০৬. যুধিষ্ঠিরের নিকট অর্জ্জুনের কর্ণবধে প্রতিজ্ঞা

শয়ন করিয়া আছে রাজা যুধিষ্ঠির।
চরণ বন্দেন গিয়া ধনঞ্জয় বীর।।
উল্লাসেতে উঠি বসিলেন যুধিষ্ঠির।
প্রত্যয় জন্মিল পড়িয়াছে কর্ণবীর।।
মহারাজ যুধিষ্ঠির চিন্তিলেন মনে।
কর্ণ মোরে মহাদুঃখ দিল মহারণে।।
হরষিতে হেথায় আইল দুইজন।
বিনা কর্ণে মারি সখে হেথা আগমন।।
এত চিন্তি যুধিষ্ঠির নিবারিল দুঃখ।
হরিষে দেখেন কৃষ্ণ অর্জ্জুনের মুখ।।
যুধিষ্ঠির জিজ্ঞাসা করেন বার বার।
কহ ভাই অর্জ্জুন যুদ্ধের সমাচার।।
দেবাসুজয়ী বীর সূর্য্যের নন্দন।
সভামধ্যে যারে পূজে মানি দুর্য্যোধন।।
যাহারে পরশুরাম দিল, দিব্য ধনু।
অভেদ্য কবচ যার আবরিল তনু।।
যার ভূজবীর্য্যে দগ্ধ হই রাত্রিদিনে।
এয়োদশ বৎসর আছিনুশ্রবে বনে।।
মন স্থির নহে মম না ঘচে তরাস।
নিরন্তর দেখি কর্ণ আসে মম পাশ।।
সেই কর্ণে আজি বুঝি মারিলে সমরে।
আনন্দ পূরিল আজি আমার অন্তরে।।
মহাবীর কর্ণে তুমি কেমনে মারিলা।
মহাসিন্ধু হৈতে তুমি কেমনে তরিলা।।

যুধিষ্ঠির-বাক্য শুনি অতি ভয়ঙ্কর।
সশঙ্কিত ধনঞ্জয় দিলেন উত্তর।।
আমার বিপক্ষ ছিল সংসপ্তকগণ।
তাহাদের সঙ্গে মোর হতেছিল রণ।।
তাহে অশ্বথামা সনে আছিল বিরোধ।
শরবৃষ্টি করি করে তাহার নিরোধ।।
কর্ণে মারিবারে যাই করিয়া সন্ধান।
ভীমমুখে শুনিলাম তব অপমান।।
তোমার কুশল জানি যাই আরবার।
অবশ্য করিব আমি কর্ণেরে সংহার।।

জীবিত আছয়ে কর্ণ শুনিয়া বচন।
মহাক্রুদ্ধ হইলেন ধর্ম্মের নন্দন।।
কর্ণশরে ত্রাসিত যে পাণ্ডবের পতি।
অর্জ্জুনেরে ভৎসিয়া বলে মহামতি।।
মোরে পরাজিয়া সৈন্য করে লণ্ডভণ্ড।
মহাযুদ্ধ করে কর্ণ সমরে প্রচণ্ড।।
একেশ্বর যুদ্ধ করে বীর বৃকোদর।
আইলে তাহারে যুদ্ধে রাখিয়া সত্বর।।
কর্ণেরে মারিব বলি করিয়াছ পণ।
তারে দেখি এখন পলাও কি কারণ।।
তোর জন্ম দিনেতে যে হৈল দৈববাণী।
পৃথিবী জিনিয়া মোরে দিবা রাজধানী।।
দৈবের বচন মিথ্যা হৈল হেন দেখি।
তোমা পুত্রে পুত্রবতী কুন্তী কেন লিখি।।
গর্ভ হৈতে কেন না পড়িলি পঞ্চমাসে।
বিফল ধরিল কুম্ভী তোরে গর্ভবাসে।।
যক্ষরাজ ধনু দিল ইন্দ্র দিল শর।
ভুবন সংহার অস্ত্র দিল মহেশ্বর।।
মায়ারথ দিল তোরে গন্ধবেবর পতি।
অস্ত্র সব আছে তোর পবনের গতি।।
রথধ্বজে হনুমান মহাবলন্ত।
আপনি সারথি কৃষ্ণ প্রতাপে অনন্ত।।
হাতে তোর গাণ্ডীব অক্ষয় ধনুঃশর।
পলাইলে কর্ণভয়ে প্রাণেতে কাতর।।
গাণ্ডীবের যোগ্য তুমি মহা ধনুর্দ্ধর।
কৃষ্ণেরে গাণ্ডীব দেহ শুনহ বর্ব্বর।।
অগ্রে কৃষ্ণে দিতে যদি গাণ্ডীব তোমার।
এত দিনে কুরুগণ হইত সংহার।।
কৃষ্ণেরে গাণ্ডীব দেহ কৃষ্ণ হৌন রথী।
রথের উপরে তুমি হওত সারথি।।

এতেক দুর্ব্বাণী শুনি পার্থ বারে বারে।
খড়গ লয়ে উঠিলেন ভূপে কাটিবারে।।
নিবারিয়া কৃষ্ণ তারে করেন ভৎসন।
জ্যেষ্ঠ ভাই কাটিবারে ‍চাহ কি কারণ।।

অর্জ্জুন বলেন মম প্রতিজ্ঞা নিশ্চয়।
হেন বাক্য বলে যেই তারে করি ক্ষয়।।
গাণ্ডীব ছাড়িতে মোরে যে জন বলিবে।
অবশ্য কাটিব তারে গুরু যদি হবে।।
প্রতিজ্ঞা লঙ্গিলে হয় নরক অনন্ত।
গরু বধ করি হয় নরক দুরন্ত।।
দুই কর্ম্মে নরকেতে হইবে প্রয়াণ।
তুমি দেব জান বেদশাস্ত্রের বিধান।।

হাসিয়া বলেন কৃষ্ণ শুন ধনঞ্জয়।
গুরুজনে না বধিও আছয়ে উপায়।।
ক্ষান্ত হও ধনঞ্জয় স্থির কর মন।
শুনিয়া কহেন পার্থ বিনয় বচন।।
দোষ না জানিয়া যেবা করে অপমান।
শাস্ত্রেতে কহিল তার মরণ বিধান।।
গোসাঞি রাখিল তেঁই রহিল পরাণ।
নিজে ভয় পাইয়া করেন অপমান।।
আপনি ভয়ার্ত্ত হও কর্ণযুদ্ধ দেখি।
হারিয়া পলাও তুমি সংগ্রাম উপেক্ষি।।
ভীম নাহি দেয় কার মনে অনুতাপ।
দুর্নিবার রণে যার অতুল প্রতাপ।।
শত শত হস্তী মারে গদার প্রহারে।
যূথে যূথে অশ্ব বীর বৃকোদর মারে।।
করয়ে দুষ্কর কর্ম্ম ভাই বৃকোদর।
সে নাহি নিন্দয়ে মোরে বলিয়া বর্ব্বর।।
তুমি কর অপকর্ম্ম সভার ভিতর।
পাশাতে হারিলা যত ধন রত্ন ঘর।।
তোমার কারণে মোরা চারি সহোদর।
নানা দুঃখ ভুঞ্জিলাম অরণ্য ভিতর।।
আপনা কাটিতে চান বীর ধনঞ্জয়।
হাত হৈতে খড়গ লন কৃষ্ণ মহাশয়।।

অর্জ্জুন বলেন করিলাম কোন কর্ম্ম।
গুরুনিন্দা করিলাম যাহাতে অধর্ম্ম।।
আপনাকে বধ করি প্রায়শ্চিত্ত বিধি।
আজ্ঞা কর নিষেধ না কর গুণনিধি।।
হাসিয়া বলেন কৃষ্ণ শাস্ত্রের প্রমাণ।
আপনা প্রশংসা কর মরণ সমান।।
আপনার প্রশংসা করিলে বার বার।
তবে তব প্রতিজ্ঞার হইবে উদ্ধার।।
আপনা প্রশংসা তবে করেন অর্জ্জুন।
আমার সমান কেবা ধরে এত গুণ।।
মম সম ধনুর্দ্ধর নাহিক সংসারে।
বাহুবলে চারিদিকে জিনেছি সমরে।।
সংশপ্তকগণে আমি করেছি সংহার।
কর্ণবীর সনে যুদ্ধ করি বার বার।।

এত বলি ধনঞ্জয় যূড়ি দুই কর।
অপরাধ ক্ষমা চান ধর্ম্মের গোচর।।
লজ্জায় কহেন পার্থ পড়িয়া চরণে।
নিন্দা করিয়াছি আমি ধর্ম্মের কারণে।।
বিস্তর বলেন তবে কৃষ্ণ মহামতি।
অর্জ্জুনে প্রসন্ন হইলেন নরপতি।।
করিলেন প্রতিজ্ঞা অর্জ্জুন ধনুর্দ্ধর।
আজ কর্ণে সংহারিব সংগ্রাম ভিতর।।
তব পদ স্পর্শ করি কহিলাম সার।
সত্যভ্রষ্ট হই যদি কর্ণে রাখি আর।।
ধনঞ্জয় গোবিন্দে ‍রাখিয়া মনোরথে।
গোবিন্দ সারথি সহ উঠিলেন রথে।।
শ্রীকৃষ্ণেরে বলিলেন বীর ধনঞ্জয়।
তোমার প্রসাদে আমি করিব বিজয়।।
রাজা ধৃতরাষ্ট্র হবে পুত্র পৌন্ত্রহীন।
আজি বসুমতী হবে ধর্ম্মের অধীন।।
আজি দুর্য্যোধন রাজা হইবে নিধন।
পাশা নাহি খেলিবে শকুনি দুর্য্যোধন।।
আজি সুখে নিদ্রা যাইবেক যুধিষ্ঠির।
আজি যুদ্ধে পড়িবেক কর্ণ মহাবীর।।
মহাভারতের কথা অমৃত সমান।
কাশীরাম দাস কহে শুনে পুণ্যবান।।