০৫. কর্ণের সহিত যুদ্ধে যুধিষ্ঠিরের পরাভব

কর্ণের বচন শুনি শল্য বলে দাপে।
বিস্তর কহিলে তুমি অতুল প্রতাপে।।
এই দেখ রথে আইল সর্ব্ব সৈন্যগণ।
কাহার সামর্থ্য করে ‍পার্থে নিবারণ।।
হের দেখ ভীমসেন পবনকুমার।
সহদেব বীর দেখ ভুবনের সার।।
মহারাজা যুধিষ্ঠির দেখ বিদ্যমান।
ধৃষ্টদ্যুন্ন সেনাপতি অগ্নির সমান।।
দ্রৌপদীর পঞ্চপুত্র কি দিব তুলনা।
ইহাদের অগ্রসর হবে কোন জনা।।
শিখণ্ডী সাত্যকি দেখ রাজা আগুয়ান।
চলহ সমরে আজি হয়ে সাবধান।।
সিদ্ধ হৈল মনোরথ দেখ ধনঞ্জয়।
সংগ্রামে করহ আজি অর্জ্জুনের ক্ষয়।।
এই কথা কহিতে মিশিল দুই দল।
মহাযুদ্ধ বাধিল হইল কোলাহল।।

ক্রোধ করি কর্ণ বীর প্রবেশিল রণে।
সিংহ যেন চলে যায় কুতুহল মনে।।
প্রবেশিয়া কর্ণ বীর করে মহারণ।
বাছিয়া বাছিয়া মারে বড় বীরগণ।।
সংগ্রামেতে প্রবেশিল কর্ণের কুমার।
দশ বাণে ভীম তারে করিল সংহার।।
সাক্ষাতে দেখিয়া কর্ণ ‍আপনা পাসরে।
পুত্রের কাটিল মাথা বীর বৃকোদরে।।
কর্ণপুত্রে নাশিয়া কৃপের কাটে ধনু।
তিন বাণে বিন্ধিলেন দুঃশাসন-তনু।।
ছয় বাণে শকুনিরে করিল বিকল।
রথ কাটি বিন্ধেন উলূক মহাবল।।
থাক থাক সুষেণ কাটিব তব শির।
এত বলি বাণ মারে ভীম মহাবীর।।
তিন বাণে বিন্ধিলেন ভীমবীর তাকে।
সুষেণ সুতীক্ষ্ম অস্ত্র মারে ঝাঁকে ঝাঁকে।।
নকুল সহিত যুদ্ধ বাড়িল বহুল।
দুঃশাসন সাত্যকিতে সংগ্রাম তুমুল।।
অতি ক্রোধে কর্ণবীর রণে প্রবেশিল।
ইন্দ্র দেবরাজ যেন সমরে আইল।।
একে কর্ণ মহাবীর পেয়ে অপমান।
নিজ পুত্র পড়িল আপনি বিদ্যমান।।
যুধিষ্ঠির বধে যুক্তি কৈল কর্ণবীর।
ক্রোধে পরিপূর্ণ কর্ণ কাঁপয়ে শরীর।।
একেবারে যুড়ি মারে শত শত বাণ।
বিন্ধি পাণ্ডবের সৈন্য কৈল খান খান।।
মহাধনুর্দ্ধর বীর বরিষয়ে শর।
বিচিত্র বিক্রম দেখি কর্ণ ধনুর্দ্ধর।।
মহারথিগণে বিন্ধে নিবারিতে নারে।
একেশ্বর কর্ণ যুঝে পাণ্ডব সমরে।।
গজ বাজী ধ্বজ ছত্র রথ সারি সারি।
অযুত অযুত পাড়ে লিখিতে না পারি।।
মুণ্ড কাটি পাড়ে কার কুণ্ডল সহিত।
অশ্ব রথ কাটিয়া যে পাড়িল ত্বরিত।।
যুধিষ্ঠিরে রাখিতে ধাইল বহু দল।
দৃষ্টিমাত্র কাটি পাড়ে কর্ণ মহাবল।।
যুধিষ্ঠির বলিলেন কর্ণে উচৈঃস্বরে।
শুন কর্ণ এক কথা বলি যে তোমারে।।
দুর্য্যোধন বাক্যে কর মম সহ রণ।
শুদ্ধ অভিলাষ তোর খণ্ডাব এখন।।
এত বলি ধর্ম্ম মারিলেন দশ শর।
তাঁর শরাশন কাটে কর্ণ ধনুর্দ্ধর।।
ক্রোধভরে যুধিষ্ঠির যেন হুতাশন।
টঙ্কারিয়া লইলেন অন্য শরাসন।।
যম দণ্ড সম ধনু অতি ভয়ঙ্কর।
মহেশের শূল যেন জ্বলে বৈশ্বানর।।
বজ্রের সমান সেই বাণে যুধিষ্ঠির।
কর্ণের দক্ষিণ ভাগে বিন্ধিলেন বীর।।
বেদনা পাইল তাহে কর্ণ ধনুর্দ্ধর।
মূর্চ্ছিত হইয়া পড়ে রথের উপর।।
হাহাকার কুরুদলে প্রচার হইল।
পাণ্ডবের সৈন্যে জয়ধ্বনি প্রকাশিল।।
মহা সিংহনাদ করে পাণ্ডবের দল।
চেতনা পাইয়া উঠে কর্ণ মহাবল।।
যুধিষ্ঠির নিধন চিন্তিল মনে মন।
টঙ্কারিয়া হাতে নিল দিব্য শরাসন।।
বিজয় নামেতে ধনু নিল আরবার।
যাহাতে আছয়ে চন্দ্র সূর্য্যের আকার।।
সত্যষেণ সুষেণ কর্ণের দুই সুত।
তিন বাণে ধর্ম্মে বিন্ধে বিক্রমে অদ্ভূত।।
বিন্ধিল নৃপতি সত্যষেণের শরীরে।
তিন বাণে বিন্ধিলেক কর্ণ মহাবীরে।।
সর্ব্ব অস্ত্র নিবারিল কর্ণ একেশ্বর।
সপ্তবাণে বিন্ধিলেক ধর্ম্ম নৃপবর।।
রাজারে রাখিতে এল এত যোদ্ধাগণ।
ধৃষ্টদ্যুন্ন ভীম সেন দ্রুপদ নন্দন।।
সহদেব সুষেণ নকুল কাশীপতি।
শিশুপাল তনয় আইল শীঘ্রগতি।।
একেবারে অস্ত্র এড়ে কর্ণের উপর।
সর্ব্ব অস্ত্র নিবারিল কর্ণ ধনুর্দ্ধর।।
পাণ্ডবের সৈন্য সর্ব্ব করে পরাজয়।
কালান্তক যম যেন কর্ণ মহাশয়।।
যুধিষ্ঠির রাজার হাতের কাটে ধনু।
সন্ধান পূরিয়া বীর বিন্ধিলেক তনু।।
কবচ কাটিয়া পাড়ে ধরণী উপরে।
রুধির পড়িছে ধারে ধর্ম্ম-কলেবরে।।
শক্তি অস্ত্র মারিলেন রাজা যুধিষ্ঠির।
শক্তি নাহি ভেদিল সে কর্ণের শরীর।।
অতি ক্রোধে কর্ণবীর মারে তীক্ষ্মশর।
সেই শরে বিন্ধিলেক ধর্ম্ম-কলেবর।।
হৃদয়ে বিন্ধিল আর বিন্ধিল কপাল।
ধ্বজছত্র কাটিলেন বিক্রমে বিশাল।।
গজ অঙ্গ কাটা গেল হইল প্রমাদ।
ছিন্ন ভিন্ন সৈন্য সব করে আর্ত্তনাদ।।
অন্য রথে চড়িলেন ধর্ম্ম নৃপবর।
রথ চালাইয়া দেন কর্ণের গোচর।।
জিনিলেন কর্ণ বীর পাণ্ডবের নাথ।
উপহাস করে কর্ণ ধর্ম্মের সাক্ষাৎ।।
ক্ষন্ত্রকুলে জন্মিয়াছ তুমি মহাজন।
কাণেতে কাতর হয়ে পরিহর রণ।।
ক্ষন্ত্রধর্ম্মে তোমারে সুদক্ষ নাহি গণি।
ব্রহ্মচর্য্য ধর্ম্মেতে তোমাকে বাখানি।।
আর যুদ্ধ না করহ কর্ণবীর সনে।
যদি প্রাণে রক্ষা পাও যাও নিজস্থানে।।
এত বলি কর্ণবীর ছাড়িল নৃপতি।
ক্ষমিল সকল বীরে কর্ণ সেনাপতি।।
কোপেতে ধাইল ভীম মহাবলধর।
রাজারে করিল পাছু দুই সহোদর।।
কর্ণ ভীম সমাগমে হৈল মহারণ।
বিমানে চড়িয়া দেখে দেবঋষিগণ।।
কালদণ্ড সম যেন বিজলী ঝঙ্কার।
কর্ণেরে মারিল ভীম অস্ত্র খরধার।।
শরে কর্ণ বীরবরে করে ছারখার।
মহাশব্দে ভীমসেন করে মার মার।।
হাতে ধনু লয়ে বীর সমরে প্রচণ্ড।
হানিয়া রাজার পুত্রে করে খণ্ড খণ্ড।।
দুই বীরে শরবৃষ্টি করিল প্রকাশ।
অন্ধকারময় শূণ্য না চলে বাতাস।।
আকর্ণ, পূরিয়া কর্ণ করিল সন্ধান।
ভীমের হাতের ধনু করে খান খান।।
গদাঘাত কর্ণে করিল বৃকোদর।
মুর্চ্ছিত হইল কর্ণ রথের উপর।।
রথ বাহুড়িল তবে সারথি সত্বর।
ক্ষণেকে চেতন পায় কর্ণ ধনুর্দ্ধার।।
বাহুযুদ্ধ করে দোঁহে মহাবীর।

অশ্বথামা বীর তবে প্রতিজ্ঞা করিল।।
রাজার গোচরে গিয়া এমত কহিল।
ধৃষ্টদ্যুন্ন বীর বটে মম পিতৃবৈরী।।
তোমারে তুষিব আজি তাহারে সংহারি।
বিনা ধৃষ্টদ্যুন্ন বধে যুদ্ধ যদি করি।।
আজিকার যুদ্ধে আমি হব পিতৃবৈরী।
প্রতিজ্ঞা করিয়া বীর আসিলেক রণে।।
ধৃষ্টদ্যুন্ন সেনাপতি আসিল তখনে।
হুহুঙ্কার করি যুঝে দ্রোণপুত্র সনে।।
অশ্বথামা মহাবীর মিলিল সমানে।
মহাবীর অশ্বথামা সংগ্রামে নিপুণ।।
ধৃষ্টদ্যুন্ন বীরের কাটিল ধনুগুণ।
অশ্বসহ সারথিরে করিল সংহার।।
নাহিক সম্ভ্রম কিছু দ্রোণের কুমার।
ক্রোধভরে আসে অশ্বথামা মহাবীর।।
মনে ভাবি কাটিবেন ধৃষ্টদ্যুন্ন শির।
ভীমসেন করিল তাঁহার পরিত্রাণ।।
আকাশে অমরগণ করয়ে বাখান।
মহাবীর কর্ণে তবে বরিষয়ে শর।।
বরিষার মেঘ ঘেন বরিষে নির্ঝর।
ভাঙ্গিল নারেন সৈন্য ধর্ম্ম নৃপবরে।।
পুনঃ যুধিষ্ঠিরে ধায় কর্ণ মহাবীর।
নারাচ বাণেতে বিন্ধে রাজার শরীর।।
যুধিষ্ঠির হৃদয়ে বিন্ধিল সাত বাণ।
ধর্ম্মের শরীর বিন্ধি কৈল খান খান।।
রাখিবারে রাজারে এল যোদ্ধাগণ।
কর্ণবীর বাণেতে করিল নিবারণ।।
সহদেব নকুল ধর্ম্মের পাশে থাকে।
দুই ভাই বিপক্ষে মারিল লাখে লাখে।।
ত্রিভুবনে বীর নাই কর্ণের সোসর।
কাটিল রাজার ধনু কর্ণ ধনুর্দ্ধর।।
এক বাণে কাটিয়া পাড়িল শরাসনে।
শর ধনু কাটিয়া পাড়িল সেইক্ষণে।।
অবিলম্বে অশ্ব রথ কাটেন কর্ণবীর।
অস্ত্র বৃষ্ঠি করিলেন ধর্ম্মের উপর।।
দুই ভাই চড়িলেন সহদেব রথে।
পুনরপি কর্ণবীর ধনু নিল হাতে।।
পাণ্ডবের মাতুল মদ্রের অধিপতি।
কর্ণের সারথী সেই বীর মহামতি।।
ভাগিনার দুঃখ দেখি হৃদয়ে আকুল।
বিস্তর বলিল পাণ্ডবের অনুকূল।।
শুন কর্ণ মহাশয় আমার বচন।
আপনি প্রতিজ্ঞা কৈলা বিস্মর এখন।।
অর্জ্জুনের সঙ্গে রণ প্রতিজ্ঞা করিলে।
ধর্ম্মপুত্র যুধিষ্ঠির সঙ্গে আরম্ভিলে।।
হীন অস্ত্র যুধিষ্ঠির কবচ রহিত।
তাহাকে বিন্ধিতে কর্ণ না হয় উচিত।।
পার্থে এড়ি যুধিষ্ঠিরে মারিবার আশ।
কৃষ্ণসনে অর্জ্জুন করিবে উপহাস।।
শল্যের বচন শুনি ফিরে কর্ণবীর।
লজ্জা পেয়ে শিবিরে গেলেন যুধিষ্ঠির।।
রথ হৈতে নামিলেন ধর্ম্ম নরপতি।
সরক্ত শরীর রাজা সবিকল মতি।।
সহদেব নকুলেরে পাঠান সত্বর।
যথা যুদ্ধ করে মহাবীর বৃকোদর।।
যুধিষ্ঠিরে এড়ি কর্ণ অন্যেকে ধাইল।
মৃগযুথ মধ্যে যেন গজেন্দ্র পশিল।।
যত অস্ত্র ভৃগুরাম দিল মহাবীরে।
মারিলেন কর্ণবীর নির্ভর অন্তরে।।
পাণ্ডবের সৈন্যেতে করিল হাহাকার।
যুগান্তের যম যেন করিল সংহার।।
অর্জ্জুন অর্জ্জুন বলি মহাশব্দ করে।
ধনঞ্জয় ধনুর্দ্ধর গেল কোথাকারে।।
সংসপ্তকগণ সঙ্গে সংগ্রাম দুষ্কর।
আসিতে অর্জ্জুন নাহি পান অবসর।।

শ্রীকৃষ্ণ বলেন শুন ধনঞ্জয় বীর।
সৈন্য সব সংহার করিল কর্ণ মহাবীর।।
পরশুরামের অস্ত্র করিল সন্ধান।
লক্ষ কোটী বাণ মারে দেখ বিদ্যমান।।
যুগান্তের যম যেন কর্ণবীর ধায়।
হের দেখ সৈন্য সব সম্ভ্রমে পলায়।।
কৌরবের সৈন্য সব করে সিংহনাদ।
পাণ্ডবের সৈন্য করে বহুল বিষাধ।।
প্রাণ উপেক্ষিয়া যুদ্ধ করে বৃকোদর।
যুধিষ্ঠিরে নাহি দেখি সংগ্রাম ভিতর।।

শুনিয়া কহেন ধনঞ্জয় গদাধরে।
সত্বরে চালাও রথ দেখি যুধিষ্ঠিরে।।
সংসপ্তকগণ মম আছে অবশিষ্ট।
শীঘ্রগতি চল প্রভু দেখি মোর জ্যেষ্ঠ।।
অর্জ্জুন বচনে কৃষ্ণ দেন অনুমতি।
যুধিষ্ঠির স্থানে ত্বরা যান শীঘ্রগতি।।
শঙ্খনাদ করিয়া চলেন ধনঞ্জয়।
অর্জ্জুনে রোধিল অশ্বথামা মহাশয়।।
দিব্য অস্ত্র দুই বীর করিল সন্ধান।
দেবাসুর যুদ্ধ যেন নাহি অবসান।।
দ্রোণপুত্রে জিনিয়া অর্জ্জুন মহাবীর।
ভীমের পশ্চাতে আইলেন অতি ধীর।।
জিজ্ঞাসেন ভীমসেনে রাজার বৃত্তান্ত।
কর্ণযুদ্ধ কথা ভীম কহিল আদ্যন্ত।।
কর্ণ শরে বিহবল হইল কলেবর।
গেলেন বিষাদে রাজা শিবির ভিতর।।
দেবে বাঁচিলেন ভাই ধর্ম্ম নরপতি।
এত বলি নিশ্বাস ছাড়িল মহামতি।।

শুনিয়া বিকল কৃষ্ণ অর্জ্জুন দুর্জ্জয়।
ভীমেরে বলেন তবে বীর ধনঞ্জয়।।
কৃপকর্ণ দ্রোণপুত্র রাজা দুর্য্যোধন।
উহাদের সঙ্গে যুদ্ধ করিব এখন।।
আমি হেথা যুদ্ধ করি তুমি যাও তথা।
বৃত্তান্ত করিয়া এস নৃপবর যথা।।
ভীমসেন বলিলেন আমি আছি রণে।
যুদ্ধ হইতেছে মম কুরুসৈন্য সনে।।
হেনকালে এড়ি যাই যদি আমি রণ।
নিন্দিবে পলাল বলি যত কুরুগণ।।
যুদ্ধ ছাড়িবার এই নহেত সময়।
দেখিয়া আইস যুধিষ্ঠির মহাশয়।।
ভীমেরে রাখিয়া তবে সংগ্রাম ভিতরে।
কৃষ্ণ পার্থ আইলেন দেখিতে রাজারে।।
মহাভারতের কথা অমৃত সমান।
কাশীরাম দাস কহে শুনে পুণ্যবান।।