০৮. অর্জ্জুনের হস্তে কর্ণপুত্র বৃষসেন বধ

জিজ্ঞাসেন জন্মেজয় যুদ্ধ বিবরণ।
ব্যক্ত করি যুদ্ধ কথা কহ তপোধন।।
কর্ণেরে বলিল দুর্য্যোধন মহাশয়।
গাণ্ডীব লইয়া আসে বীর ধনঞ্জয়।।
রক্তপান করি তবে বীর বৃকোদর।
দুঃশাসন রক্তেতে লেপিল কলেবর।।
দুর্য্যোধন যথা আছে ভ্রাতৃগণ সঙ্গে।
অস্ত্র লয়ে তথা ভীম যান মনোরঙ্গে।।
দেশবাণ মারিয়া কাটিল পঞ্চজন।
সেই শোকে ভয়েতে পলায় দুর্য্যোধন।।
দেখি কর্ণ আইলেক করিবারে রণ।
কর্ণে দেখি পলায় সকল সৈন্যগণ।।
সর্ব্ব সৈন্য ভঙ্গ দিল নাহি চায় পাছে।
ভ্রাতৃশোকে দুর্য্যোধন প্রাণমাত্র আছে।।
সর্ব্ব মুখ্য কর্ণবার খ্যাত ধনুর্দ্ধর।
মুখ্য বীর বৃষসেন হাতে নিল শর।।
কর্ণপুত্রে নকুলে হইল মহারণ।
নকুলের রথ কাটি ফেলে সেইক্ষণ।।
ভীম রথে চড়িলেন নকুল দুর্জ্জয়।
মহাবলবন্ত বীর রণেতে নির্ভয়।।
সহদেব নকুল ও ধৃষ্টদ্যুন্ন বীর।
দ্রৌপদীর পঞ্চ পুত্র নির্ভয় শরীর।।
ভীমে খেদাড়িয়া চলে বীর বৃষসেন।
কিঞ্চিৎ নাহিক ভয় কর্ণের নন্দন।।
অশ্বথামা কৃপ দুর্য্যোধন নরপতি।
বৃষসেনে রক্ষিবারে আসে শীঘ্রগতি।।
দুই দলে মহাযুদ্ধ, অস্ত্রের নির্ঘাত।
চতুরঙ্গ দলে হৈল বহুত নিপাত।।
তবে বৃষসেন বীর কর্ণের নন্দন।
তিন বাণে অর্জ্জুনে বিন্ধিল সেইক্ষণ।।
মারিল দ্বাদশ শর কৃষ্ণ কলেবরে।
মহাবীর বৃকোদরে বিন্ধিলেক শরে।।
সাত বাণে নকুলের নাশে অহঙ্কার।
মহাবীর বৃষসেন সংগ্রামে দুর্ব্বার।।
রুষিয়া অর্জ্জুন বীর হাতে নিল শর।
তাহাতে বিন্ধেন বৃষসেন কলেবর।।
ক্ষুরবাণে ধনঞ্জয় কাটি ধনুর্ব্বাণ।
মাথা কাটি ফেলিলেন কর্ণ বিদ্যমান।।
পুত্রশোকে কর্ণের লোচনে জল ঝরে।
উল্কাপাত পড়ে যেন পৃথিবী উপরে।।
পুত্রশোকে কর্ণবীর ধাইল সত্বর।
যুগান্তের যম যেন হাতে ধনুঃশর।।
সিংহনাদ ছাড়ে বীর, বলে ধর ধর।
দেখিয়া পাণ্ডব-সৈন্য পলায় সত্বর।।

অর্জ্জুনে বলেন, কৃষ্ণ শুন মহামতি।
পুত্রশোকে ধায় দেখ কর্ণ সেনাপতি।।
দেবাসুর-জয়ী এই কর্ণ মহাবীর।
সাবধানে যুদ্ধ কর না হও অস্থির।।
এবে দেখ শরজাল বর্ষে কর্ণবীর।
বরিষার মেঘ যেন বরিষয়ে নীর।।
ইন্দ্রের ধনুক হেন দেখ বিদ্যমান।
কর্ণ হাতে শোভিত বিজয় ধনুর্ব্বাণ।।
দুর্য্যোধন মহাবীর করে সিংহনাদ।
ধনুক টঙ্কার শুনি জয় জয় নাদ।।
রণ করি কর্ণ বীরে করহ নিধন।
তোমার সমান বীর নহে কোন জন।।
বর দিল তোমারে প্রসন্ন শূলপাণি।
কর্ণে সংহারিবে তুমি ইহা আমি জানি।।

অর্জ্জুন বলেন কৃষ্ণ না কর বিস্ময়।
কর্ণেরে মারিব আজি জানিহ নিশ্চয়।।
হেনকালে কর্ণ আসে সংগ্রাম ভিতরে।
পুত্রশোকে তাহার নয়নে জল ঝরে।।
দুই বীরে দেখা দেখি হইল সত্বর।
রণেতে শোভিল যেন দুই দিবাকর।
দুই রথে দীপ্তমান উভয়ের ধ্বজ।
এক ধ্বজে কপি শোভে আর ধ্বজে গজ।।
কর্ণ বেড়ি কৌরব করয়ে সিংহনাদ।
শঙ্খ ভেরি বাজে আর জয় জয় নাদ।।
অর্জ্জুনেরে বেড়িয়া বিচিত্র বাধ্য বাজে।
সিংহনাদ শব্দ করে পাণ্ডবের মাঝে।।
নানা অস্ত্র মারি সৈন্য করয়ে নিধন।
মহাবজ্রাঘাতে যেন ‍পড়ে তরুগণ।
দুই দলে মিশাইয়া চাহে কুতুহলে।।
দেবতা গন্ধর্ব্ব এল গগনমণ্ডলে।
যতেক দানব যক্ষ পিশাচ রাক্ষস।।
সকলে চাহয়ে সদা রাধেয়ের যশ।
চাহেন অর্জ্জুন যশ সকল অমর।।
অন্তরীক্ষে পুত্রযশ চাহে দিবাকর।
অর্জ্জুনের যশ চান ত্রিদশ-ঈশ্বর।।
দুই বীরে যুদ্ধ করে অতি ঘোরতর।

শল্য নৃপে জিজ্ঞাসেন কর্ণ ধনুর্দ্ধর।।
আমারে স্বরূপ কহ শল্য বীরবর।
অর্জ্জুনের যুদ্ধে যদি আমি পড়ি রণে।।
তবে কোন কোন কর্ম্ম করিবা আপনে।
হাসিয়া বলিল শল্য আমি একেশ্বর।
কৃষ্ণ সহ সংহারিব পার্থ ধনুর্দ্ধর।।

গোবিন্দেরে জিজ্ঞাসেন বীর ধনঞ্জয়।
যদ্যপি আমারে কর্ণ করে পরাজয়।।
কোন কর্ম্ম করিবে আপনি ‍নারায়ণ।
কেমনে হইবে তবে কর্ণের নিধন।।

হাসিয়া বলেন তবে কৃষ্ণ মহাশয়।
শুন বীর ধনঞ্জয় কহিব নিশ্চয়।।
সূর্য্য যদি শূণ্য হৈতে ভ্রষ্ট ক্ষিতিতলে।
খণ্ড খণ্ড হর যদি পৃথিবীমণ্ডলে।।
কহিলাম এত যদি হয় বিপরীত।
তোমারে জিনিতে কর্ণ নারে কদাচিৎ।।

অর্জ্জুন বলেন তবে করি অহঙ্কার।
অবশ্য করিব আজি কর্ণেরে সংহার।।
শৃঙ্গ ভেরী দুন্দুভি যে ঘন ঘন বাজে।
দুই দলে মহাযুদ্ধ হয় রণমাঝে।।
অর্জ্জুনে বিন্ধিল দশ বাণে কর্ণবীর।
হাসেন অর্জ্জুন বীর অক্ষয় শরীর।।
আকর্ণ পূরিয়া তবে বীর ধনঞ্জয়।
দশ বাণ মারিলেন কর্ণের হৃদয়।।
এইমত বাণ যুদ্ধ হইল বিস্তর।
অক্ষয় শরীর দোঁহে মহাধনুর্দ্ধর।।
নারাচ বরিষে কত অতি খরসান।
অর্দ্ধচন্দ্র ক্ষুরপাদি আর নানা বাণ।।
অস্ত্রগণ পড়ে যেন পক্ষী ঝাঁকে ঝাঁকে।
ভ্রুকুটি কটাক্ষে যেন বিজলী ঝলকে।।
কর্ণকে পরশুরাম ব্রহ্ম অস্ত্র দিল।
হেন অস্ত্র কর্ণবীর সন্ধান পূরিল।।
যুগান্তের যম যেন উড়ি যায় শর।
নিবারিতে নারিলেন পার্থ ধনুর্দ্ধর।।
মহাবেগে পড়ে বাণ অর্জ্জুন উপরে।
হেনকালে কৃষ্ণ তাহা ধরে দুই করে।।
কর্ণের প্রতাপে স্থির নহে সৈন্যগণ।
ভীম কৃষ্ণ অর্জ্জুনেরে বলিল তখন।।
উপরোধ ছাড় ভাই না করিহ হেলা।
কর্ণ বধ কর অস্ত্র যুড়ি এই বেলা।।
সাবধানে মার অস্ত্র না হও বিমন।
তব বিদ্যমানে পড়ে সব সৈন্যগণ।।

ভীম-বাক্যে নানা অস্ত্র এড়ে ধনঞ্জয়।
মহাসত্ব কর্ণ বীর নাহি করে ভয়।।
বাণে অন্ধকার করিলেক কর্ণবীর।
পাণ্ডবের সৈন্যগণ হইল অস্থির।।
নিরন্তর বিন্ধিল অর্জ্জুন কলেবর।
সর্ব্ব বাণ কাটিলেন পার্থ ধনুর্দ্ধর।।
বাসুদেবে বিন্ধিল মারীচ বাণ মারি।
আর যত বাণ পড়ে লিখিতে না পারি।।
সর্ব্বলোক চিন্তিত চাহিয়া দুইজনে।
কৃষ্ণার্জ্জুনে নিবারিল কর্ণ মহাবাণে।।
সর্ব্বাঙ্গ হইল ক্ষত পার্থ ধনুর্দ্ধর।
সহস্র এড়েন বাণ কর্ণের উপর।।
কর্ণ শল্য কুরুবল বাণে আবরিল।
অন্ধকার করি সবে বাণ বরষিল।।
শল্যকে বিন্ধেন পার্থ তীক্ষ্ম দশ শরে।
বিন্ধেন দ্বাদশ বাণ কর্ণের শরীরে।।
রুধির পড়িছে ধারে কর্ণের শরীরে।
পুনঃ সপ্ত বাণ বিন্ধে কর্ণ মহাবীরে।।
সহস্র সহস্র বাণ নিমিষে চলিল।
অন্ধকার করি অস্ত্র গগণ ভরিল।।
অর্জ্জুনের বাণ যেন বিজলী তরঙ্গ।
লষ্ট হৈল কুরুবল রণে দিল ভঙ্গ।।
ভঙ্গ দিল কুরুবল কর্ণ একেশ্বর।
মহারথি সারথি দুর্জ্জয় ধনুর্দ্ধর।।
জয়নাদ করে অস্ত্র ধরি করে বীর।
দেবাসুর যুদ্ধে যার অক্ষত শরীর।।
কর্ণবীর অর্জ্জুনেরে বধে মনে করি।
অর্জ্জুনে মারিতে অস্ত্র এড়ে সারি সারি।।
শরজালে কর্ণবীর পূরিল গগন।
কম্পমান হইল পাণ্ডব সৈন্যগণ।।
হেনকালে এক সর্প রাক্ষস সমান।
পাতাল হইতে সে হইল আগুয়ান।।
যুদ্ধ করে কর্ণ বীর পার্থের সহিত।
দাণ্ডাইয়া কহে সর্প কর্ণের সাক্ষাৎ।।
মম ভ্রাতৃবধ কৈল কুন্তীর কুমার।
এইকালে করি আমি পার্থেরে সংহার।।
কোনরূপে করি আজ অর্জ্জুনে সংহার।
অতি ক্রোধে সর্প তবে বলে বার বার।।
মহাভারতের কথা অমৃত সমান।
কাশীরাম দাস কহে শুনে পুণ্যবান।।