০৪. শল্যের সারথ্য স্বীকার ও কর্ণের আত্মশ্লাঘা

দুর্য্যোধন নৃপতির শুনিয়া বচন।
সারথি হইতে শল্য করিল মনন।।
নানা অস্ত্র পরিপূর্ণ, পতাকা নিচয়।
চড়িল কর্ণের রথে শল্য মহাশয়।।
হাতেতে পাঁচনি লয়ে চলিল সারথি।
যুদ্ধ করিবারে যায় কর্ণ মহামতি।।
শল্যের অগ্রেতে কর্ণ আপনা বাখানে।
চিত্ররথ আসে যদি বিনাশিব বাণে।।
যদি যম আদি সঙ্গে আসে দেবরাজ।
জিনিব সবারে আমি সংগ্রামের মাঝ।।
সবারে মারিয়া আজি মারিব অর্জ্জুন।
দুই দলে দেখিবেক আজি মোর গুণ।।
শুনিয়া কর্ণের বাণী বলে শল্যপতি।
বিষম বীরত্ব তব, অহঙ্কার অতি।।
শৌর্য্যে বীর্য্যে কভু তুমি নহ পার্থ সম।
ধনঞ্জয় মহাবীর পুরুষ উত্তম।।
যদুসেনা জিনি আনে সুভদ্রারে হরি।
শঙ্করে তুষিল হিমালয়ে যুদ্ধ করি।।
দহিল খাণ্ডববন জিনি দেবগণে।
গন্ধর্ব্বে জিনিয়া রাখে রাজা দুর্য্যোধনে।।
আপনি হারিলে তুমি উত্তর গোগৃহে।
ভীষ্ম দ্রোণ কৃপ আদি প্রতাপ না সহে।।
প্রাণপণে পার্থ সহ যদি কর রণ।
জানি যে নিশ্চয় আজি তোমার মরণ।।
শল্যেরে চাহিল অনাদরে কর্ণ বীর।
জয় জয় করি চলে রণকর্ম্মে ধীর।।
রথ চালাইল বীর পবনের বেগে।
প্রবেশিল কর্ণবীর সংগ্রামেরে আগে।।
পাণ্ডবের রথ আদি পূর্ব্বভাগে দেখে।
অহঙ্কারে কর্ণবীর সংগ্রামের আগে।।
পাণ্ডবের রথ আদি পূর্ব্বভাগে দেখে।
অহঙ্কারে কর্ণবীর বলয়ে কৌতুকে।।
যে মোরে দেখাবে আজি ধনঞ্জয় বীর।
সুবর্ণে ভূষিত তার করিব শরীর।।
যে মোরে দেখাবে আজি পার্থ ধনুর্দ্ধর।
এক শত গ্রাম দিব পরম সুন্দর।।
যে মোরে দেখাবে পার্থে সংগ্রাম ভিতর।
সুবর্ণে মণ্ডিত হস্তী দিব মনোহর।।
পঞ্চ শত অশ্ব দিব মণিতে মণ্ডিত।
চারি শত গবী দিব বৎসের সহিত।।
ছয় শত রথ দিব রত্নে সুশোভিত।
এক শত দাসী দিব রত্নেতে ভূষিত।।
যে আমারে দেখাইবে অর্জ্জুন দুর্জ্জয়।
যাহা চাবে তাহা দিব, বলিনু নিশ্চয়।।
অর্জ্জুন সহিত কৃষ্ণে করিব সংহার।
যত ধন পাই আমি, সকলি তাহার।।
ইহা বলি কর্ণবীর ছাড়ে সিংহনাদ।
সকল কৌরব করে জয় জয় নাদ।।
তবলা দুন্দুভি বাজে মৃদঙ্গ বহুল।
সৈন্য করে সিংহনাদ শব্দেতে তুমুল।।
পুনঃ বলে শল্যরাজ, শুন কর্ণবীর।
দেখিবে অর্জ্জুন বীরে, না হও অস্থির।।
কি কারণে দিবে ধন অশ্ব হস্তীগণ।
কৃষ্ণ সহ ধনঞ্জয় দেখিবে এক্ষণ।।
কৃষ্ণার্জ্জুনে কহ তুমি করিবে সংহার।
হেন ছার বাক্য কহ করি অহঙ্কার।।
বন্ধুগণ তোমারে না করে নিবারণ।
কাল পরিপূর্ণ হৈল, তোমার মরণ।।
গলায় বান্ধিয়া শিলা সমুদ্র তরিতে।
একেশ্বর ইচ্ছা তুমি করিতেছ চিতে।।
একত্র হইয়া যুঝে সকল কৌরবে।
অর্জ্জুনের ঠাঁই তবু পরাভব পাবে।।
দুর্য্যোধন আদি করি বলি সবাকারে।
শুন কর্ণ যদি বাঞ্ছা আছে বাঁচিবারে।।
সবান্ধবে গিয়া লহ ধর্ম্মের শরণ।
তবে সে অর্জ্জুন-হাতে এড়াবে মরণ।।
শল্যের বচনে কহে কর্ণবীর রোষে।
না বুঝিয়া জ্ঞানহীন মহাজনে দোষে।।
অর্জ্জুনে প্রশংসা করে, মোরে নাহি বলে।
আজি অর্জ্জুনেরে আমি মারিব সমূলে।।
যদি বজ্রহস্তে আসে দেবের ঈশ্বর।
না গণিবে তাহারেও কর্ণ ধনুর্দ্ধর।।
শল্য বলে কর্ণবীর না করিহ দাপ।
আপনি জানহ মনে অর্জ্জুন-প্রতাপ।।
দুই জনে বিসম্বাদ হইল বিস্তর।
ক্রুদ্ধ হয়ে কর্ণ যায় সংগ্রাম ভিতর।।
সৈন্যগণ সঙ্গে গেল রাজা দুর্য্যোধন।
শকুনি সৌবল কর্ণ দ্রোণের নন্দন।।
দুঃশাসন কৃতবর্ম্মা উলূক নৃপতি।
সাজিয়া আসিল রণে সব নরপতি।।
ব্যূহ করি কর্ণবীর হৈল আগুয়ান।
দুই পার্শ্বে দুই বীর কর্ণের সমান।।
অর্জ্জুনে কহিল তবে রাজা যুধিষ্ঠির।
সংগ্রামে সাজিয়া আসে কর্ণ মহাবীর।।
প্রতিব্যূহ করি শীঘ্র কর নিবারণ।
সৈন্য যেন না লঙ্ঘয়ে রাধার নন্দন।।
রাজার আদেশ পেয়ে বীর ধনঞ্জয়।
প্রতিব্যূহ করিলেন বিপক্ষ বিজয়।।
অগ্নিদত্ত রথে বীর আরোহণ করি।
কৃষ্ণ সনে সাজিলেন নানা অস্ত্র ধরি।।
দুন্দুভি মৃদঙ্গ শঙ্খ বাজয়ে মাদল।
সিংহনাদ করি সৈন্য করে কোলাহল।।
নারায়ণী সেনা আর সংশপ্তকগণ।
চতুর্দ্দিকে বেড়ি অস্ত্র করে বরিষণ।।
মহাবলবান্ সেই সংশপ্তকগণ।
একেশ্বর যুঝে বীর ইন্দ্রের নন্দন।।
অর্জ্জুনে দেখিয়া কর্ণ মহাহৃষ্ট হৈল।
সৈন্যে সৈন্যে রথ সহ বহুযুদ্ধ কৈল।।
সৈন্য-সাগরের মধ্যে গেল ধনঞ্জয়।
সেই যুদ্ধে অর্জ্জুনের পরাভব হয়।।
মহাভারতের কথা সুধার সমান।
কাশীরাম দাস কহে, শুনে পুণ্যবান।।