃত যুগল কমলে।।
যুগল কমল-পদ, কমল-আসনে।
বিদ্যুত-বরণী, নানা রতনে ভূষণে।।
স্থাবর জঙ্গম ক্ষিতি সমুদ্র আকাশ।
দরশনে সবাকার হইল উল্লাস।।
জীবাত্মা-বিহনে যেন হয় মৃত তনু।
তেমতি ত্রৈলোক্য ছিল বিনা লক্ষী-জনু।।
দেবকন্যা নাগকন্যা মানবী অপ্সরী।
হুলাহুলি শব্দেতে পূরিল তিন পুরি।।
দুন্দুভির শব্দে নৃত্য করে বরাঙ্গনা।
ত্রৈলোক্যেতে জয় জয় হইল ঘোষণা।।
ব্রহ্মা-ইন্দ্র আদি যত অমর-মণ্ডলে।
করযোড়ে প্রণমি পড়িল ভূমিতলে।।
চতুর্দ্দিকে স্তুতি করে দেব-ঋষিগণ।
উত্তরিলা সন্নিকটে দেব-নারায়ণ।।
প্রণমিয়া বরুণ পড়িল কত দূরে।
আজ্ঞামাত্র উঠি দাঁড়াইল যোড়-করে।।
কৃতাঞ্জলি করি বলে মৃদু-মন্দ-ভাষে।
স্তুতি করে নারায়ণে অশেষ-বিশেষে।।
তুমি সূক্ষ্ম, তুমি স্থুল, তুমি সর্ব্বব্যাপী।
ব্রহ্মা বিষ্ণু মহেশ্বর, তুমি জগদব্যাপী।।
স্থাবর জঙ্গম তুমি সিন্ধু ধরাধর।
আকাশ পাতাল তুমি দেব নাগ নর।।
তোমার সৃজন দেব এ তিন ভুবন।
স্থানে স্থানে সকলেতে তোমা নিয়োজন।।
ইন্দ্রে স্বর্গ দিলা, যমে সংযমনী-পুর।
কুবেরে কৈলাস দিলা ধনের ঠাকুর।।
জল মধ্যে আমারে করিয়া দিলা স্থিতি।
তব আজ্ঞায় চিরকাল করি যে বসতি।।
কোন দোষে দোষী নহি তব পদ্মপাদে।
তবে কেন আমি এত পড়িনু প্রমাদে।।
দ্বিতীয় সুমেরু-সম মন্দর পর্ব্বত।
মোর-পুর মধ্যেতে মথিল অবিরত।।
যোজন পঞ্চাশকোটি যে পৃথ্বি-বিস্তার।
হেন ক্ষিতি তিলবৎ শিরে রহে যাঁর।।
অবিরত সেই স্থল মন্থে সেই শেষ।
সুরাসুর ত্রৈলোক্যেতে ঘর্ষণ বিশেষ।।
জীব জন্তু যতেক আছিল যত জন।
একটিও না রহিল লইয়া জীবন।।
ভাঙ্গিল আমার পুর, হৈল লণ্ডভণ্ড।
না জানি কাহার দোষে মোর হৈল দণ্ড।।
এতকাল স্থান দিয়াছিলা সিন্ধুমাঝ।
কোথায় রহিব আজ্ঞা কর দেবরাজ।।

এতেক মিনতি যদি করিলা বরুণ।
শুনিয়া করুণাময় হৈলা সকরুণ।।
আশ্বাসি বলেন হরি, শুন জলেশ্বর।
না করহ চিন্তা কিছু, না করিহ ডর।।
দুর্ব্বাসার শাপে লক্ষ্মী ছাড়ি নিজ স্থল।
তিনপুর ত্যজি প্রবেশিলা সিন্ধু-জল।।
হতলক্ষ্মী হয়ে কষ্ট পায় সর্ব্বজন।
সমুদ্র মথিল সবে তাহার কারণ।।
লক্ষ্মী যদি মিলিল, মথনে কিবা কাজ।
বিশেষ তোমার ক্লেশ হৈল জলরাজ।।
এত বলি মথন করিল নিবারণ।
শুনি হৃষ্টমতি হৈল বরুণ তখন।।
সর্ব্ব-রত্ন-সার যেই ত্রৈলোক্য দুর্লভ।
গোবিন্দের গলে মণি দিলেন কৌস্তভ।।
চন্দ্র-সূর্য্য-প্রভা-জিনি যাহার কিরণ।
নারায়ণ-বক্ষঃস্থলে হৈল সুশোভন।।
মথন নিবারি চলিলেন হৃষীকেষ।।
মভারতের কথা অমৃত লহরী।
একমনে শুনিলে তরয়ে ভববারি।।