১২. যুধিষ্ঠিরের সহিত বিপ্ররূপী ইন্দ্রের ও কুক্কুররূপী ধর্ম্মের ছলনা

মুনি বলে শুনহ নৃপতি জন্মেজয়।
উত্তরাজ্যে চলিলেন ধর্ম্মের তনয়।।
কতদূরে দেখি গন্ধমাদন পর্ব্বত।
যাহার সৌরভ যায় যোজনের পথ।।
তাহে উঠি শুনিলেন স্বর্গের বাজনা।
ভূপতি করেন মনে পূরিল কামনা।।
স্বর্গের দুর্ল্লভ ভোগ সেই গিরিবরে।
আরোহণ করিলেন হরিষ অন্তরে।।
পর্ব্বতে দেখিল তবে ধর্ম্মের তনয়।
অপূর্ব্ব মহেশ লিঙ্গ মরকতময়।।
অত্যন্ত নির্জ্জন স্থান লোকে মনোহর।
কোটি চন্দ্র জিনিয়া উজ্জ্বল মহেশ্বর।।
হীরা মণি মাণিক্যের মন্দির সুঠাম।
দেখি রাজা ভক্তিভাবে করেন প্রণাম।।
হরিহর এক তনু ভিন্ন কভু নয়।
হরিভক্ত মোরে হর হবেন সদয়।।
এত বলি বর মাগি যান ধীরে ধীরে।
কত কালে পার হব দুঃখের সাগরে।।
বিষাদ ভাবেন মনে ধর্ম্মের নন্দন।
কারে লৈয়া যাব আমি ত্রিদিব ভুবন।।
কে ‍মোরে করাবে দেখা কৃষ্ণের সহিতে।
হিমে যদি যায় তনু তরি দুঃখ হৈতে।।
বংশক্ষয় করিলাম স্বর্গে আরেহিয়া।
চারি ভাই ভার্য্য বনে রহিল পড়িয়া।।
পৃথিবীতে আমি কত করিলাম পাপ।
কোন ‍মুনি দেব ঋষি দিল মোরে শাপ।।

কান্দেন ভূপতি স্মরি দ্রৌপদী সুন্দরী।
হেনকালে আসে যত গন্ধর্ব্বের নারী।।
কন্যাগণ বলে রাজা কান্দ কি কারণ।
দ্বিতীয় স্বর্গের সম এ গন্ধমাদন।।
স্বর্গে আসি কান্দ কেন কহ বিবরণ।
এ স্থানে না হয় কেহ দুঃখের ভাজন।।

কন্যাগণ বাক্য শুনি কন নৃপবর।
চারি ভাই ভার্য্যা গেল পর্ব্বত উপর।।
ছয়জন মধ্যে আমি আছি একজন।
মহাহিমে স্বর্গপথে মৈল পঞ্চজন।।
মহাবীর ভীম ভার্য্যা না দেখিব আর।
এই হেতু কান্দি কন্যা শুন সমাচার।।

রাজার বচন শুনি কন্যাগণ হাসে।
প্রবোধ বচন কিছু কহে মৃদুভাষে।।
ভাবিত না হও রাজা ভার্য্যা ভ্রাতৃশোকে।
তব অগ্রে তারা সব গেছে স্বর্গলোকে।।
কি কারণে কান্দ রাজা হৈয়া বিচক্ষণ।
স্বর্গেতে সবার সঙ্গে হইবে মিলন।।
স্বর্গপথে আসিতে পড়িল রাজা সব।
তারা সবে অগ্রে গেল শুনহ পাণ্ডব।।
উপেন্দ্র খগেন্দ্র ইন্দ্র যোগেন্দ্রের প্রায়।
তুমি মহারাজ তেঁই আসিলে হেথায়।।
আর এক বাক্য রাজা শুন সাবধানে।
এত দূরে আসিয়াছ পুণ্যের কারণে।।
মনুষ্যের শক্তি নাই এতদূরে আসে।
অতএব এক বাক্য বলি যে বিশেষে।।
রাজা হৈয়া থাক গন্ধমাদন পর্ব্বতে।
স্বর্গের অধিক সুখ ভুঞ্জ আনন্দতে।।

যুধিষ্ঠির বলিছেন শুন কন্যাগণ।
কৃষ্ণের আজ্ঞায় করি স্বর্গে আরোহণ।।
সঙ্কল্প করিনু আমি অবনী ভিতরা।
রাজা না করিব, যাব অমর নগর।।
প্রাণতুল্য ভাই ভার্য্যা পড়িল বিষাদে।
কি কার্য্যা রাজ্যেতে মম বিপুল সম্পদে।।

এত শুনি নিবৃত্ত হইল কন্যাগণ।
যুধিষ্ঠির করিলেন স্বর্গ আরোহণ।।
কতদূরে দেখিলেন কিন্নরের পুরী।
পদ্মিনী রমণীগণ আর বিদ্যাধবী।।
যুধিষ্ঠিরে বলে তুমি কোন পুণ্যবান।
আলিঙ্গন দিয়া রাখ আমাদের প্রাণ।।
আমা সবাকার স্বামী হও মহামতি।
যাচক হইয়া বলে যতেক যুবতী।।
পুরুষ নাহিক রাজা রাজ্যেতে আমার।
তুমি রাজা হও দাসী হইব তোমার।।
অকাল মরণ নাহি জরা মৃত্যু ভয়।
নানা সুখ পাবে রাজা জানিও নিশ্চয়।।
অবশেষে মহামন্ত্র শিখাব তোমারে।
শীত ভেদি অনায়াসে যাবে স্বর্গপুরে।।

শুনি কন্যাগণ বাক্য বলেন রাজন।
সুখ অভিলাষ নাহি করে মম মন।।
আশীর্ব্বাদ কর মোরে দেব কন্যাগণ।
স্বর্গপুরে গিয়া যেন দেখি নারায়ণ।।
দ্বাপরের শেষ হল কলি অবতার।
সত্য ধর্ম্ম বিবর্জ্জিত অতি কদাচার।।
সে কারণে যাই স্বর্গে ইন্দ্রের ভূবন।
করিলেন শ্রীমুখে অনুজ্ঞা নারায়ণ।।

কন্যাগণ বলে রাজা তুমি মূঢ়জন।
কি ফল পাইবা স্বর্গে দেখি নারায়ণ।।
হেথা ফল পাইবা স্বর্গে দেখি নারায়ণ।
হেথা ফল কত পাবে কি কব তোমারে।।
না শুনিয়া নরপতি চলেন উত্তরে।

হিমালয় গিরি পাইলেন মনোহর।।
নারীগণ আসে নিত্য পূজিতে শঙ্কর।
ত্রিভুবন সার বিশ্বকর্ম্মা বিরচিত।
চতুর্দ্দশ সহস্রেক শিবলিঙ্গ স্থিত।।
পরম সুন্দর গিরি কি কহিতে পারি।
সুমেরু কৈলাস জিনি মহেশ্বর পুরী।।
বিচিত্র নগর ঘর অতি মনোরম।
কন্যগণ আসে নিত্য শিবের আশ্রম।।
শুক্ল বস্ত্র পরিধান চন্দ্র সম কান্তি।
রূপ দেখি মুনি গণ মনে হয় ভ্রান্তি।।
নানা অলঙ্কারে শোভা ত্রৈলোক্য-মোহিনী।
মুখপদ্ম করপদ্ম সকল পদ্মিনী।।
বিচিত্র চম্পক দাম শোভিত গলায়।
কেহ কেহ নৃত্য করে কেহ গীত গায়।।
যুধিষ্ঠির নৃপতি আসেন এই পথে।
পাদ্য অর্ঘ্য লয়ে আস তাঁহার সাক্ষাতে।।
ঋষি মুনিগণ শুনি ধর্ম্মের প্রয়াণ।
দেখিতে আইল সবে আনন্দ বিধান।।
পৃথিবীর রাজা হেথা এল পুণ্যভাগে।
ঝটিতি আসিল সবে যুধিষ্ঠির আগে।।
দেব ঋষিগণ আসি করেন সম্ভাষ।
অন্ধকার ঘুচে গেল হইল প্রকাশ।।
প্রণাম করেন রাজা মুনি ঋষিগণে।
নৃপতিরে আশীর্ব্বাদ কৈল সর্ব্বজনে।।
শোভা পায় পর্ব্বতে বৈতরণী সরিত।
অতি অপরূপ তীর নীর সুললিত।।
পর্ব্বতে বেষ্টিত জল অতি সুশোভন।
অষ্টাশী তপস্বী তপ করে অনুক্ষণ।।
ক্রীড়া করে জলেতে বিবিধ জলচর।
সুন্দর কনক পদ্ম ফুটে নিরন্তর।।
অষ্টাশী সহস্র ঋষি দেখি অনুপম।
যোড়হাতে নরপতি করেন প্রণাম।।
যুধিষ্ঠিরে দেখিয়া প্রশংসে মুনিগণ।
ধন্য ধন্য রাজা তুমি হরিপরায়ণ।।
এই বৈতরণী নদী পরম নির্ম্মল।
উত্তর হইতে বহে দক্ষিণ মণ্ডল।।
দক্ষিণ শমনপুরে প্রলয় তরঙ্গ।
পাপী পার হৈতে নারে দেখি দেয় ভঙ্গ।।
মর্ত্ত্যেতে গো দান করে যেই পুণ্যজনে।
সুখে পার হৈয়া যায় নৌকা আরোহণে।।

ভুপতি বলেন আমি পাপী নরাধম।
মুনিগণ বলে তুমি মহাপুণ্যতম।।
এত বলি মুনিগণ কৈবর্ত্ত ডাকিয়া।
নৃপতিরে পার কৈল নৌকা আরোহিয়া।।
ঋষিগণে বন্দি রাজা নদী হৈয়া পার।
পুণ্য হেতু দেখিলেন স্বর্গের দুয়ার।।
চন্দ্র সূর্য্য দেবগণ দেখেন প্রত্যেক।
স্বর্গ আরোহণ হৈতে আছে যোজনেক।।
পার হৈয়া বৃক্ষতলে বসি নরেশ্বর।
স্বর্গ দেখি হইলেন চিন্তিত অন্তর।।
অদ্ভূত স্বর্গের দ্বার দেখি বিদ্যমান।
নানা ঋতু বিরাজিত প্রবাল পাষাণ।।
হাতে অস্ত্র দ্বারপাল চৌদিকে বেষ্টিত।
কত লক্ষ পুণ্যবান হয়েছে বারিত।।
ইন্দ্র আজ্ঞা বিনা দ্বারী দ্বার নাহি ছাড়ে।
বুকে বুকে দান্ডাইয়া আছে করযোড়ে।।

যুধিষ্ঠিরে দেখিয়া লইল আগুসারি।
দ্বারপালগণ কহে কর যোড় করি।।
তোমার জনক পূর্ব্বে পাণ্ডু নরপতি।
মৃগঋষি শাপে তাঁর না হৈল সন্ততি।।
বিমুখ হইয়া রাজা সংসারের সুখে।
কুন্তী মাদ্রী ভার্য্যা সহ আইল হেথাকে।।
অপুত্রক হেতু ইন্দ্র আজ্ঞা নাহি দিল।
হেথা হৈতে পুনঃ তিনি মর্ত্ত্যপুরে গেল।।
দেব হৈতে জন্ম হৈল তোমা পঞ্চভাই।
পুত্রবান হইয়া বৈকুণ্ঠে পায় ঠাঁই।।
তাঁর ক্ষেত্রে জন্ম তব, ধর্ম্মের ঔরসে।
তুমি মহা ধর্ম্মশীল জানি সবিশেষে।।
মুহুর্ত্তেকে বৈস রাজা শূন্য সিংহাসনে।
ইন্দ্রে জানাইয়া স্বর্গে লব এইক্ষণে।।
দ্বারপাল গিয়া বার্ত্তা দিল পুরন্দরে।
যুধিষ্ঠির আইলেন স্বর্গের দুয়ারে।।
শুনিয়া দেবতা সবে কহে ইন্দ্র প্রতি।
রথে করি যুধিষ্ঠিরে আন শীঘ্রগতি।।

এত শুনি দেবরাজ বিপ্ররূপ ধরি।
যুধিষ্ঠিরে ছলিবারে এল শীঘ্র করি।।
ব্রাহ্মণ দেখিয়া রাজা করেন প্রণতি।
আশীর্ব্বাদ করিলেন কপট দ্বিজাতি।।
জিজ্ঞাসিল যুধিষ্ঠিরে কপট ব্রাহ্মণ।
বড় পুণ্যবান তুমি এলে কোনজন।।

এত শুনি নৃপতি কহেন যোড়করে।
পরিচয় মহাশয় কহিব তোমারে।।
জম্বুদ্বীপ নামে এক আছে পৃথিবীতে।
যাহে জন্মিলেন ব্রহ্মা ভার নিবারিতে।।
চন্দ্রবংশে দেব অংশে হস্তিনায় ধাম।
পাণ্ডুপুত্র ঋষিগোত্র যুধিষ্ঠির নাম।।
রাজ্যলোভে সবান্ধবে বধিলাম রণে।
লোভে পাপ আছে তাপ হৈল মম মনে।।
জ্যেষ্ঠতাত সহ মাতৃ গেল তপোবনে।
পঞ্চ ভাই দুঃখ পাই ভ্রমি নানা স্থানে।।
আমারে বিষাদ দেখি দেব নারায়ণ।
আজ্ঞা দেন কর রাজা স্বর্গ আরোহণ।।
কলি অবতার হবে দ্বাপরের শেষ।
এত বলি স্বস্থানে গেলেন হৃষীকেশ।।
যদুবংশ করি ধ্বংস ব্রহ্মশাপ ছলে।
আপনি বৈকুন্ঠে বিষ্ণু গেলেন কৌশলে।।
তবে মোরা পঞ্চভাই করিয়া বিচার।
পৌন্ত্রে সমর্পণ করি রাজ্য অধিকার।।
পঞ্চভাই ভার্য্যা সহ আসি স্বর্গপথে।
হিম শীতে পঞ্চজন পড়িল পর্ব্বতে।।
শোক দুঃখ সন্তাপে তাপিত মম মন।
এই নিজ তত্ত্ব দ্বিজ করি নিবেদন।।
একেশ্বর দ্বিজবর যাব স্বর্গপুরী।
সুমেরু পর্ব্বতে গিয়া দেখিব মুরারী।।
কিম্বা প্রাণ যাক কিম্বা যাই স্বর্গপুরে।
করিয়া সঙ্কল্প এই আসি এতদূরে।।
কতদূর আছে স্বর্গ কহ দ্বিজবর।
যাইতে পারিব, কিবা যাবে কলেবর।।

ব্রাহ্মণ বলেন শুন ধর্ম্ম নরবর।
এখুনি দেখিবে রাজা পঞ্চ সহোদর।।
কুরুক্ষেত্রে যে ছিল আঠার অক্ষৌহিণী।
সবাকারে ক্ষনেকে দেখিবে নৃপমণি।।
এড়াইয়া এলে দুঃখ আর চিন্তা নাই।
আমি লয়ে যাব তোমা ঈশ্বরের ঠাঁই।।
নিকট হইল স্বর্গ যাবে মুহূর্ত্তেকে।
শোক দুঃখ পরিহর জানাই তোমাকে।।

ইন্দ্র যুধিষ্ঠিরে কথা হয় এইমতে।
তথা ধর্ম্ম আইলেন কুক্কুররূপেতে।।
শব্দ করি ব্রাহ্মণে খাইতে শ্বান যায়।
দণ্ড লৈয়া ব্রাহ্মণ মারিল তার গায়।।
নির্ঘাত প্রহার করে কুক্কুরের দেহে।
পরিত্রাহি ডাকি শ্বান যুধিষ্ঠিরে কহে।।
ওহে পৃথিবীর রাজা মহাপুণ্যবান।
নির্দ্দয় ব্রাহ্মণ বধে কর পরিত্রাণ।।
দণ্ডের প্রহারে মম কম্পবান তনু।
উদ্ধার করিতে কেহ নাহি তোমা বিনু।।

কুক্কুরের বাক্যে রাজা উঠি যোড়হাতে।
বলেন বিনয় করি বিপ্রের সাক্ষাতে।।
নাহি মার কুক্কুরের শুন দ্বিজবর।
শুনিয়া বিপ্রের ক্রোধ বাড়িল বিস্তর।।
হাতে দণ্ড করি বলে নৃপতির প্রতি।
মম হাতে কুক্কুরের নাহি অব্যাহতি।।
পুণ্যহীন কুক্কুরের নাহি পরিত্রাণ।
পুণ্য বিনা স্বর্গে বাস নাহি মতিমান।।

ভূপতি বলেন রাখ কুক্কুরের প্রাণ।
মর্ত্ত্যের অর্দ্ধেক পুণ্য দিব আমি দান।।
যুধিষ্ঠির বাক্য শুনি ধর্ম্ম হাসি মনে।
ধরিলেন নিজ মূর্ত্তি রাজা বিদ্যমানে।।
তদন্তরে দেবরাজ নিজ মূর্ত্তি হৈয়া।
পরিচয় কহিলেন হাসিয়া হাসিয়া।।
ধর্ম্মে ইন্দ্রে দেখি রাজা আপন নয়নে।
লোটাইয়া পড়িলেন অষ্টাঙ্গ চরণে।।
কোলে করি ধর্ম্ম সাধু বলেন তাঁহাকে।
তুমি পুত্র যুধিষ্ঠির না চিন আমাকে।।
ধর্ম্ম বলি মর্ত্ত্যলোকে বলয়ে তোমারে।
তোমা জন্মাইনু আমি কুন্তীর উদরে।।
এই ইন্দ্র দেবরাজ স্বর্গ অধিপতি।
এস পুত্র কোলে করি কেন দুঃখমতি।।
তোমার চরিত্র প্রচারিল ত্রিভুবনে।
স্বর্গপুরে চল, চড়ি পুষ্পক বিমানে।।
পদব্রজে পর্ব্বতে পেয়েছে বড় পীড়া।
একে সুকোমল অঙ্গ শোক চিন্তা বেড়া।।
সর্ব্ব দুঃখ হৈল দুর চল স্বর্গপুরে।
মাতা পিতা দেখিবা সকল সহোদরে।।
এতেক কহেন যদি ধর্ম্ম মহাশয়।
আনন্দিত হইলেন ধর্ম্মের তনয়।।
ভারত অপূর্ব্ব কথা স্বর্গ আরোহণে।
যুধিষ্ঠির স্বর্গে যান কাশীদাস ভণে।।